শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

হজের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা জরুরি

আহসান হাবিব
প্রকাশিত: ২৯ মে ২০২৩, ০৯:০২ পিএম

শেয়ার করুন:

হজের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা জরুরি

হজ মুসলিমদের পবিত্র ইবাদত। হজ ইসলামের পাঁচটি আরকান বা স্তম্ভের পঞ্চমটি। শরিয়তের পরিভাষায় নির্দিষ্ট মাসের নির্দিষ্ট সময়কালে কা’বা ঘর প্রদক্ষিণ, আরাফাত ময়দানে অবস্থান, সাফা ও মারওয়ার মধ্যবর্তী স্থানে গমনাগমন, মিনায় অবস্থান প্রভৃতি কার্য হযরত মুহম্মদ (স.) কর্তৃক নির্ধারিত প্রক্রিয়ায় সম্পাদন করা। পবিত্র কুরআনে বর্ণনা করা হয়েছে, পৃথিবীতে আল্লাহ-তায়ালার ইবাদতের জন্য নির্মিত প্রথম ইমারত হচ্ছে মক্কার পবিত্র কা’বা ঘর, যা ‘বায়তুল্লাহ’ বা ‘আল্লাহর ঘর’ নামে পরিচিত। আল্লাহ হযরত ইব্রাহিমকে (আ.) আদেশ দেন, ‘আমার গৃহকে পবিত্র রেখো তাদের জন্য যারা তাওয়াফ করে এবং যারা সালাতে দাঁড়ায়, রুকু করে ও সিজদা করে এবং মানুষের নিকট হজের ঘোষণা করে দাও, ওরা তোমার নিকট আসবে সর্বপ্রকার দ্রুতগামী উটের পৃষ্ঠে। তারা আসবে দূর-দূরান্তরের পথ অতিক্রম করে।’ এই আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে হযরত ইব্রাহিম (আ.) সর্বপ্রথম কা’বাকে কেন্দ্র করে হজের প্রবর্তন করেন।

হজ মুসলমানদের জন্য ফরজ। শরিয়ত অনুযায়ী নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রত্যেক মুসলমানের জন্য জীবনে অন্তত একবার হজ করা কর্তব্য, যদি তার পক্ষে সম্ভব হয়। হজ পালনের শর্ত হলোÑ প্রাপ্ত বয়স, শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা, আর্থিক সচ্ছলতা, পথের নিরাপত্তা এবং ফিরে আসা পর্যন্ত পরিবারের সদস্যদের ভরণ-পোষণের নিশ্চয়তা।


বিজ্ঞাপন


কুরআনে উল্লেখ আছে যে, ইব্রাহিম (আ.)-এর স্ত্রী হাজেরা ও তার পুত্র ইসমাইলকে মক্কার মরুভূমিতে একা রেখে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। পানির পিপাসায় তৃষ্ণার্ত হয়ে পানির সন্ধানে একদিন হাজেরা মরিয়া হয়ে সাফা ও মারওয়ার দুটি পাহাড়ের মধ্যে সাতবার দৌড়ে কিছুই পেলেন না। হতাশায় ফিরে ইসমাইলের দিকে এসে দেখতে পেলেন যে, শিশুটি তার পা দিয়ে মাটিতে আঘাত করছে এবং তার পায়ের নিচে একটি পানির ঝর্ণা প্রবাহিত হচ্ছে। পরে আল্লাহতাআলা ইব্রাহিমকে কা’বা তৈরি করার এবং লোকদের সেখানে হজ আমন্ত্রণ করার আহ্বান জানান। আর এই পবিত্র হজকে নিয়ে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী বাণিজ্য করছে। মানুষকে ঠকিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।

Hajjনির্ধারিত কোটা খালি রেখে হজ ফ্লাইট ২১ মে থেকে শুরু হয়। এর দুদিন আগে ১৯ মে প্রধানমন্ত্রী হজ কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। হজের নিবন্ধন করেও হজ অব্যবস্থাপনায় ৬৭৩ জন ব্যক্তি নিবন্ধন বাতিলের আবেদন করেছেন। কেন বা কোন কারণে তারা নিবন্ধন বাতিলের আবেদন করেছেন তা জানে না ধর্ম মন্ত্রণালয়। পবিত্র ইবাদতটিকে কোথায় এনে ঠেকানো হয়েছে? অথচ সরকারি মহল থেকে এটিকে কোনো ঘটনাই মনে করা হচ্ছে না। ধর্ম প্রতিমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন, হজের খরচ কমানোর সুযোগ নেই। যা বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে।

চলতি বছর বাংলাদেশ থেকে ১ লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জনের হজে যাওয়ার জন্য সৌদির সঙ্গে চুক্তি হয়। তবে ৯ দফা সময় বাড়িয়েও নির্ধারিত হজ কোটা পূরণ না হওয়ায় ৫ হাজার কোটা ফেরত যেতে বাধ্য হয়েছে। এবার হজ যাত্রীদের সঙ্গে গাইড হিসেবে যাবেন ২ হাজার ৭১৫ জন। হজ যাত্রী ও গাইডসহ হয়েছে মোট ১ লাখ ২২ হাজার ২০১ জন। সে হিসাবে এখনো কোটায় ফাঁকা থাকছে ৪ হাজার ৯৯৭ জন। খরচ অনেক বেড়ে যাওয়ায় এবার নয় দফা সময় বাড়িয়েও হজের কোটা পূরণ না হওয়ার কারণ বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ।

অন্যান্য বছর সরকারিভাবে প্যাকেজ ঘোষণা করা হতো দুটি। এতে অপেক্ষাকৃত কম দামি প্যাকেজের সঙ্গে সংগতি রেখে হজ প্যাকেজ ঘোষণা করে বেসরকারি হজ এজেন্সিগুলো। অন্তত লাখখানেক টাকা কমে হজে যাওয়ার সুযোগ হতো। এবার সে ব্যবস্থাও নেই। এমন অব্যবস্থাপনা কোনো মতেই কাম্য হতে পারে না। শুধু তাই নয়, হজ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমের মূল নেতৃত্বে থাকা শীর্ষ কর্তাদের হজ-সংক্রান্ত কর্মকাণ্ডে তেমন অভিজ্ঞতা নেই। হজের মতো পবিত্র ইবাদতকে ব্যবসায় পরিণত করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন একটি কুচক্রীমহল। কোনো না কোনোভাবে তারাই লাভবান হচ্ছেন।


বিজ্ঞাপন


>> আরও পড়ুন: হজ ফরজ হওয়ার শর্ত, গুরুত্ব ও ফজিলত

হজ ফ্লাইটের প্রথম দিনেই সৌদি আরব যেতে পারেননি ১৪০ হজযাত্রী। ২১ তারিখ রবিবার দুপুর ২টা ২০ মিনিটে বাংলাদেশ বিমানের বিজি-৩৩১ নম্বর ফ্লাইটে তাদের সৌদি যাওয়ার কথা ছিল। তবে ভিসা না হওয়ায় তারা যেতে পারেননি। তারা আশকোনা হজ ক্যাম্পে অবস্থান করছেন। জান্নাত ট্রাভেলস নামের একটি হজ এজেন্সির মাধ্যমে তাদের সৌদি যাওয়ার কথা ছিল। অনেকেই শুক্র ও শনিবার আশকোনা হজ ক্যাম্পে এসেছেন। নির্ধারিত ফ্লাইটে যেতে না পেরে হজযাত্রীদের আক্ষেপের শেষ নেই। এক হজযাত্রী আক্ষেপ করে বলেন, আমাদের পাসপোর্ট এজেন্সির কাছে। তাদের সব টাকা-পয়সা বুঝিয়ে দিয়েছি। তারাই সবকিছু ব্যবস্থা করে রাখবে বলে জানিয়েছে। সেই প্রস্তুতি নিয়ে আমরা বাড়ি থেকে হজ ক্যাম্পে আসি। কিন্তু এসে দেখি আমাদের ভিসা হয়নি।

হজ একটি বড় রকমের ইবাদত। এই ধরনের একটি বিষয়ের ওপর কারো নজর থাকবে না- এটা কোনো যুক্তিতেই গ্রহণযোগ্য নয়। হজ এজেন্সির অধিকাংশ মালিক এখন নীতি-নৈতিকতার কিছুই মানছে না। এ ক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মনিটরিং ঠিকমতো থাকলে অজস্র হজযাত্রীকে বিড়ম্বনায় পড়তে হতো না। বিশ্বের অন্য কোনো দেশে হজ নিয়ে এত ব্যবসা হয় বলে জানা নেই। দিনের পর দিন এ ধরনের একটি অব্যবস্থা টিকে থাকে কিভাবে আমাদের বোধগম্য নয়। হজ প্রার্থীরা বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের খরচের তফাৎ জানেন না এমনও নয়। জনসংখ্যা বিচারে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়া। এই দেশের হজযাত্রীদের খরচ অনেক কম। জনপ্রতি ২ লাখ ৩৮ হাজার ৪৫৩ টাকার বেশি নয়। হজযাত্রায় আরও টাকা লাগলে তা দেশটির সরকারের ‘হজ ফান্ড ম্যানেজমেন্ট এজেন্সি’ থেকে ভর্তুকি দেওয়া হয়। মালয়েশিয়া থেকে হজে যেতে সর্বনিম্ন ২ লাখ ১৮ হাজার ৭৫৪ টাকা ও সর্বোচ্চ ২ লাখ ৫৮ হাজার ৬০০ টাকা দিতে হয়। প্রতিবছর হজে মালয়েশিয়া সরকার ৬০০ থেকে ৮০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়। প্রতিবেশী ভারতে হজে ভর্তুকি বন্ধ করে দেওয়া হলেও খরচ আমাদের মতো নয়। কিন্তু বাংলাদেশের বেলায় তার উল্টো। এসব নিয়ে প্রতিবছরই কথা হয়। কিন্তু ব্যাপারটা দাঁড়ায় এমন যে, কারো পছন্দ না হলে বা সামর্থ্যে না কুলালে যাবেন না- কর্তৃপক্ষের আচরণে এমনটাই মনে হয়। এ ধরনের আচরণ কোনোমতেই কাঙ্ক্ষিত নয়।

Hajjধর্ম মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যানুসারে, ২০১৫ সালে হজের জন্য সর্বনিম্ন খরচ ছিল ২ লাখ ৯৬ হাজার ২০৬ টাকা। ২০১৬ সালে ৩ লাখ ৪ হাজার টাকা। ২০১৭ সালে সর্বনিম্ন প্যাকেজ ছিল ৩ লাখ ১৯ হাজার টাকার। ২০১৮ সালে ছিল ৩ লাখ ৩১ হাজার টাকা। ২০১৯ সালে ৩ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। করোনা মহামারির কারণে ২০২০, ২০২১ সালে বাংলাদেশ থেকে হজে যাওয়া পুরোপুরি বন্ধ ছিল। ২০২২ সালে সীমিত পরিসরে হজে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে। সর্বনিম্ন খরচ ধরা হয়েছিল ৪ লাখ ৫৬ হাজার। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হিসাব বিবেচনায় নিলে, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে হজের ব্যয় বেড়েছে ৩ লাখ ২৭ হাজার টাকা। আর গত বছরের তুলনায় ২ লাখ ১৬ হাজার টাকা। অথচ এবার সৌদি সরকার হজে আনুষঙ্গিক ব্যয় কমিয়েছে। মোয়াল্লেমের খরচ কমিয়েছে। বাসা ভাড়া কমিয়েছে। এ ছাড়া হজের সময় সৌদি সরকার নানা ধরনের সুবিধা বিনামূল্যে প্রদান করেন। মক্কা থেকে আরাফাহ, মিনা, মুজদালিফায় যাতায়াতের জন্য বিনামূল্যে পরিবহন ব্যবস্থা থাকে। সরকারের পাশাপাশি সৌদি আরবের বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও কোম্পানি বিনামূল্যে পরিবহন সুবিধা দিয়ে থাকে। অথচ হজ ব্যবসায়ীরা এ তথ্যগুলো আলোচনায় আনেন না।

দীর্ঘদিন থেকেই অনেক এজেন্সি হজের সময় মক্কা-মদিনায় আবাসন ব্যবসা করে আসছে। হজের টাকা হাতানোর প্রবণতায় অনেকে ঝুঁকেছেন এ ব্যবসায়। কিন্তু আমাদের দেশের সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ এ বিষয়টিকে আমলে নিচ্ছে না।

>> আরও পড়ুন: মধ্যবিত্তের জন্য ‘হজ’ এখন আরও কঠিন

দেশের একাধিক গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে, ব্যাংকের বুথ থেকে অতিরিক্ত অর্থ তোলার অভিযোগে সৌদি আরবের মক্কায় বাংলাদেশের তিনটি হজ এজেন্সির দুজন মালিককে গ্রেপ্তার করেছে সৌদি পুলিশ। এ ধরনের ঘটনা দেশের জন্য কতটা লজ্জার তা ভেবে কিনারা করা যায়? হজ ফ্লাইটের প্রথম দিন ভিসা জটিলতায় ও হজ এজেন্সির অবহেলায় ১৪০ জন হজযাত্রী নির্ধারিত ফ্লাইটে হজে যেতে পারেননি। এদিকে নতুন করে এ ঘটনায় তিন এজেন্সির অধীনে ৮২৩ জন হজযাত্রী পড়েছেন অনিশ্চয়তায়। তারা কি আদৌ হজ পালন করতে পারবেন। এ বিষয়ে সরকারি মহলই ভালো বলতে পারবে। অবশ্য শেষ পর্যন্ত হাবের মধ্যস্থতায় তারা হজে যেতে পারবেন বলে আশ্বাস পাওয়া গেছে।

সরকার হাজিদের সুষ্ঠুভাবে হজ পালনের জন্য প্রতিবছর সতর্কতা অবলম্বনসহ নানা পদক্ষেপ নিলেও অসাধু কিছু এজেন্সি তাদের দুর্নীতি ও অনিয়মের ধারাবাহিকতা ঠিকই ধরে রেখেছে। যারা আগামীতে হজ করতে যাবেন কিংবা হজে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তাদেরকে আরও সতর্ক হতে হবে। সরকারি সংশ্লিষ্ট মহল যারা হজ মিশনসহ হজের কার্যক্রম পরিচালনা করেন, তারা সতর্ক না হলে প্রতিবছর হজযাত্রীরা একই ভোগান্তি নিয়ে হজ করবেন। এটা কি কোনো জবাবদিহিতার মধ্যে পড়ে না? এ বিষয়টি আমলে নেয়া একান্ত জরুরি। দেশের সব জায়গা যদি অসাধুদের দখলে চলে যায় তাহলে মানুষ যাবে কোথায়? হজযাত্রীরা যাতে করে সুষ্ঠুভাবে হজে যেতে পারেন এবং হাজিরা সুষ্ঠুভাবে হজ করে দেশে ফিরতে পারেন সে ব্যাপারে যথাযথ উদ্যোগ নিলে হজযাত্রীরা সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে হজ করতে পারবে, এটা করতে এত সংকট কেন?

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

/জেএম

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর