যেকোনো মূল্যে মাঠে থাকতে নেতাকর্মীদের উদ্দেশে কড়া বক্তব্য দিলেও মহাসমাবেশে সংঘর্ষের পর বিএনপির শীর্ষ নেতারা যেন নিরুদ্দেশ হয়ে গেছেন। মহাসমাবেশের পরদিন হরতাল কর্মসূচিতেও তাদের দেখা মেলেনি। মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নিজ বাসা থেকে গ্রেফতার হলেও একাধিক শীর্ষ নেতার বাসায় হানা দিয়ে তাদের খোঁজ পায়নি গোয়েন্দা পুলিশ। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, বিএনপির মাঠ কাঁপানো নেতারা এখন কোথায়?
গত শনিবারের (২৮ অক্টোবর) সহিংসতার ঘটনায় ঢাকায় মামলা হয়েছে ৩৪টি। এর মধ্যে ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন থানায় ৩০টি এবং ঢাকা জেলার চার থানায় পৃথক চারটি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও মির্জা আব্বাসসহ এক হাজার ৫২০ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত পরিচয় আসামি করা হয়েছে আরও পাঁচ হাজার জনকে।
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন: নয়াপল্টন আজও পুলিশের ‘নিয়ন্ত্রণে’
ফলে মাঠে থাকার চেয়ে গ্রেফতার এড়ানোর দিকে বেশি নজর বিএনপি নেতাদের। অবশ্য এর মধ্যে মঙ্গলবার থেকে তিন দিনের অবরোধ পালনেরও ঘোষণা দিয়েছে দলটি। কার্যালয়ে না যেতে পেরে ভার্চুয়ালি সংবাদ সম্মেলন করে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
বিএনপি নেতাদের মাঠে না থাকার বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে নানা মহলে। দলের তৃণমূলেও এটা নিয়ে নানা সমালোচনা হচ্ছে। যদিও কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, এটাও তাদের কৌশলের অংশ। যথাসময়ে নেতারা প্রকাশ্যে আসবেন।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিএনপির নেতাদের নিরুদ্দেশ হওয়া নিয়ে টিপ্পনি কেটেছেন। তিনি বলেছেন, মির্জা ফখরুল সাহেব জেলে। এছাড়া তাদের সব নেতা পালিয়ে আছেন। তাদের খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না। তাহলে বিএনপির অবরোধের নেতৃত্ব দেবে কে?
বিএনপি নেতাদের ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে, গ্রেফতার এড়াতে নেতারা আপাতত কৌশলে চলাফেরা করছেন। বেশিরভাগ নেতা নিজ বাসা রেখে অন্যত্র অবস্থান করছেন। সেখান থেকেই মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন।
তবে সরকার পতনের আন্দোলন শেষ দিকে নিয়ে আসার সময়ও নেতাদের মাঠে না পাওয়ায় ক্ষোভ আছে কর্মীদের মনে। কারণ হরতালে ঢাকাসহ সারাদেশে যত মিছিল হয়েছে সবখানে কর্মীদের উপস্থিতি বেশি ছিল। ঢাকায়ও বিএনপির হাতেগোনা কয়েক নেতা ছাড়া কেন্দ্রীয় ও মহানগরের নেতাদের কারও দেখা মেলেনি। অ্যাম্বুলেন্সে করে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ঝটিকা মিছিল করেছেন বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের একাধিক শীর্ষ নেতা।
আরও পড়ুন: বিএনপির শীর্ষ নেতাদের বাসায় বাসায় পুলিশের হানা
যুবদলের কেন্দ্রীয় এক নেতা নাম প্রকাশ না করে ঢাকা মেইলকে বলেন, 'হাতে সময় নেই। এই সময় নেতারা মাঠে না নামলে সময় কই? কর্মীরা তো জীবন দিয়ে দিতে পারবে না। সাহস করে মাঠে আসতে হবে। সিনিয়ররা মাঠে থাকলে শক্তি বেড়ে যায়।'
এসময় যারা মাঠে থাকবে না তাদের ব্যাপারে দলের কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিও করেন তিনি।
পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী, শনিবার (২৮ অক্টোবর) রাজধানীর নয়াপল্টনের নিজেদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে মহাসমাবেশ করে বিএনপি। দুপুর ২টার দিকে সমাবেশ শুরু হলেও কাকরাইলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় দলটির নেতাকর্মীরা। এ সময় এক পুলিশ কনস্টেবল ও এক যুবদল কর্মী নিহত হন। এছাড়া আহত হন পুলিশ ও বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী। এই ঘটনার পরই পাল্টে যায় রাজনীতির দৃশ্যপট। মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে লাখো লোকের মহাসমাবেশ শূন্য হয়ে যায়। অবশ্য পুলিশের টিয়ারশেল, কাঁদানে গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেডের সামনে টিকতে না পেরে নেতাকর্মীরা নিরাপদে চলে যান বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
জনমানবশূন্য কেন্দ্রীয় কার্যালয়
