রোববার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

বিটকয়েন: ডিজিটাল মুদ্রার বিবর্তন নাকি অস্থির এক জুয়া?

বিপ্লব চন্দ্র ঘোষ
প্রকাশিত: ২৫ আগস্ট ২০২৫, ০১:০৮ পিএম

শেয়ার করুন:

biplob
বিপ্লব চন্দ্র ঘোষ। ছবি: সংগৃহীত

প্রথম দিকে মানুষ পণ্য বিনিময় পদ্ধতিতে (Barter System) লেনদেন করত। যেমন: ধান দিয়ে লবণ, কাপড় দিয়ে মাছ বিনিময় ইত্যাদি। কিন্তু এই পদ্ধতিতে সময়মতো চাহিদা ও জোগান মিলত না। এছাড়া এই পদ্ধতিতে অনেক সীমাবদ্ধতা ছিল।

প্রায় তিন হাজার বছর আগে মানুষ ধাতব মুদ্রা ব্যবহার শুরু করে। প্রথম দিকের মুদ্রা ছিল সোনা, রূপা, তামা ইত্যাদির তৈরি, যার নির্দিষ্ট ওজন ও অন্তর্নিহিত মূল্য থাকত।


বিজ্ঞাপন


এরপর বিভিন্ন দেশে রাজাদের আবক্ষ সমেত ছাপা মুদ্রা চালু হয়। মধ্যযুগে কাগুজে নোটের সূচনা হয় চীনে (তাং ও সং রাজবংশের সময়), পরে ইউরোপে তা ছড়িয়ে পড়ে।

আধুনিক যুগে প্রযুক্তির বিকাশে কাগুজে মুদ্রা, টাকা, কয়েন, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, ডেবিট-ক্রেডিট কার্ড এবং সাম্প্রতিক সময়ে ডিজিটাল মুদ্রা ও ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহারের মাধ্যমে মুদ্রার রূপ অনেক পরিবর্তিত হয়েছে।

মুদ্রার ইতিহাস হলো—পণ্য বিনিময়→ ধাতব মুদ্রা→ কাগুজে মুদ্রা→ আধুনিক ইলেকট্রনিক ও ডিজিটাল মুদ্রা→ ক্রিপটোকারেন্সি (বহুল প্রচলিত- বিটকয়েন)।

মুদ্রা প্রচলনের সঙ্গে ‘তুঘলকি কাণ্ড’ শব্দের সম্পর্ক


বিজ্ঞাপন


‘তুঘলকি কাণ্ড’ বলতে এক হাস্যকর বা অযৌক্তিক প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত বোঝানো হয়। দিল্লির সম্রাট মুহাম্মদ বিন তুঘলক ছিলেন অত্যন্ত শিক্ষিত, বুদ্ধিমান ও দূরদর্শী, কিন্তু তার অনেক সিদ্ধান্তই ছিল অবাস্তব ও তড়িঘড়ি  করে নেওয়া। এর মধ্যে একটি ঘটনা বিশেষভাবে কুখ্যাত:

সোনার ও রূপার অভাবে তিনি তামার মুদ্রা চালু করেন, যেগুলো সোনার সমমূল্যের বলে ঘোষণা দেন। কিন্তু মুদ্রা তৈরির প্রযুক্তি সুরক্ষিত না থাকায় সাধারণ মানুষও সহজে ওই মুদ্রার হুবহু নকল মুদ্রা বানাতে শুরু করে। যার ফলে অর্থব্যবস্থা ভেঙে পড়ে এবং সরকারকে প্রকৃত মূল্য ফেরত দিয়ে এসব মুদ্রা বাজার থেকে তুলে নিতে হয়।

আরও পড়ুন

ব্রিকস কারেন্সি চালুর পরিকল্পনা কি স্থবির হয়ে যাবে?

এই ধরনের অদ্ভুত ও ব্যর্থ সিদ্ধান্তগুলোর কারণে ‘তুঘলকি কাণ্ড’ কথাটি বাংলা, উর্দু এবং হিন্দিতে রূপক অর্থে অযৌক্তিক, অবিবেচক বা বিপর্যয়কর সিদ্ধান্ত বোঝাতে ব্যবহৃত হয়।

ভার্চুয়াল বা ডিজিটাল মুদ্রা

গত এক দশকের কিছু বেশি সময়ে বিটকয়েন এক অজানা পরীক্ষামূলক ডিজিটাল মুদ্রা থেকে বিশ্বের অন্যতম আলোচিত আর্থিক উদ্ভাবনে (Financial Innovation) পরিণত হয়েছে। ২০০৯ সালে রহস্যময় এক জাপানি ব্যক্তি, যার নাম ‘সাতোশি নাকামোতো’- এই বিটকয়েন আবিষ্কার এবং চালু করেন।

বিটকয়েন হলো বিশ্বের প্রথম সফল ক্রিপ্টোকারেন্সি, যা সম্পূর্ণ ভার্চুয়াল বা ডিজিটাল। বিশ্বের যেকোনো সরকার বা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থেকে এই বিটকয়েন লেনদেন হয় ব্লকচেইন নামক এক শক্তিশালী কম্পিটার প্রযুক্তি'র মাধ্যমে।

বিটকয়েন কী?

বিটকয়েন এক ধরনের ক্রিপ্টোকারেন্সি, অর্থাৎ এটি ক্রিপ্টোগ্রাফি নামক জটিল কম্পিউটার কোডিং পদ্ধতিতে সুরক্ষিত। প্রচলিত মুদ্রার মতো এর কোনো কাগুজে বা ধাতব রূপ নেই, এটি কেবল ডিজিটাল আকারে বিদ্যমান। বিটকয়েন তৈরি ও যাচাই হয় মাইনিং প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, যেখানে শক্তিশালী কম্পিউটার নেটওয়ার্ক প্রতিটি লেনদেন ব্লকচেইনে তৎক্ষণাৎ সংরক্ষণ করে।

বিটকয়েন লেনদেন কীভাবে সম্পাদিত হয়?

ব্লকচেইনে বিটকয়েনের সকল লেনদেন স্থায়ীভাবে রেকর্ড হয়। একজন ব্যক্তি যখন আরেকজনকে বিটকয়েন পাঠান বা বিক্রি করেন, সেই তথ্য সারা বিশ্বের ব্লকচেইন নেটওয়ার্কে ছড়িয়ে পড়ে। মাইনাররা তা যাচাই করে এবং চিরস্থায়ীভাবে ব্লকচেইনে যুক্ত করে। এর ফলে ব্যাংকের মতো মধ্যস্থতাকারীর (সংশ্লিষ্ট দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের) প্রয়োজন হয় না এবং জালিয়াতির ঝুঁকি থাকে না।

ব্লকচেইন কীভাবে কাজ করে?

বিটকয়েনের ব্লকচেইন হলো একটি বিকেন্দ্রীভূত (Decentralized) ডিজিটাল খাতা, যেখানে বিশ্বের যেকোনো জায়গা থেকে করা সব বিটকয়েনের লেনদেন স্থায়ীভাবে রেকর্ড হয়।

প্রতিটি লেনদেন প্রথমে যাচাইয়ের জন্য নেটওয়ার্কে পাঠানো হয়। এরপর অনেক লেনদেন একত্রিত হয়ে একটি ‘ব্লক’ তৈরি করা হয়। এই ব্লকে থাকে লেনদেনের বিস্তারিত তথ্য, সময়ের রেকর্ড এবং আগের ব্লকের সাথে সংযোগ বা লিংক স্থাপনের জন্য একটি বিশেষ সাংকেতিক কোড বা হ্যাশ।

Bitkoen22
বিটকয়েনের দাম দ্রুত ওঠানামা করে। ছবি: সংগৃহীত

ব্লকগুলো একে অপরের সাথে এমনভাবে যুক্ত থাকে যে, একটি ব্লকের তথ্য পরিবর্তন করতে হলে তার পরবর্তী সব ব্লকের তথ্যও পরিবর্তন করতে হবে, যা প্রায় অসম্ভব। ব্লকচেইন প্রযুক্তি প্রুফ অফ ওয়ার্ক পদ্ধতির মাধ্যমে নেটওয়ার্কের অসংখ্য কম্পিউটার দ্বারা যাচাই করা হয়। ফলে এটি একটি নিরাপদ, স্বচ্ছ এবং কারসাজি-অযোগ্য একটি ব্যবস্থা, যা বিটকয়েন লেনদেনকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে।

মানুষ কেন বিটকয়েনে বিনিয়োগ করে?

মানুষ বিভিন্ন কারণে বিটকয়েনে বিনিয়োগ করে, যেমন:

১। বিকেন্দ্রীকরণ (Decentralization): বিটকয়েন কোনো সরকার বা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে নেই। এতে বিনিয়োগকারীরা মনে করেন তাদের অর্থের ওপর তাদেরই সরাসরি নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।

২। মূল্য সংরক্ষণ (Store of Value): অনেকের মতে, বিটকয়েন সোনার মতো এক ধরনের ‘ডিজিটাল স্বর্ণ’।  উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির সময়ে কাগুজে মুদ্রার ক্রয়ক্ষমতা কমলেও বিটকয়েনের মূল্য দীর্ঘমেয়াদে ধরে রাখে বা বাড়ার সম্ভাবনা থাকে। অর্থাৎ মানুষ কাগুজে মুদ্রার ক্রয়ক্ষমতা রক্ষার উপায় হিসেবে বিটকয়েনকে বিকল্প মনে করেন।

৩। বিশ্বব্যাপী প্রবেশযোগ্যতা: ইন্টারনেট থাকলেই বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে বিটকয়েন পাঠানো ও গ্রহণ করা যায়, কোনো ব্যাংকের প্রয়োজন হয় না। এই ভার্চুয়াল মুদ্রার লেনদেনের পূর্ব শর্ত হলো ইন্টারনেট।  ইন্টারনেট থাকলেই বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে এই মুদ্রা পাঠানো ও গ্রহণ করা যায়।

৪। উচ্চ মুনাফার সম্ভাবনা: বিটকয়েনের দাম অতীতে অনেকবার বড় আকারে বেড়েছে, তাই অনেক বিনিয়োগকারীরা উচ্চ লাভের আশায় এতে অর্থ বিনিয়োগ করেন। যদিও এর বাজার অস্থির, তবু দীর্ঘমেয়াদে এর দাম ব্যাপকভাবে বেড়েছে এবং বাড়ছে।

৫। প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনে আগ্রহ: অনেকেই ব্লকচেইন ও ক্রিপ্টোকারেন্সিকে ভবিষ্যতের অর্থব্যবস্থার অংশ হিসেবে দেখেন এবং এই প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে তারা যুক্ত থাকতে চান।

৬। সীমিত সরবরাহ (Scarcity): বিটকয়েনের সরবরাহ সীমিত। বর্তমানে পৃথিবীতে মোট ২১ মিলিয়ন বিটকয়েন রয়েছে এবং এর সংখ্যা কখনোই বাড়ানো হবে না। এই সীমাবদ্ধতাই একে অনেকের কাছে সোনার মতো মূল্যবান করে তুলেছে। বিটকয়েনের যোগান সীমিত হওয়ায় এর চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জ

বিটকয়েনের দামে প্রচণ্ড ওঠানামা করে। একদিনেই হাজার হাজার ডলারের পার্থক্য দেখা দিতে পারে। বিটকয়েন ট্রেডিং বিষয়ে যে অভিজ্ঞ সে অনেক অর্থ উপার্জন করতে পারে। অন্যদিকে, নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো বুঝতেই পারছে না এই মুদ্রার লেনদেন কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে, যা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে।

আরও পড়ুন

পোশাক শিল্পে চীন কেন এগিয়ে, আমাদের করণীয় কী

লেনদেন অপরিবর্তনীয় হওয়ায় ভুল ঠিকানায় পাঠানো বা হ্যাকিং হলে, উক্ত বিটকয়েন ফেরত পাওয়া সম্ভব নয়। অর্থাৎ সম্পাদিত কোনো ভুল লেনদেনের সংশোধিত ভাউচার (Rectified Voucher) হয় না।

এছাড়া, মাইনিং প্রক্রিয়ায় বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ খরচ হয়, যা  ইতোমধ্যে পরিবেশগত উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।

বাংলাদেশে ক্রিপ্টোকারেন্সি তথা ভার্চুয়াল মুদ্রার বিষয়ে নীতি ও নিয়ন্ত্রণ: বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৭  এবং ২০২২ সালে এক ঘোষণা এবং সার্কুলারের মাধ্যমে দেশে বৈদেশিক বাণিজ্যে সংশ্লিষ্ট বা কর্মরত সকল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ভার্চুয়াল সম্পদ ও মুদ্রা, যার মধ্যে ক্রিপ্টোকারেন্সিও অন্তর্ভুক্ত, লেনদেন থেকে বিরত থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে বিটকয়েন এবং অন্যান্য ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহার  ও লেনদেন সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। 

আরও উল্লেখ রয়েছে যে, ডিজিটাল ক্রিপ্টোকারেন্সি বা বিটকয়েন বাংলাদেশে কোনো বৈধ মুদ্রা নয় এবং এগুলোর লেনদেন শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

ডিজিটাল মুদ্রার ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

বিটকয়েন ইতোমধ্যে আর্থিক জগতে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। কেউ মনে করেন অর্থনীতিতে এটি একদিন প্রচলিত মুদ্রার সমতুল্য হয়ে উঠবে, আবার কেউ কেউ একে অস্থির ও জল্পনামূলক বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা করেন। তবে একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বিটকয়েন মানুষের অর্থ ও প্রযুক্তি সম্পর্কে নতুন ভাবনার ধরন বদলে দিয়েছে।

এটি শেষ পর্যন্ত স্থায়ীভাবে বৈশ্বিক অর্থনীতির অংশ হয়ে উঠুক বা না উঠুক, ডিজিটাল মুদ্রার বিপ্লবের সূচনা হিসেবে বিটকয়েন ইতোমধ্যেই মুদ্রা আবিষ্কারের ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে।

লেখক: ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক পিএলসি, ঢাকা

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর