রোববার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

ব্রিকস মুদ্রা: ডলারের আধিপত্য হ্রাস, বাংলাদেশের সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ

বিপ্লব চন্দ্র ঘোষ
প্রকাশিত: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:২২ পিএম

শেয়ার করুন:

biplob
বিপ্লব চন্দ্র ঘোষ। ছবি: সংগৃহীত

ব্রিকস (BRICS) একটি আন্তর্জাতিক জোট, যার মূল সদস্য দেশ হলো ব্রাজিল, রাশিয়া, ইন্ডিয়া, চায়না এবং সাউথ আফ্রিকা। এই জোটের উদ্দেশ্য হলো অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়ানো, বৈশ্বিক বাণিজ্যে মার্কিন ডলারের ওপর নির্ভরতা কমানো এবং বহুমুখী বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং উদীয়মান অর্থনীতির কণ্ঠস্বরকে জোরদার করা। এই ব্রিকস জোট আজ এক শক্তিশালী অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়েছে। অর্থনীতিবিদরা এই জোটকে পশ্চিমা আধিপত্যের বিকল্প হিসেবে দেখতে শুরু করেছন।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের ট্যারিফ নীতি (Tariff Policy) মূলত যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যনীতির একটি কেন্দ্রীয় অংশ। যার মাধ্যমে তিনি আমেরিকার অর্থনীতিকে রক্ষা এবং শক্তিশালী করতে চেয়েছেন। তাঁর নির্বাচনী অঙ্গীকার  ছিল ‘আমেরিকা ফার্স্ট’নীতি। এর মাধ্যমে তিনি আমেরিকান শ্রমিকদের চাকরি বাঁচাতে, দেশীয় শিল্পকে উৎসাহ দিতে এবং বিদেশি বাজারে ‘ন্যায্য প্রতিযোগিতা’ নিশ্চিত করতে চেয়েছেন। এছাড়া, এই ট্যারিফ নীতির ফলে স্বল্প মেয়াদে মার্কিন ডলারের চাহিদা ও মূল্য উভয় বৃদ্ধি পেয়েছে।


বিজ্ঞাপন


ব্রিকসের সাথে আরও কয়েকটি দেশ নতুনভাবে যুক্ত হয়েছে। যদি সত্যিই নিজেদের মধ্যে স্থানীয় মুদ্রায় বাণিজ্য করার সিদ্ধান্তকে বাস্তবে রূপ দেয়, তবে এর প্রভাব সরাসরি গিয়ে পড়বে আমেরিকান ডলার (USD)-এর ওপর। কারণ আজকের দিনে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের বড় অংশ, বিশেষ করে তেল, গ্যাস, কাঁচামাল ও আর্থিক লেনদেনের মুখ্য মাধ্যম হলো মার্কিন ডলার।

আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে সম্ভাব্য প্রভাবগুলো ধাপে ধাপে আলোচনা করা হলো:

১. মার্কিন ডলারের চাহিদা কমে যাওয়ার সম্ভাবনা:

বিশ্বের রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে মার্কিন ডলারের ব্যবহার প্রায় ৬০ শতাংশের কাছাকাছি। বিশ্ব বাণিজ্যের লেনদেন ৫৫ থেকে ৬৫ শতাংশ মার্কিন ডলারে সম্পাদিত হয়। বর্তমানে অনেক দেশ তেল, গ্যাস বা অন্য পণ্য আমদানি করতে হলে আগে মার্কিন ডলার সংগ্রহ করে, তারপর লেনদেন করে।


বিজ্ঞাপন


ব্রিকস যদি নিজেদের মধ্যে রুপির বিপরীতে ইউয়ান বা রুবলের বিপরীতে রিয়াল দিয়ে বাণিজ্য করে, তবে মার্কিন ডলার ‘মধ্যস্থ মুদ্রা’ হিসেবে আর এতটা জরুরি থাকবে না। এর ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতে একক মুদ্রা হিসেবে মার্কিন ডলারের আধিপত্য ভেঙে বহুমুদ্রাভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠবে।

২. মার্কিন ডলারের আধিপত্য (Dollar Hegemony) চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে মার্কিন ডলার ছিল বিশ্ব বাণিজ্যের কেন্দ্র। বর্তমানে যদি BRICS বড় আকারে স্থানীয় মুদ্রায় বাণিজ্য শুরু করে, তবে বিশ্বের অর্থনৈতিক মানচিত্রে বহুমুদ্রাভিত্তিক বাণিজ্য ব্যবস্থা গড়ে উঠবে।

এতে মার্কিন ডলার আর এককভাবে আধিপত্য বিস্তার করতে পারবে না। ফলে আমেরিকা ও ইউরোপের প্রভাব হ্রাস পেয়ে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার প্রভাব বৃদ্ধি পাবে।

৩. আমেরিকার অর্থনীতিতে নেতিবাচক চাপ পড়ার সম্ভাবনা

মার্কিন ডলারের চাহিদা কমলে আমেরিকার সরকার সহজে ঋণ তুলতে পারবে না (কারণ এখন বিশ্বব্যাপী ডলারের চাহিদার কারণে তারা সহজেই মার্কিন ডলার ছাপাতে পারে)। আমেরিকার বাজেট ঘাটতি, ঋণনির্ভর অর্থনীতি ও সুদের হারের ওপর বড় ধরনের নেতিবাচক চাপ পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া, মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কার্যকারিতাও দুর্বল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, কারণ মার্কিন নিষেধাজ্ঞা সংশ্লিষ্ট দেশগুলো তখন বিকল্প স্থানীয় মুদ্রায় লেনদেন করতে পারবে।

আরও পড়ুন

বিটকয়েন: ডিজিটাল মুদ্রার বিবর্তন নাকি অস্থির এক জুয়া?

৪. বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভে বৈচিত্র্য

বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো তাদের রিজার্ভ হিসেবে  বৈদেশিক মুদ্রার মধ্যে মার্কিন ডলারে ৬০ শতাংশ সংরক্ষণ করে থাকে। শুধু ডলারের ওপর নির্ভর না করে একাধিক মুদ্রা ব্যবহৃত হলে আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থায় একক মুদ্রা-সংকটের ঝুঁকি কমবে।

এছাড়া, যদি BRICS স্থানীয় মুদ্রা ব্যবহারে সফল হয়, তবে ধীরে ধীরে বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো ইউয়ান, রুবল, রুপি ইত্যাদি মুদ্রাও রিজার্ভে সংরক্ষণ করতে চাইবে। তখন ইউয়ান, রুপি, রুবল ইত্যাদি মুদ্রাও রিজার্ভে যুক্ত হবে। এতে রিজার্ভ পোর্টফোলিও আরও বৈচিত্র্যময় হবে।

৫. আর্ন্তজাতিক আর্থিক লেনদেনে স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি  এবং ঝুঁকি কমার সম্ভাবনা

BRICS স্থানীয় মুদ্রায় আর্ন্তজাতিক বাণিজ্যের লেনদেন শুরু করলে মার্কিন ডলার কেনার জন্য অতিরিক্ত খরচ কমে যাবে।

স্বল্পমেয়াদে: BRICS স্থানীয় মুদ্রা চালু করলে আন্তর্জাতিক লেনদেনে নতুন অনিশ্চয়তা দেখা দিতে পারে, কারণ প্রথম দিকে আস্থা ও অবকাঠামোর ঘাটতি থাকে। এই সময়ে দুর্বল বা অস্থির স্থানীয় মুদ্রার কারণে মুদ্রা বিনিময় হার ঝুঁকি (Exchange Rate Risk) বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অর্থাৎ, একদিকে খরচ কমবে, অন্যদিকে ঝুঁকি বাড়তে পারে

দীর্ঘমেয়াদে: যদি BRICS স্থানীয় মুদ্রা বৈদেশিক বাণিজ্যে সফলভাবে গৃহীত হয় এবং অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করা যায়, তবে এটি মার্কিন ডলারের নির্ভরতা কমিয়ে লেনদেনকে আরও স্থিতিশীল এবং কম ঝুঁকিপূর্ণ করতে পারে।

৬. ভূ-রাজনৈতিক ভারসাম্যে পরিবর্তন ঘটার সম্ভাবনা

মার্কিন ডলারের শক্তি শুধু অর্থনৈতিক নয়, রাজনৈতিকও। মার্কিন ডলার কম প্রভাবশালী হলে অন্যান্য দেশের ওপর আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা আরোপের ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়বে। তখন আন্তর্জাতিক শক্তি-ব্যালান্সে (Balance of Power) আমেরিকা থেকে এশিয়া ও গ্লোবাল সাউথের দিকে ঝুঁকবে। উন্নয়নশীল দেশগুলো মার্কিন ডলারের ওপর নির্ভর না করে নিজেদের মধ্যে স্থানীয় মুদ্রায় বাণিজ্য বাড়াতে পারবে।

BRICS স্থানীয় মুদ্রায় বাণিজ্য শুরু করলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সম্ভাব্য সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ:

সম্ভাব্য ইতিবাচক প্রভাব:

১. মার্কিন ডলার নির্ভরতা কমার সম্ভাবনা

বাংলাদেশ প্রতি বছর চীন, ভারত ও রাশিয়া থেকে প্রচুর আমদানি করে। এসব লেনদেন যদি ইউয়ান, রুপি বা রুবলে করা যায়, তবে ডলার সংকটের চাপ কিছুটা হলেও কমবে।

২. আমদানি খরচ কমার সম্ভাবনা

বাংলাদেশ চীন, ভারত, রাশিয়া, ব্রাজিল থেকে প্রচুর পরিমাণ শিল্পের কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানি করে। বর্তমানে বাংলাদেশ টাকাকে মার্কিন ডলারে এবং সেই মার্কিন ডলার অন্য দেশের মুদ্রায় রূপান্তর করে আমদানি খরচ মিটাতে হয়। এই প্রক্রিয়াকে ‘ক্রস কারেন্সি এক্সচেঞ্জ রেট সিস্টেম’ বলে।

সরাসরি টাকা দিয়ে রুপি বা টাকা দিয়ে ইউয়ানে রূপান্তর করা গেলে, বৈদেশিক বাণিজ্যের লেনদেন খরচ এবং ‘বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার ঝুঁকি’ দুটোই কমে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে।

Bricks_2
 ব্রিকসের ১৫তম সম্মেলন। ছবি: সংগৃহীত

৩. রিজার্ভ সংরক্ষণে বৈচিত্র্য

এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ মূলত মার্কিন ডলারে সংরক্ষণ করে। BRICS বাণিজ্যের ফলে তখন ইউয়ান, রুপি, রুবল ইত্যাদি মুদ্রাও রিজার্ভে সংরক্ষণ করা যাবে। এর ফলে, মার্কিন ডলারের সংকটকালে বিকল্প ব্রিকস স্থানীয় মুদ্রা দিয়ে আমদানি করা সম্ভব হবে।

৪. বৈদেশিক বাণিজ্য সম্প্রসারণের সম্ভাবনা

BRICS আর্ন্তজাতিক বাজারে রফতানি সুযোগ বাড়াতে পারলে স্থানীয় মুদ্রায় লেনদেন রফতানিকারকদের জন্য সুবিধাজনক হতে পারে। বাংলাদেশ মূলত পোশাক  ও চামড়া, চামড়াজাত পণ্য রফতানি করে ইউরোপ ও আমেরিকায়। সেখানকার লেনদেন এখনো মার্কিন ডলার নির্ভর।

কিন্তু যদি BRICS দেশগুলোতেও বাজার বাড়ানো যায় এবং স্থানীয় মুদ্রায় লেনদেন করা সম্ভব হয়, তবে ডলারের ওপর নির্ভরশীলতা কমবে।

বাংলাদেশের জন্য সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ:

১. রফতানি বাজার এখনো মার্কিন ডলারনির্ভর

বাংলাদেশের প্রধান রফতানি বাজার হলো ইউরোপ ও আমেরিকা, যেখানে ডলার বা ইউরোই মূল লেনদেনের মুদ্রা। ফলে, আমদানিতে স্থানীয় মুদ্রা সুবিধা দিলেও রপ্তানি আয়ে ডলারের প্রভাব থেকেই যাবে।

২. স্থানীয় মুদ্রার অস্থিরতা বৃদ্ধি পাওয়ায় শঙ্কা

রুবল বা ইউয়ান বা রুপির মান ডলারের তুলনায় স্থিতিশীল থাকলেও অন্যান্য মুদ্রার বিনিময় হার বাংলাদেশি টাকার বিপরীতে অস্থির থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। এতে বৈদেশিক লেনদেনে বিনিময় হার ঝুঁকি (Exchange Rate Risk) সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

আরও পড়ুন

পোশাক শিল্পে চীন কেন এগিয়ে, আমাদের করণীয় কী

৩. বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে জটিলতা সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা

বাংলাদেশের অধিকাংশ বৈদেশিক ঋণ মার্কিন ডলারে গৃহীত। BRICS এর স্থানীয় মুদ্রায় বৈদেশিক বাণিজ্যের লেনদেন সম্পাদন করা হলেও বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে মার্কিন ডলারের প্রয়োজন থেকেই যাচ্ছে।

৪. প্রযুক্তি এবং ব্যাংকিং অবকাঠামো

বহু মুদ্রায় বৈদেশিক লেনদেন পরিচালনা করতে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে নতুন প্রযুক্তি ও নীতি গ্রহন ও প্রয়োগ করতে হবে। এটি সময়সাপেক্ষ এবং ব্যয়বহুল হতে পারে।

 উপসংহার: BRICS স্থানীয় মুদ্রা চালু করলে আন্তর্জাতিক অর্থনীতি এক বড় রূপান্তরের পথে যাবে। ডলারের আধিপত্য দুর্বল হয়ে বহুমাত্রিক অর্থনৈতিক বিশ্বব্যবস্থা তৈরি হবে, যেখানে উদীয়মান অর্থনীতি ও গ্লোবাল সাউথের দেশগুলো আরও শক্তিশালী ভূমিকা পালন করবে। তবে মুদ্রা বিনিময়ের ঝুঁকি ও স্থিতিশীলতা নিয়ে নতুন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যাবে।

এতে করে বাংলাদেশের জন্য ডলার সংকট লাঘব, আমদানি খরচ কমানো ও রিজার্ভ সংরক্ষণে বৈচিত্র্য আনার সুযোগ তৈরি হবে। তবে রপ্তানি আয়, বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ এবং মুদ্রা বাজার অস্থিরতা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে। অর্থাৎ, এটি বাংলাদেশের জন্য একদিকে সুযোগ, অন্যদিকে সতর্কভাবে ব্যবস্থাপনা করার মতো চ্যালেঞ্জও মোকাবেলা করতে হবে।

লেখক: ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক পিএলসি, ঢাকা

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর