শুক্রবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

এক চিকিৎসকের আর্তনাদ

ডা. হুমায়ুন কবীর হিমু
প্রকাশিত: ১৭ নভেম্বর ২০২২, ০২:৫৪ পিএম

শেয়ার করুন:

এক চিকিৎসকের আর্তনাদ

আমি স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেছি। এরপর এমডি নিউরোলজি সম্পন্ন করেছি। আমার ২০ বছরের যাত্রায় কী অমানুষিক পরিশ্রম না করেছি। কত রাত যে নির্ঘুম কেটেছে তার ইয়াত্তা নেই। পরিবার, সন্তান আমাকে কাছে চাইলেও পায়নি। এমডি পরীক্ষার আগের ছয় মাস আমার সন্তানের সাথে দেখা হতো কম। খুব সকালে লাইব্রেরিতে যেতাম, ফিরতাম রাত ১১টায়। কোনোদিন ছেলে সাথে দেখা হতো, কখনোওবা ও ঘুমিয়ে পড়ত। বেশিরভাগ দিনই ওর সাথে বেশিক্ষণ দেখা হতো না। বিষণ্ণ মন নিয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম। সকালে ওঠে আবার আগের দিনের রুটিন।

প্রতিদিন সকালে যখন বাসা থেকে বের হতাম কান্না করতে ইচ্ছে করত। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করত- ইস সব ছেড়ে দিয়ে যদি ছেলেটাকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যেতে পারতাম! রাতে ঘুমন্ত ছেলেটাকে বুকে নিলে মনটা কেমন যেন হালকা মনে হতো।


বিজ্ঞাপন


মাঝে মাঝে আমার রিডিং পার্টনার লিটন দাদার বাসায় পড়তে যেতাম। সারাদিন পড়াশোনা করতাম। দুপুরে খাওয়ার সময় হলে পাড়ার দোকান থেকে কিছু একটা কিনে এনে খেতাম। এগুলো কি খাওয়া যায়। খাওয়া আর কী, পেটটাকে শান্ত রাখা।

ঘুম যেন না আসে সেজন্য কফির মগে কত যে চুমুক দিয়েছি। আমার মাঝে মাঝে মাইগ্রেনের ব্যথা হতো, কিন্তু পড়া বন্ধ হতো না। ডাবল ডোজের ওষুধ খেয়ে পড়াশোনা করতাম।

এত্ত মানসিক জোর কীভাবে পেয়েছি? অনেকে অবাক হবেন। যখনই চিন্তা করতাম পাস করলেই বড় চিকিৎসক হবো। আমার চিকিৎসায় অসুস্থ রোগীরা আল্লাহর ইচ্ছায় সুস্থ হবে-ভাবতেই মনে প্রশান্তি চলে আসত। কষ্ট লাঘব হতো। সত্যি বলছি রোগীদের মুখগুলো আমাকে একটা মানসিক জোর এনে দিয়েছে।

সেই আমার, ছেলে-স্ত্রী, বাবা-মাকে প্রাপ্য হক বঞ্চিত করা লোকটির, শত রাত নির্ঘুম কাটানো মানুষটার অর্জিত সম্মান যদি কেউ বিক্রি করে দেয়, কেমন লাগবে তখন? যে রোগীদের মুখগুলো চিন্তা করে আমি মানসিক জোর পেতাম। যাদের সেবা করবো, চিকিৎসা করবো ভেবেই দিনের পর দিন নিজের ছেলেকে ঠকিয়েছি, কিন্তু এক দুর্বৃত্ত, ভণ্ড, প্রতারক তাদের সাথে প্রতারণা করে, তাহলে আমার মনের অবস্থা কেমন হয় অনুমান করা যায়?


বিজ্ঞাপন


এক প্রতারক আমার বিএমডিসি রেজিস্ট্রেশন ও আমার নাম নকল করে গত পাঁচ বছর ধরে রোগীদের সাথে প্রতারণা করে আসছে। দিনের পর দিন রোগীদের ঠকিয়েছে। আমি সত্যি অনেক ভেঙে পড়েছি। সেই রোগীদের অবস্থা কী তা ভাবতেই গা শিওরে ওঠছে।

আরও পড়ুন: চকরিয়ায় হাসপাতাল থেকে ভুয়া চিকিৎসক আটক

কী দেশে বাস করি! একজন প্রতারক রোগীদের নিয়ে যা ইচ্ছে করতে পারে। অথচ বিদেশে কত জবাবদিহিতা।

rr
অভিযুক্ত প্রতারক গ্রেফতার। ছবি: ঢাকা মেইল

আমি ধন্যবাদ দিতে চাই কক্সবাজারের চকরিয়ার স্বাস্থ্য প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনকে। তারা অনেকটা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে সেই ভণ্ড, প্রতারককে আইনের আওতায় এনেছেন। আমি খবর পেয়েছি যারা প্রতারককে আইনের আওতায় এনেছেন তাদের বেশ চাপের মধ্যে রাখা হচ্ছে। আমি খুব অবাক হচ্ছি, স্থানীয় কিছু মানুষ সেই ভণ্ডকে রক্ষা করার চেষ্টা করছেন। তবে আমি স্থানীয় প্রশাসনের সাথে আছি। তারা চাইলে আমি সেখানে যেতে রাজি আছি। তাদের কোনো সহায়তা করতে পারলে আমি খুশি হবো।

আরও পড়ুন: ভালো মানুষকে রোগী বানানোর জাদুকর চিকিৎসক

আমি চাই যে হাসপাতাল এই অপরাধের সাথে জড়িত তাদের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করে সিলগালা করা হোক। আমি চাই ভণ্ডটার শুধু তিন মাস নয়, আজীবন কারাদণ্ড হোক। আমি চাইলেই কি হবে? আমি জানি ভণ্ডটা তিন মাস পর আবার কারাগার বের হয়ে আসবে, নতুন করে কোথাও মানুষ ঠকাবে আমার রেজিস্ট্রেশন নিয়ে। যে রেজিস্ট্রেশন নম্বরের জন্য আমি জীবনের কত কিছু মিস করেছি...।

লেখক: নিউরোলজিস্ট, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস (নিনস)

ডিএইচডি/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর