সোমবার, ১৭ মার্চ, ২০২৫, ঢাকা

আত্মহত্যা সাহসের কাজ নয়, ভীরুতা

জান্নাতুল যূথী
প্রকাশিত: ০৫ আগস্ট ২০২২, ০৬:২৯ পিএম

শেয়ার করুন:

loading/img

বর্তমানে মানুষ আত্মকেন্দ্রিক হলেও আত্মপ্রেম কতটা তা প্রশ্নবিদ্ধ! একের পর এক ঘটে চলেছে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও গণমাধ্যমের বরাতে কানে আসে আত্মহত্যার মতো পীড়াদায়ক ঘটনার। বয়স, কর্ম, লিঙ্গভেদে মানুষের মধ্যে এই ধরনের প্রবণতা দিন দিন বাড়ছেই। কিন্তু জীবন তো ফুলশয্যা নয়। দুঃখ-কষ্ট-না পাওয়ার গ্লানি; সবমিলিয়েই তো জীবন। তবে কেন আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হবে? আত্মহত্যা আদৌ কোনো সমাধানের পথ নয়।

সামাজিকভাবে মানুষ এখন অনেকটা বিছিন্ন। সবাই নিজ নিজ জীবন নিয়ে এত ব্যস্ত যে, পাশের মানুষটির সঙ্গে কথা বলার সুযোগ বা সদিচ্ছা কোনোটারই সাক্ষাৎ মেলে না। ফলে পাশের মানুষটির হতাশা, মানসিক অবসাদে জর্জরিত হওয়া নিয়ে আমাদের তেমন মাথাব্যথা নেই। কিন্তু হঠাৎ যখন এই মানুষটিই পৃথিবীর গ্লানি মুছতে আত্মহত্যা করে বসছেন, তখন আমরা কথার ফুলঝুরি নিয়ে বসছি। নানারকম কথায় বরং ব্যক্তিটিকে অপরাধী করতে ভুলছি না। কিন্তু একজন ব্যক্তি কোন পর্যায়ে পৌঁছালে নিজের জীবনকে বোঝা মনে করছে, সমাধান হিসেবে নিজের জীবনকেই শেষ করে দিচ্ছেন, সে বিষয়ে ভাবার এখনই সময়। কারও জীবনকে আপনি বা আমি বিষিয়ে তুলছি না তো। ধীরে ধীরে মনে গ্লানি সৃষ্টি করতে আমরাই কি অন্যের আত্মহত্যার কারণ হয়ে উঠছি না তো না।

সবকিছুর মূলে রয়েছে ব্যক্তির কাঙ্ক্ষিত জীবন না পাওয়া। একজন ব্যক্তি পছন্দসই সাবজেক্টে ভর্তি হতে পারছেন না বলে হতাশ হয়ে পড়ছে, আবার কেউ সবকিছু ঠিক থাকা সত্ত্বেও কাঙ্ক্ষিত চাকরিটা পাচ্ছে না। কেউ চাকরি পেয়েছে কিন্তু প্রমোশন হচ্ছে না; আবার কেউ অফিসের সহকর্মী, বস দ্বারা বিভিন্নভাবে নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। কেউ প্রেমে ব্যর্থ আবার কেউবা প্রেমের বিয়েতেই অশান্তির শিকার হয়ে অশান্তির জীবনযাপন করছে। কারও কাছে অসম্ভব পীড়াদায়ক হয়ে উঠছে দাম্পত্য সম্পর্ক। কেউ পীড়া কাটিয়ে উঠতে বিচ্ছেদে আসছে! এমনকি কেউ বিচ্ছেদকে ঘিরে নিজেকেই দুষছেন, কেউবা সামাজিক কটূক্তির শিকার হচ্ছেন, কেউ যৌন নিপীড়ন থেকে বের হতেই আত্মহত্যা করছেন, কেউ বাবা-মায়ের শাসনের বিপক্ষে গিয়ে নিজেকে শেষ করছেন। এমন অনেক ঘটনা-দুর্ঘটনায় পড়ে একজন মানুষ নিজের জীবনকে আত্মহননের পথে ঠেলে দিচ্ছে। নানারকম সমস্যার সম্মুখীন হয়ে ব্যক্তি হয়ে পড়ছে হতাশ, বিষাদগ্রস্ত!

বর্তমানে উপরিউক্ত বিভিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে মানুষ হতাশা-বিষাদে জীবনকে নিঃশেষ করে দিচ্ছেন। আর ব্যক্তিকে বিশেষভাবে চাপে ফেলে জীবনবিমুখ করে তোলার অন্যতম দায় বিশেষভাবে পরিবারের। কারণ একজন ব্যক্তি যখন এরূপ নানামাত্রিক জটিলতায় পড়ছে, তখন পরিবারের সমর্থন সবচেয়ে জরুরি! কিন্তু বাংলাদেশের নিরানব্বই ভাগ পরিবারই ব্যক্তির হতাশাকে কাটিয়ে ওঠার পথে বাধা। বরং তারা আরও চাপ সৃষ্টি করে। সেটা পুরুষের চেয়ে নারীর ক্ষেত্রে বেশি। সমাজের প্রচলিত ধারায় পুরুষের দায় তার নিজের ওপর। তাই তাকে কেউ কটূ কথা বলার সময় ভেবেচিন্তেই বলে, কিন্তু নারীকে কোনোভাবেই ছাড় দেওয়া হয় না। পরিবারের সম্মান রক্ষা না করতে পারলে ব্যক্তির জীবন সেখানে তুচ্ছ হয়ে ওঠে। তাই প্রথমত পরিবারের এসব বস্তাপচা সংস্কার-ধ্যান-ধারণাকে বাদ দিয়ে ব্যক্তিকে গুরুত্ব দিতে হবে। মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করতে হবে।

পরিবারকে ছাপিয়ে পাড়া-প্রতিবেশী-আত্মীয়-স্বজন, এমনকি বন্ধু-বান্ধব সবাই মানুষের দুর্বলতাকে নিয়েই বেশি চর্চা করতে পছন্দ করে। আর ভুক্তভোগী ব্যক্তি সবার মাঝে নিজের দোষ-ত্রুটির হিসাব কষতে কষতে হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। ব্যক্তি জীবনে যেকোনো দিন ভালো করতে পারে বা তার অসময় কখনো শেষ হতে পারে, এ সম্পর্কে ভাবতেই কেউ সাহায্য করে না। মানুষের চর্চা-আলোচনা-সমালোচনা ভুক্তভোগী ব্যক্তিটিকে দিনে দিনে মানসিকভাবে অসুস্থ করে তোলে। একসময় যন্ত্রণা কমাতে সে হয়তো বেছে নিচ্ছে আত্মহত্যার পথ।

পরিবার, পড়া-প্রতিবেশীর চর্চার বাইরে এসে যখন একজন কর্মস্থলে প্রবেশ করছে, তখনও ঠিক একই পরিস্থিতি। সেখানেও চলে ব্যক্তির দুর্বলতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা। সর্বোপরি পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে তিনি নারী হন বা পুরুষ তার জীবনের আর কোনো মূল্য আছে এমন ভাবতেই সে ভুলে যাচ্ছে। আর তার এমন রূপ তাকে ধুঁকে ধুঁকে শেষ করে দিচ্ছে। কিন্তু ব্যক্তির আত্মহত্যার দায় একা ব্যক্তির নয়। সমাজের, পরিবারের। সমাজব্যবস্থার। পরিবারের অতি সভ্রম রক্ষার জন্যও ব্যক্তি আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে।


বিজ্ঞাপন


সবকিছুর ঊর্ধ্বে গিয়ে ব্যক্তি যদি নিজেকে গুরুত্ব দিতে না পারে, নিজের মূল্য বুঝতে না পারেন, তবে এ ধরনের সমস্যা কাটিয়ে ওঠা খুবই কঠিন। সমাজের মানুষের মুখ বন্ধ করা কঠিন। কিন্তু নিজেকে শক্তিশালী, মানসিক শক্তিতে বলীয়ান করে তোলা সহজ। ফলে ব্যক্তিকে পরিবর্তন হতে হবে। নিজের ভালো বুঝতে হবে।

আরও পড়ুন: নারীর আত্মশক্তি জেগে উঠুক

নানাবিধ সমস্যা নিয়েই পৃথিবীতে মানুষের বাস। তবে, কোনো সমস্যাকেই গুরুতর করে তোলা যাবে না। প্রথমত পরিবারের সদস্যদের নিজেদের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। বাবা-মা-ভাই-বোনের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। মানসিকভাবে কেউ হতাশায় ভুগলে তাকে যথাযথভাবে সমর্থনের চেষ্টা করা। সেখানে কী ভুল আর কী সঠিক, তার হিসাব না কষে বরং কঠিন সময়টাতে ভুক্তভোগীর পাশে থাকতে হবে। যদি পরিবারগুলো এ ধরনের চর্চা করতে পারে, তবে আত্মহত্যার মতো বড় সিদ্ধান্ত অনেক কমে আসবে।

সামাজিকভাবে প্রথা নামের যেসব কুপ্রথার সয়লাব সমাজ, সেগুলোকে বিদায় করতে হবে। মানুষের জীবন অমূল্য! তাই কী পেলাম, আর কী পেলাম না, তার বিবেচনা না করে করে বরং যতটুকু অবশিষ্ট আছে; সেখান থেকেই ঘুরে দাঁড়ানোর প্রয়াস চলাতে হবে। নিজের মেধা, বুদ্ধি, শক্তিমত্তার ওপর ভরসা রাখতে হবে। বর্তমানে সবাই নিজের মধ্যে ডুবে থাকে কিন্তু তবু দিনশেষে নিজের ভালোটা বোঝার ক্ষমতা শেষ হয়ে যাচ্ছে। তাই পরিবার-পরিজন-সমাজ সবার ঊর্ধ্বে গিয়ে নিজেকে ভালোবাসতে জানতে হবে।

ভুক্তভোগী ব্যক্তির আশেপাশে যারা থাকেন, তাদের উচিত হবে, বারবার করে ব্যক্তির দুর্বল জায়গায় আঘাত দিয়ে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করা থেকে বিরত থাকা। যদি আপনার কাছে বিব্রত মনে হয়, তবে এড়িয়ে চলুন এসব ব্যক্তিকে। আর নাহলে কথা গায়ে না মেখে নিজের ভালোটা বুঝতে হবে। জীবন একটাই। আর জীবন ফুলশয্যাও নয়। তা দুঃখ-কষ্টকে পুঞ্জীভূত করে এরমাঝে ঘুরপাক খাওয়ার কোনো মানে নেই। আত্মহত্যাপ্রবণ না হয়ে জগৎ-জীবনকে বুঝতে শিখতে হবে।

হতাশাগ্রস্ত হয়ে জীবনবিনাশী চিন্তা করার আগে প্রচুর মোটিভেশান ভিডিও, ভালো সিনেমা, গান শোনার অভ্যেস গড়ে তুলতে হবে। সকালে-বিকালে  রাস্তায় হাঁটতে  হবে। তাতে যারা মানসিক অবসাদে-হতাশা-দ্বন্দ্বে ভুগে জীবনবিমুখ হচ্ছে, তারা জীবনের সঠিক দিশা খুঁজে পাবে আশা করি। নিজের জীবনের সঙ্গে রাস্তায় বসবাস করা বিভিন্ন মানুষের জীবনকে উপলব্ধি করতে শিখলে সমস্যা থেকে পরিত্রাণ ঘটবে অনেকটা।

সম্ভব হলে স্থান পরিত্যাগ করতে হবে। যদি দীর্ঘস্থায়ী না হয়, তবে কিছুদিনের জন্য হলেও। এক্ষেত্রে প্রকৃতির সান্নিধ্যে জীবনকে নতুনভাবে বোঝার-জানার-উপভোগ করার রসদ পাওয়া যাবে। চেনা-জানার বাইরে গিয়ে নিজের মতো করে নিজেকে সময় দেওয়া যেতে পারে। তাহলে অবসাদ-বিষণ্নতা, না পাওয়ার কষ্ট, হতাশা কমে আসবে।

হতাশা-দ্বন্দ্ব আস্তে আস্তে কেটে যাবে। আর একটি বিষয়কে মাথায় রাখা জরুরি, জীবন আপনার। আপনার মৃত্যু হলে পৃথিবীতে আপনাকে কেউ মনে রাখবে না। তাহলে কেন জীবনকে অন্যের জন্য বিষিয়ে তুলবেন। সে হোক প্রেম-দাম্পত্য-বিচ্ছেদ বা কাঙ্ক্ষিত ফল না পাওয়া। যাইহোক না কেন, জীবনে যতদিন ডোন্ট কেয়ার ভাব না আনা যাবে, ততদিন এ সমাজে টেকা দায়। তাই আত্মহত্যার প্রবণতা থেকে মুক্তি পেতে নিজের ভালো লাগাকে গুরুত্ব দিন। আনন্দে প্রতিটি দিন পার করার প্রত্যয়ে দিন শুরু করুন।

অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বেশি সমস্যা হলে আপনার এবং একমাত্র আপনার দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করুন। বুঝতে শিখুন, চিনতে শিখুন নতুন করে নিজেকে। দিনশেষে আপনিই আপনার। ফলে পরিবার-আত্মীয়রা এমনকি সমাজের নানাবিধ কথাকে গায়ে না মেখে নিজের যুক্তিতে জীবন পরিচালনা করার দীক্ষা গ্রহণ করুন। সবশেষে একটি কথাই বলবো, আত্মহত্যা কখনোই কোনো সমাধান হতে পারে না। নিজের জীবনকে এতটা মূল্যহীন করে তোলা উচিত নয়! যেখানে কেউ কারও নয়, সেখানে কেনই বা এত হতাশা বহন করতেই হবে। বরং দুঃখ-কষ্টের সঙ্গে জীবনকে চালিয়ে নিতে হবে? কারণ এ জগতে কেউই পরিপূর্ণ সুখী নয়; তবু পৃথিবীর নিয়মে সবাই ছুটে চলেছে।

বর্তমানে সমাজে যেভাবে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে, তাতে এখনই সময় সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার। সভা, সেমিনারের মাধ্যমে সচেতনতা বাড়াতে হবে। সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে পরিবারের প্রতিটি সদস্যের সঙ্গে। একে অন্যের দুর্বলতা নিয়ে নয়, বরং ব্যক্তির জীবনকে সুন্দর করে তুলতে তার নিজের মতো স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করার সুযোগ করে দিতে হবে। সামাজিক নানা প্রথার দোহাই দিয়ে অন্যকে বিড়ম্বিত করে তোলা যাবে না। কর্মক্ষেত্রে ব্যক্তিগত প্রশ্ন তুলে বিব্রত করা থেকে বিরত থাকতে হবে। জীবন সম্পর্কে ইতিবাচক করে তুলতে নিজেকে প্রাধান্য দেওয়া জরুরি। আসুন আত্মহত্যাকে না বলি। নিজের জীবন গড়ি।

লেখক: গবেষক ও শিক্ষক, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন