# সন্দেহের তীর রাঙা-কাজী মামুনদের দিকে
# দল কনফার্ম হয়ে গেছে কারা বিজ্ঞপ্তির সঙ্গে জড়িত: সেন্টু
# এমন ঘটনা ভোটের আগে আরও ঘটার আশঙ্কা নেতাদের
# জড়িতদের শাস্তি দেওয়ার কথা বললেন জিএম কাদের
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে মাঠে সক্রিয় বিএনপি। অন্যদিকে শোকের মাসে নানা কর্মসূচি পালনে ব্যস্ত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও। কিন্তু কোনো কিছুতে না থেকেও হঠাৎ রাজনীতির ভেতরে-বাইরে সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টিকে নিয়ে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা।
গত মঙ্গলবার (২২ আগস্ট) দিনের প্রথম প্রহরে জাপার চেয়ারম্যান পদ নিয়ে এক বিজ্ঞপ্তিতে কেন্দ্র করে তোলপাড় শুরু হয় দলটিতে। জিএম কাদেরকে সরিয়ে রওশন এরশাদ দলের চেয়ারম্যান হয়েছেন এমন খবর প্রকাশের পর আবার নিজেই এমন বিজ্ঞপ্তিকে ‘মিথ্যা’ বলে জানান এরশাদপত্নী। এমন অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে বিরোধীদলীয় নেতা ও জাপার প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদের নামে ‘ভুয়া’ বিজ্ঞপ্তি তাহলে পাঠাল কে?
জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুসহ অন্য নেতারা বলছেন, দল থেকে বহিষ্কার হওয়া নেতারা রওশন এরশাদের নাম ব্যবহার করে এসব করছেন। তবে স্পষ্ট করে নাম না বললেও তারা একাধিক নেতার দিকে ইঙ্গিত করছেন। একইসঙ্গে কারা এই বিজ্ঞপ্তি তৈরি করেছে, গণমাধ্যমে কারা সরবরাহ করেছে তাদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে বলেও জানান জাপা নেতারা।
বিজ্ঞাপন
অন্যদিকে ভারত থেকে দেশে ফিরে জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেছেন, যারা এর সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কী ছিল সেই বিজ্ঞপ্তিতে?
গত মঙ্গলবার জাপার প্যাডে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, দশম জাতীয় কাউন্সিলকে সামনে রেখে পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নিলেন জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা ও পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক বেগম রওশন এরশাদ। জাতীয় পার্টির সংখ্যাগরিষ্ঠ কো-চেয়ারম্যানদের পূর্বে নেওয়া সিদ্ধান্ত মঙ্গলবার সকালে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করেন পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক বেগম রওশন এরশাদ। সে অনুযায়ী আসন্ন দশম জাতীয় সম্মেলন পর্যন্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন তিনি।
আরও পড়ুন: জিএম কাদেরকে সরিয়ে নিজেকে জাপা চেয়ারম্যান ঘোষণা রওশনের
সংবাদ বিজ্ঞপ্তির পাশাপাশি ২০২২ সালের একটি রেজ্যুলেশনের কপিও পাঠানো হয়। এতে উল্লেখ করা হয়, এর আগে জাতীয় পার্টির অধিকাংশ প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সংসদ সদস্যের মতামত এবং চারজন কো-চেয়ারম্যানের উপস্থিতিতে পার্টির চলমান ক্রান্তিকাল মোকাবিলায় দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদকে চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি, নানা ধরনের মামলা মোকদ্দমা এবং দল পরিচালনায় অযোগ্যতা ও অসাংগঠনিক আচরণের কারণে জাতীয় পার্টির বর্তমান চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ (জিএম) কাদেরকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
নিজের চেয়ারম্যান হওয়ার খবর নিয়ে রাজনীতিতে যখন তোলপাড় শুরু হয় তখন রওশন এরশাদ বিষয়টি নিয়ে একাধিক গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন। এরশাদপত্নী বলেন, ‘সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির চেয়ারম্যান আমি। সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিটি পাঠানোর কথা ছিল আমার। কিন্তু ভুলবশত দলের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের চিঠি গণমাধ্যমে চলে গেছে। আমি পার্টির চেয়ারম্যান নই। এটা ভুল হয়েছে।’
জাপার প্যাডে বিজ্ঞপ্তি পাঠাল কারা?
জাপা চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদের মৃত্যুর পর থেকে দলের মধ্যে নানা সমস্যা তৈরি হয়। কখনো চেয়ারম্যানের পদ নিয়ে রওশন এরশাদ এবং জিএম কাদেরের মধ্যে। আবার কখনো এরশাদের গড়া ট্রাস্ট নিয়ে বিদিশা এরশাদ, কখনো কাজী মামুনুর রশিদের মধ্যে।
এরশাদের জীবদ্দশায় কাজী মামুনুর রশীদ দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য থাকলেও জিএম কাদের দায়িত্ব নেওয়ার পর তাকে বাদ দেওয়া হয়। তবে গতবছরের জুনে তাকে রওশন এরশাদ মুখপাত্র হিসেবে মনোনীত করেন। বিজ্ঞপ্তি পাঠানোর বিষয়ে এরশাদ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান কাজী মামুনের দিকেও ইঙ্গিত করছেন জাপার একাধিক নেতা।
রওশন এরশাদ ও তার মুখপাত্র কাজী মামুনূর রশিদের পক্ষে বেশ কিছুদিন ধরে নানা সময়ে বিবৃতি দেওয়ার হোয়াটসআপ গ্রুপ ‘প্রেস নোট (জাপা)’ থেকে মঙ্গলবারের বিজ্ঞপ্তিটি দেওয়া হয়। দ্রুত খবরটি প্রকাশের জন্য সাংবাদিকদের প্রতি অনুরোধও জানানো হয়।
বিজ্ঞপ্তি পাঠানোর প্রক্রিয়ায় যুক্ত একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘অনুমোদন ছাড়া কোনো বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয় না। ভুল থাকলে যারা তৈরি করেছেন সেটা তাদের বিষয়।’
অন্যদিকে বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার পেছনে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্যসহ সকল পদ পদবি থেকে বহিষ্কার হওয়া মশিউর রহমান রাঙ্গার দিকেও কেউ কেউ ইঙ্গিত করছেন।
আরও পড়ুন: রওশনের চেয়ারম্যান হওয়ার খবর ভুয়া, দাবি জাপা মহাসচিব চুন্নুর
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে মশিউর রহমান রাঙ্গার মোবাইল, হোয়াটসআপে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেন। অন্যদিকে কাজী মামুনের ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
আবার কেউ কেউ বলছেন জাপার মূল ধারায় শক্ত অবস্থান তৈরি করতে চেষ্টা করছেন রওশন এরশাদের রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ। গোলাম মসীহ ও কাজী মামুনুর রশীদ সম্প্রতি রওশন এরশাদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতেও উপস্থিত ছিলেন। বিজ্ঞপ্তি পাঠানোর ইস্যুতে গোলাম মসীহ থাকতে পারেন বলেও জাপার কেন্দ্রীয় নেতাদের কেউ কেউ মনে করছেন।
দলের একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমরা কনফার্ম হয়ে গেছি কারা এটা করছে। নাম বলছি না। তবে নানা সময় অপকর্ম করে যারা দল থেকে বহিষ্কার হয়েছে, দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে তারাই আবার এটা শুরু করেছে। এদের আপনারা সবাই চেনেন।’
তবে গোলাম মসীহ’র দাবি, তিনিও বিষয়টি জানেন না। বরং মঙ্গলবার খবর প্রকাশের পর বিষয়টি নিয়ে রওশন এরশাদের সঙ্গে কথা বলেছেন বলে জানান। কারা এমনটা করেছে তাকে খুঁজে বের করতে নির্দেশনাও দিয়েছেন।
কারা এমন কাজ করেছে কিছু জানতে পেরেছেন কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে গোলাম মসীহ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘দলের কিছু অতি উৎসাহী লোক থাকে না? তারা হয়ত করেছে। আমরা চেষ্টা করছি এটা বের করতে।’
জাপা নেতাদের ভাষ্য
দলটির একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলের ভেতরে ভাঙন ধরানোর চেষ্টা হতে পারে। এই চিঠির মধ্য দিয়ে সেই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ভোটের আগে এমন ঘটনা আরও ঘটতে পারে বলে আশঙ্কাও আছে কারও কারও মধ্যে।
সেক্ষেত্রে কী করবে জাতীয় পার্টি- এমন প্রশ্নের জবাবে দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য শফিকুল ইসলাম সেন্টু ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘দলের চেয়ারম্যান দেশে আসছেন। যারা এমন বিবৃতকর পরিস্থিতি তৈরি করছে, সামনের দিনগুলোতে তারা যেন আর এমনটা করতে না পারে সেজন্য দলীয় সিদ্ধান্ত আসবে।’
আরও পড়ুন: রওশনের চেয়ারম্যান দাবি নিয়ে মুখ খুললেন জি এম কাদের
আরেক প্রেসিডিয়াম সদস্য সাহিদুর রহমান টেপা ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘যেহেতু রওশন এরশাদ বিরোধী দলীয় নেতা তার দফতর আছে, চিঠি পাঠানোর লোক আছে। সেখানে হঠাৎ কেন এমন বিজ্ঞপ্তি এসেছে সেটা তার দফতরের পক্ষ থেকে খুঁজে বের করা উচিত। তবে যারা দল থেকে বিভিন্ন সময় বহিষ্কার হয়েছে তাদের কেউ এমনটা করতে পারে।’
এদিকে ভারত সফর শেষে দেশে ফিরে এ বিষয়ে কথা বলেছেন জি এম কাদের। ভাবি রওশন এরশাদকে মায়ের মতো শ্রদ্ধা করেন জানিয়ে তিনি বলেছেন, ‘ভাবির অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন কাগজপত্রে সই করাচ্ছে। তার থেকে বক্তব্য নেওয়া হচ্ছে। আমার জানামতে তিনি নিজের ইচ্ছায় এগুলো দিচ্ছেন না। এটা করার উদ্দেশ্য, জাতীয় পার্টিকে দুর্বল করা। তার সঙ্গে আমার কখনোই কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না। এখনও নেই।’
বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দেন জাপা চেয়ারম্যান।
বিইউ/এমআর