নেতারা যখন আত্মগোপনে তখন দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় একদম জনশূন্য। শনিবার পুরো এলাকায় নেমেছিল নেতাকর্মীদের ঢল। কিন্তু সেদিনকার কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে সব কিছু বদলে গেছে। তালাবদ্ধ রয়েছে কার্যালয়। সোমবার (৩০ অক্টোবর) দুপুর পর্যন্ত কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে কোনো নেতাকর্মীর আনাগোনা নেই। ইতোমধ্যে পালিত হয়েছে হরতাল।
রোববার (২৯ অক্টোবর) হরতালকে কেন্দ্র করে পুলিশের পাশাপাশি র্যাব-বিজিবির টহল ছিল নয়াপল্টন এলাকায়। তবে সোমবারের চিত্র কিছুটা ভিন্ন। পুলিশের উপস্থিতি কিছুটা কম। তবে বাহিনীর সদস্যরা বেশ তৎপর। সন্দেহভাজন কাউকে দেখলে পড়তে হচ্ছে পুলিশের প্রশ্নের মুখে।
এর আগে শনিবার রাতেই তালাবদ্ধ কার্যালয়ের সামনের অংশ ক্রাইম সিন হিসেবে চিহ্নিত করে তা ফিতা দিয়ে আটকে দেয় সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিট। সেখান থেকে দশ ধরনের আলামত সংগ্রহ করে নিয়েছে সিইআইডি। আলামত ল্যাবে পরীক্ষা করে দেখা হবে বলে জানিয়েছেন ডিআইডির কর্মকর্তারা।
নেতাদের বাসায় বাসায় পুলিশের হানা
এদিকে সংঘর্ষের ঘটনায় বিএনপির শীর্ষ নেতাদের বাসায় বাসায় তল্লাশি চালিয়েছে পুলিশ। রোববার (২৯ অক্টোবর) সকাল সাড়ে ৯টায় গুলশানের বাসভবন থেকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে। পরে রাতে তাকে রমনা থানার মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে হাজির করা হয়। বিচারক তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
রোববার ভোর ৪টায় দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের শাহজাহানপুরের বাসা ঘিরে ফেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ভোর ৬টার সময় তার বাসার ভেতর অভিযান চালালেও তাকে পাওয়া যায়নি। পরে আবার বিকেলের দিকেও তার বাসায় অভিযানে যায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবে তখনও তাকে পায়নি।
আরও পড়ুন: ২৮ অক্টোবরের ঘটনায় ৩৬ মামলা, আসামি ১৫৪৪
মির্জা আব্বাসের খোঁজে সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে বারবার বাসায় যাওয়া হচ্ছে জানিয়ে ‘নিরাপত্তাহীনতায়’ ভোগার কথা জানার তার স্ত্রী আফরোজা আব্বাস। মহিলা দলের সভানেত্রী আফরোজা আব্বাস বলেন, ‘মহাসমাবেশের দিন সকাল বেলায় মির্জা আব্বাস বাসা থেকে যে গিয়েছে, এরপর তো আর আসেনি।'
একই দিনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর বনানীর বাসায় অভিযান চালানো হয়েছে। এ সময় তিনি বাসায় না থাকায় তাকে আটক করতে পারেনি পুলিশ।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের ছেলের লালমাটিয়ার বাসায় সকালে তল্লাশি চালায় ডিবি পুলিশ। এ সময় আলালকে না পেয়ে বাসার প্রতিটি রুম তল্লাশি চালানো হয়। এরপর দুপুর পৌনে ১২টার দিকে তার বনানীর বাসায় যায় গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্যরা। দুপুর ১২টার দিকে সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল জানান, লালমাটিয়ার পর এখন তার বনানীর বাসায় ১৪/১৫ জন ডিবি পুলিশ তল্লাশি চালাচ্ছেন। প্রতিটি রুম তছনছ করা হচ্ছে।
আরও পড়ুন: ‘উদ্বেগের’ হরতাল কড়া প্রহরায় শেষ
এছাড়া ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আহ্বায়ক আব্দুস সালামের শান্তিনগরের বাসভবন, ঢাকা মহানগর উত্তরের সদস্য সচিব আমিনুল হকের পল্লবীর বাসভবন এবং যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর বাসভবনে অভিযান চালানো হয়েছে।
পুলিশ অভিযান চালিয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও অবিভক্ত ঢাকার মেয়র সাদেক হোসেন খোকার ছেলে ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেনের গুলশানের বাসভবনে। বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক কমিটির এই সদস্যের বাসায় অভিযান চালিয়েছে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ। ইশরাককে না পেয়ে তার ছোট ভাই ইশফাককে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে আদালত তার পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
বিএনপির কেন্দ্রীয় একজন ভাইস চেয়ারম্যান নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘পুলিশের একজন মারা যাওয়ায় তারা বেপরোয়া। সুযোগ পেলে সবাইকে ধরে নেবে। যে কারণে গ্রেফতার এড়ানোর কৌশলের বিকল্প কিছু নেই।’ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে কয়েক দিন সময় লাগতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
বিইউ/জেবি

