শুক্রবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

সেরে উঠুন গণতন্ত্র, স্বাধীন থাকুক বাংলাদেশ

মেশকাত সাদিক
প্রকাশিত: ২৯ নভেম্বর ২০২৫, ০৩:৩১ পিএম

শেয়ার করুন:

Khaleda
বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অপর নাম বেগম খালেদা জিয়া। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অপর নাম বেগম খালেদা জিয়া। তিনি এদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনি এক জীবন্ত কিংবদন্তি। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ এবং ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম নারী হিসেবে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে তিনবারের প্রধানমন্ত্রী। এটি শুধু তার জন্য নয়, পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশের জন্য গৌরবময় ঘটনা। সাথে সাথে তার পুরো-জীবন ও রাজনৈতিক কর্মযজ্ঞ আজও অবিসংবাদিতভাবে গণতন্ত্রের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত। কারণ তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন ইতিহাসের এমন সব বাঁক-বদলের সময়ে যখন দেশ সামরিক ও ফ্যাসিবাদি শাসন, স্বৈরাচার ও রাজনৈতিক দমন-নির্যাতন, নিপীড়ন, শোষণ-শাসন, সন্ত্রাসন, গুম, খুন, আয়নাঘরে বন্দী থেকে দেশ পরাধীনতার কালো অন্ধকারে নিমজ্জিত। সেইসব প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে, সংবিধান ও ভোটব্যবস্থায় সংস্কার এবং সামাজিক-শিক্ষাসহ নানাভাবে তিনি অবদান রেখেছেন। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে তাঁর আপসহীন বলিষ্ঠ নেতৃত্বের কারণে তিনি বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে আপসহীন নেত্রী নামে সতত-স্মরণীয়। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের বিষয়ে আমরণ লড়াইয়ের কারণে তিনিই বাংলাদেশের দেশনেত্রী হিসেবে খ্যাত।

সামরিক শাসন ও জনপ্রতিনিধিত্বহীন সময়

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ১৯৮২ সালে স্বৈরাচার ও দুর্নীতিগ্রস্ত এরশদের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে এবং দেশে শুরু হয় দীর্ঘ স্বৈরশাসন। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত অনেক রাজনৈতিক দল, সংগঠন ও নাগরিক সমাজ প্রতিরোধের চেষ্টা করলেও, স্বৈরশাসন প্রলম্বিত হয়। অনাচার, অত্যাচার, জন-নিপীড়ন ও নজিরবিহীন হামলা-মামলার প্রেক্ষাপটে, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে পথপ্রদর্শনকারী হিসেবে উঠে আসে ম্যাডাম খালেদা জিয়ার নাম। খালেদা জিয়া তাঁর স্বামী বাংলাদেশের সর্বজন-স্বীকৃত সৎ রাষ্ট্রনায়ক ও মহান স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর, ১৯৮২ সালে সাধারণ সদস্যরূপে (বিএনপিতে) যোগদান করেন। এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে তিনি আপসহীন, দীর্ঘমেয়াদী ও জনপ্রত্যাশার দিকে তাকিয়ে কঠোর আন্দোলনের সূচনা করেন। ১৯৮৩ সালে তিনি ৭-দলীয় জোট গঠন করেন। তাঁর নেতৃত্বে বিএনপি ওই জোটের অন্যতম চালিকাশক্তি ছিল। এরপর ১৯৮৩ থেকে শুরু হওয়া রাজনৈতিক আন্দোলন, ১৯৮৬ পর্যন্ত পাঁচ দফা এবং ১৯৮৭ সালের ‘এরশাদ হঠাও’ আন্দোলনে খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব ছিল অনিন্দ্য ও অসাধারণভাবে কার্যকর। দীর্ঘ এই সংগ্রামের পরিপ্রেক্ষিতে, ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানে সমন্বিত চাপে এরশাদ সরকারের পতন ঘটে। এই সময়ের সংগ্রাম ও প্রবল প্রতিরোধই জনতার মাঝে তৈরি করেছিল জাতীয় প্রেরণা। মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করে যে, বাংলাদেশকে সামরিক শাসন থেকে সরিয়ে, গণতান্ত্রিক পথে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এখানে খালেদা জিয়ার ভূমিকা ছিলো অগ্রণী, যুগোপযোগী, বাস্তবানুগ, জন-জাগানিয়া এবং ঐতিহাসিক। তাঁর এমন অসম-সাহসী নেতৃত্বের কারণে নিকৃষ্ট স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান সফল হয়। অর্থাৎ, সামরিক শাসন ও স্বৈরাচারের পতনের পর জাতীয় জীবনে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়- কীভাবে বাংলাদেশকে একটি কার্যকর, স্থায়ী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায়? প্রায় আজকের বাংলাদেশের মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। খালেদা জিয়া দেশের সেই ক্রান্তিকালে টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেন।

আরও পড়ুন

বেগম জিয়া: বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক অনন্য নক্ষত্র

প্রথম মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর খালেদা জিয়া ১৯৯১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর, জাতীয় সংসদে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী পাস করেন। এই সংশোধনী বাংলাদেশকে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় পুনরুদ্ধার করে, যার ফলে রাষ্ট্রপতি আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রপ্রধান এবং প্রধানমন্ত্রীকে প্রধান নির্বাহী করা হয়। এই সংশোধনীতে উপরাষ্ট্রপতির পদ বিলুপ্ত করা হয়। মন্ত্রিসভা সংসদের কাছে দায়বদ্ধ থাকে এবং প্রধানমন্ত্রীকে নির্বাহী ক্ষমতা প্রদান করা হয়। সংবিধানে এই পরিবর্তন কেবল নিয়ম-রূপান্তরই ছিল না; এটি ছিল সামরিক/স্বৈরশাসনভিত্তিক অতীত থেকে গণতন্ত্রভিত্তিক ভবিষ্যতের পথে অগ্রসরের প্রথম পদক্ষেপ। এর ফলে বাংলাদেশ প্রতিটি জনপ্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যায় এবং জনগণের ভোটের শক্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। এর পাশাপাশি, ১৯৯৬ সালে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ ব্যবস্থার প্রবর্তন হয়। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে, নির্বাচনের সময়ে রাজনৈতিক কোন দল সরাসরি প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি এবং নিরপেক্ষভাবে ভোট নিশ্চিত করার পরিবেশ তৈরি হয়। এটি উৎকৃষ্ট গণতান্ত্রিক ধারার উজ্জ্বল উদাহরণ। এবং এর পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন ম্যাডাম খালেদা জিয়া ও তাঁর সরকার। অর্থাৎ, গণতন্ত্র শুধু বক্তৃতার মধ্যেই সীমিত না রেখে, বরং সাংবিধানিক, প্রশাসনিক ও নির্বাচনী ব্যবস্থার যথাযথ সংস্কারের মধ্যেই সঞ্চারিত করা হয়। খালেদা জিয়া এমন একটি পূর্ণাঙ্গ কাঠামোগত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সূচনা করেছিলেন।

দেশের স্বাধীনতা সুরক্ষায় দেশনেত্রী

দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, সঠিক রাজনীতি ও নেতৃত্বের ওপর নির্ভরশীল। সঠিক নির্বাচন ও দেশপ্রেমিক-নেতৃত্ব মূলত গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতার সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। গণতন্ত্র শুধু নির্বাচন বা সংবিধান নয়। বরং একটি রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক সংস্কৃতি। এই বিশেষ সংস্কৃতিতে বিরোধিতা, মতবিনিময় এবং রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা স্বাভাবিক। খালেদা জিয়া ও তাঁর দল বিএনপি, সেই বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি গঠন ও সাংগঠনিক ভিত্তি পুনরুদ্ধারে দীর্ঘমেয়াদি কাজ করছেন। ১৯৯৬ সালের পর, যদিও বিএনপি ক্ষমতা হারায়, তবুও তারা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও কল্যাণরাষ্ট্র গঠনে বিরোধী দলের কাজ সুচারুরূপে করে যায়। বিরোধী দলের প্রতিনিধি হিসেবে সংসদীয় কাজ, জনমত গঠন এবং সরকারের সমালোচনার কাজ করে। এই অর্থে, খালেদা জিয়া শুধু ক্ষমতায় থাকার সময়ই নয়, ক্ষমতা হারানোর পরেও বিএনপি ও বিরোধী দল হিসেবে বাংলাদেশের বহুদলীয় গণতন্ত্রকে ধরে রাখার আপসহীন সংগ্রাম করেছেন।

Khaleda22

আপসহীন সংগ্রাম ও ভয়াবহ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা

কোনো দেশেই কোনো গণতান্ত্রিক যাত্রাই সহজ নয়। খালেদা জিয়া এবং তাঁর দল বহু চ্যালেঞ্জ, জেল-জুলুম, সংকট এবং সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছেন। তবে, গণতন্ত্রের প্রতি অবিচল আস্থা ও প্রতিশ্রুতি রক্ষার এই যাত্রা কখনো স্তব্ধ হয়নি। রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, বিচারিক চ্যালেঞ্জ, ক্ষমতার পরীক্ষাসহ নানা বাধা আসে। তবু, তার সংগ্রাম, দূরদৃষ্টি এবং দেশের প্রতি ভালোবাসা, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি, সাংবিধানিক মর্যাদা এবং সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ তাঁকে ইতিহাসে এক মহানায়কের অবস্থান নিশ্চিত করে। এমন নেত্রীকে অপমান-অপদস্থ করে স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি থেকে ফ্যাসিস্ট সরকার বের করে দেয়, বিনা-অপরাধে কারান্তরীণ করে, হত্যার উদেশ্যে স্লো-পয়জনিং করে, যা আজ তাকে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড় করেছে। সন্তানকে সুকৌশলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। দেশ-নায়ক তারেক রহমানের মেরুদন্ড ভেঙে দেশান্তরী করে। এরপরও মানবতাবাদী এই মহান নেত্রী ২৪ এর ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর জাতিকে শান্ত থাকার অনুরোধ করেন এবং তাঁর ওপর ঘটে যাওয়া সকল অপরাধ ক্ষমা করে দেন। এটি তিনি না করলে দেশে লাখ লাখ প্রাণহানি ঘটতে পারতো।

আরও পড়ুন

সংগ্রামের জন্য জীবন ও খালেদা জিয়া!

বাংলাদেশ যখনই সংকটে পড়েছে তখনই খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব এবং সংগ্রাম রাজনীতি, সংবিধান, সমাজ এবং সাধারণ মানুষের নতুন আলো ও নতুন প্রত্যাশার পথ দেখিয়েছে। ম্যাডাম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে উত্থান-পতন, সমালোচনা ও প্রশংসা সবই ছিল। কিন্তু ইতিহাসে তাঁর যে স্থান, সেটি কেবল একটি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিশেবে নয়; বরং, যুগ-শতাব্দী, গণ-আন্দোলন এবং স্বাধীন-সার্বভৗম রাষ্ট্রব্যবস্থার সুনিপুণ প্রতিফলন। যেই নেত্রী সংকটে জনতার সারিতে উপস্থিত হয়েছেন, সেই নেত্রীর জীবন আজ সংকটাপন্ন। বাংলাদেশ ও গণতন্ত্রই যেন আজ সংকটে। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা: হে আল্লাহ, এই যাত্রায় বংলাদেশের মানুষের কাছে ম্যাডামকে ভিক্ষা দিয়ে যান। সেরে উঠুক দেশনেত্রী, জেগে উঠুক বাংলাদেশ। তাহলেই স্বাধীন-সর্বভৌম দেশে হবে মানবিক-সূর্যোদয়।

লেখক: কলামিস্ট ও রাজনীতি বিশ্লেষক

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর