বৃহস্পতিবার, ২ মে, ২০২৪, ঢাকা

মধ্যবিত্তের জন্য ‘হজ’ এখন আরও কঠিন

মুহা. তারিক আবেদীন ইমন
প্রকাশিত: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১০:১৮ এএম

শেয়ার করুন:

মধ্যবিত্তের জন্য ‘হজ’ এখন আরও কঠিন

প্রত্যেক সামর্থ্যবান মুসলমানের জন্য জীবনে একবার হজ করা ফরজ। আর্থিক সামর্থ্য না থাকলে হজের বাধ্যবাধকতা নেই। তারপরও প্রত্যেক মুসলমানের স্বপ্ন থাকে জীবনে অন্তত একবার পবিত্র মক্কায় গিয়ে হজ পালন করার।

এক সময় আমাদের দেশের ধনীদের পাশাপাশি মধ্যবিত্তরাও তিল তিল করে জমানো সঞ্চয় দিয়ে এই ফরজ ইবাদত ও স্বপ্ন পূরণ করতেন। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে হজ পালনের খরচ ততই বাড়ছে।


বিজ্ঞাপন


গত ৭ বছরে হজের খরচ বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। এরমধ্যে চলতি বছরই হজের খরচ বেড়েছে ১ লাখ ৬১ হাজার ৮৬৮ টাকা বেড়েছে। সবমিলে চলতি বছর সরকারিভাবে হজ করতে একজনের ব্যয় হবে ৬ লাখ ৮৩ হাজার ১৮ টাকা। অন্যদিকে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় কোরবানি ছাড়া হজের প্যাকেজ মূল্য ৬ লাখ ৭২ হাজার ৬১৮ টাকা নির্ধারণ করেছে হজ এজেন্সিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (হাব)।

অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে নিয়ত করেও হজ করার সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে আসছেন অনেকে। মধ্যবিত্তের জন্য আরও কঠিনে হয়ে পড়ছে হজ পালনের স্বপ্ন পূরণ।

hajj

গত ১ ফেব্রুয়ারি চলতি বছরের হজ প্যাকেজ ঘোষণা করে ধর্ম মন্ত্রণালয়। ঘোষণা অনুযায়ী, সরকারি ব্যবস্থাপনায় এবার হজ করতে জনপ্রতি খরচ হবে ছয় লাখ ৮৩ হাজার ১৮ টাকা। প্রতি বছর দুটি প্যাকেজ থাকলেও এবার একটি প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়।


বিজ্ঞাপন


ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক খান জানান, গত ৯ জানুয়ারি সৌদি সরকার ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক হজ চুক্তি সই হয়। চুক্তি অনুযায়ী এ বছর এক লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জন হজ পালনের সুযোগ পাবেন। এর মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ১৫ হাজার জন এবং বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় এক লাখ ১২ হাজার ১৯৮ জন হজ পালন করতে পারবেন। শাহজালাল বিমানবন্দর দিয়ে সৌদি আরবে গমনেচ্ছু শতভাগ হজযাত্রীর প্রি-অ্যারাইভাল ইমিগ্রেশন মক্কা রোড চুক্তি অনুযায়ী বিমানবন্দরেই হবে।

করোনা মহামারির কারণে ২০২২ সালে সৌদি নিষেধাজ্ঞার ফলে হজযাত্রীর সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছিল ৬০ হাজার ১৪৬ জনে। সে তুলনায় এবার অনেকে হজে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন।

গত ৭ বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, হজের ব্যয় বেড়েছে প্রতি বছরই। সরকারিভাবে চলতি বছরের একমাত্র প্যাকেজে খরচ ৬ লাখ ৮৩ হাজার ১৮ টাকা। ২০২২ সালে সরকারিভাবে হজে যেতে প্যাকেজ-১ এ ৫ লাখ ২৭ হাজার ৩৪০ এবং প্যাকেজ-২ এ ৪ লাখ ৬২ হাজার ১৫০ টাকা খরচ ধরা হয়। ২০১৯ সালে প্যাকেজ-১ এ খরচ ৪ লাখ ১৮ হাজার ৫০০ টাকা এবং প্যাকেজ-২-এ ৩ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। ২০১৮ সালে প্যাকেজ-১ ছিল ৩ লাখ ৯৭ হাজার ৯২৯ টাকা। প্যাকেজ-২-এ ৩ লাখ ১৯ হাজার ৩৫৫ টাকা। ২০১৭ সালে প্যাকেজ-১ ছিল ৩ লাখ ৮১ হাজার ৫০৮ টাকা, প্যাকেজ-২-এ ৩ লাখ ১৯ হাজার ৩৫৫ টাকা। ২০১৬ সালে প্যাকেজ ১-এ ৩ লাখ ৬০ হাজার ২৮ টাকা। ২০১৫ সালে প্যাকেজ ১-এ ছিল ৩ লাখ ৫৪ হাজার ৭৪৫ টাকা, প্যাকেজ ২-এ ২ লাখ ৯৬ হাজার ২০৬ টাকা।

সে হিসেবে ২০১৫ সালের থেকে চলতি বছর পর্যন্ত হজের খরচ বেড়েছে ৩ লাখ ২৮ হাজার ২৭৩ টাকা। অর্থাৎ ৭ বছরে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। শুধু এ বছরই খরচ বেড়েছে দেড় লাখ টাকার বেশি।

হজের খরচ বৃদ্ধি বিষয়ে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (হজ) মহিতুল ইসলাম বলেন, রিয়ালের বিনিময় হার বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে এবার হজ প্যাকেজের মূল্য বেড়েছে। সৌদি সরকার হজের ব্যয় এবার কমিয়েছে। মিনার তাঁবু ভাড়া কমিয়েছে। শুধু জমজম পানির দাম ১২ রিয়ালের স্থলে এবার ৩ রিয়াল বাড়িয়ে ১৫ রিয়াল করেছে। ২০২২ সালে রোড টু মক্কা ইনিশিয়েটিভের অধীনে হাজীদের ল্যাগেজ পরিবহনে ব্যয় ধরা হয়নি। এবার হাজীদের ল্যাগেজ পরিবহনে ২০ দশমিক ৭০ রিয়াল ব্যয় ধরা হয়েছে।

hajj

হজযাত্রীদের বিমান ভাড়া বৃদ্ধির বিষয়ে তিনি বলেন, বিমান ভাড়ার বিষয়টি আমাদের এখতিয়ারের বাইরে। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় হাজীদের বিমান ভাড়া নির্ধারণ করে। সেখানে আমাদের করার কিছু থাকে না। ২০২২ সালের হজ প্যাকেজে রিয়ালের বিনিময় হার ধরা হয়েছিল ২৪ টাকা ৩০ পয়সা। এবার হজ প্যাকেজে রিয়ালের বিনিময় হার ধরা হয়েছে ২৮ টাকা ৩৯ পয়সা। এতে গতবারের তুলনায় বেড়েছে প্রায় ৬৪ হাজার টাকা।

এসব কারণে হজের প্রাক-নিবন্ধন করেও অনেকেই এবার হজে যাওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে আসছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রাক-নিবন্ধন করা কয়েকজন জানান, এক বছর আগে থেকেই হজ করতে যাওয়ার অনেক ইচ্ছা ছিল তাদের। কিন্তু এত টাকা খরচ সামর্থ্যের বাইরে চলে গেছে। তাই নিবন্ধন করেও হজে যাচ্ছেন না তারা।

শরীয়তপুর থেকে রাজধানীর পুরানা পল্টনের একটি হজ এজেন্সিতে আসা একজন বলেন, এখান থেকেই হজের জন্য প্রাক-নিবন্ধন করেছিলাম। কিন্তু প্যাকেজের দাম বাড়ায় যেতে পারছি না। তাই ওমরাহ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

এ বিষয়ে আবাবিল হজ গ্রুপের চেয়ারম্যন আবু ইউসুফ ঢাকা মেইলকে বলেন, খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় এবার অনেকেই দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে আছেন। অনেকেই না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। হজে না গিয়ে ওমরায় যাওয়ার চিন্তাভাবনা করছেন। অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশের বিমান ভাড়া বেশি বৃদ্ধি করা হয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ ভাড়া। সরকার যদি বিষয়টা বিবেচনা করে খরচ কিছুটা কমিয়ে দেয় তবে অনেকেই হজে যাওয়ার আগ্রহ ফিরে পাবে।

এদিকে হজের বিমান ভাড়া কমিয়ে প্যাকেজ আরও সহনীয় পর্যায়ে আনতে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছে এয়ার টিকিট বিক্রেতা ট্রাভেল এজেন্সিরা। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ট্রাভেল এজেন্সিদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশের (আটাব) এ চিঠি দেয়।

চিঠিতে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে হজের ব্যয় বেড়েছে ৩ লাখ ৩৮ হাজার ১৫ টাকা। এ বছর সৌদি সরকার হজের আনুষঙ্গিক ব্যয় কমিয়েছে। ২০১৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৬ বছরে হজ যাত্রীদের বিমান ভাড়া ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ২০২৩ সালে বিমান ভাড়া প্রায় ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে। সৌদি রিয়ালের বর্তমান মূল্য হিসাব করে সৌদি আরবের খরচ নির্ধারণ করা হলেও হজের সময় রিয়ালের মূল্য বৃদ্ধি পাবে বলে সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া সারাবিশ্বে আর্থিক মন্দার কারণে যে ডলার সঙ্কট বিরাজ করছে তাতে হজ যাত্রীদের আর্থিক চাপ আরও বৃদ্ধি পাবে এবং ভবিষ্যতে এ ধারা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশ থেকে হাজীরা হজ করতে যাওয়ার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলবেন।

এ বিষয়ে আটাব সভাপতি এস এন মঞ্জুর মোর্শেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, হজের খরচ বেশি হওয়ায় অনেকে নিয়ত করেও হজে যেতে পারছেন না। তারা বলছেন হজে না গিয়ে ওমরায় যাবেন। এবার যে পরিমাণ মানুষের হজে যাওয়ার টার্গেট করা হয়েছে তা পূর্ণ হবে কি না সংশয় রয়েছে। এ পর্যন্ত খুব কম সংখ্যক মানুষ হজের জন্য নিবন্ধন করেছেন। গত বছরে এই সময়ে কয়েকগুণ নিবন্ধন করেছিল।

তিনি আরও বলেন, আমরা হজের বিমান ভাড়া কামাতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি দিয়েছি। এখন পর্যন্ত কিছু জানানো হয় নাই। আশা করছি শিগগিরই জানাবেন আশা করছি এবং প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি বিবেচনা করবেন।

টিএই/জেএম

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর