ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়া শুধু একটি সরকারের পতন নয়, বরং এটি এক গভীর রাষ্ট্রীয় রূপান্তরের দিগন্ত উন্মোচন করেছে। শূন্যতা নয়, সম্ভাবনার নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে। বহুদিন ধরে জর্জরিত একটি ধ্বস্ত রাষ্ট্রব্যবস্থাকে কীভাবে নতুন কাঠামোতে দাঁড় করানো যায়—এ নিয়ে এখন আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠেছে। রাষ্ট্র ও সমাজের নানা স্তর থেকে সংস্কারের ডাক শোনা যাচ্ছে, বিভিন্ন পক্ষ থেকে বিকল্প প্রস্তাব উঠে আসছে, কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হলো, এই প্রক্রিয়ায় বারবার টার্গেট করা হচ্ছে একটি মাত্র রাজনৈতিক দলকে—বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপিকে।
একটি সুপরিচিত বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে যে, বিএনপি বুঝি সংস্কারে আগ্রহী নয় কিংবা তাদের সংস্কার ভাবনা দুর্বল। অথচ বাস্তবতা হলো—যখন কেউ সংস্কার বলতেই সাহস পেত না, তখন থেকেই বিএনপি রাষ্ট্র সংস্কারের গভীর চিন্তা ও প্রস্তাবনায় নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। বিএনপি যখন ‘ভিশন ২০৩০’ প্রকাশ করেছিল, তখন দেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে এমন দূরদর্শী চিন্তা অচিন্তনীয় ছিল। সেই ধারাবাহিকতায় ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ‘২৭ দফা রাষ্ট্র সংস্কার কর্মসূচি’ ঘোষণা করেন—যা সময়ের পরীক্ষিত এক রূপরেখা হিসেবে দেখা দিয়েছে। পরবর্তীতে জনগণের মতামত ও রাজনৈতিক বাস্তবতার আলোকে আরও চারটি প্রস্তাব যুক্ত করে এটি ৩১ দফায় পরিণত হয়। এই প্রস্তাবনাগুলো শুধু বিএনপির দলীয় অ্যাজেন্ডা নয়, বরং গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের জাতীয় রূপরেখা।
বিজ্ঞাপন
বর্তমানে নানা পক্ষ থেকে বিভিন্ন প্রস্তাব আসছে—কখনও সংসদে উচ্চকক্ষ, কখনও এনসিসি (ন্যাশনাল কনস্টিটিউশনাল কাউন্সিল), কখনও আবার প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমানোর উদ্যোগ। এসব প্রস্তাবনাকে অনেক সময় নতুন, অভিনব বা একান্তই সুশীল সমাজের ভাবনা হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে। অথচ বাস্তবতা হলো—এই ধারণাগুলোর প্রায় প্রতিটিই বিএনপির রাজনৈতিক প্রস্তাবনায় বহু আগেই স্থান পেয়েছে। উচ্চকক্ষের কথা বলা হলে মনে রাখতে হবে—২০১৬ সালের ভিশন ২০৩০-এই সর্বপ্রথম এই প্রস্তাবটি আনুষ্ঠানিকভাবে এসেছিল, যা পরে ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাবের অন্যতম মূল উপাদানে রূপ নেয়। উচ্চকক্ষে জনভিত্তিক প্রতিনিধিত্বের ধারণা হিসেবে বিএনপি নিম্নকক্ষের আসন সংখ্যার অনুপাতকে ভিত্তি করার কথা বলেছে—যার ফলে এটি হবে গণতান্ত্রিক প্রতিনিধিত্বের নিয়ন্ত্রক, না যে হারে অনেকের ধারণা, এটি পরাজিত নেতাদের পুনর্বাসনের প্ল্যাটফর্ম।
বিএনপির সংস্কার প্রস্তাবে আরও গুরুত্বপূর্ণ যে দিকটি আছে তা হলো—একক নির্বাহী ক্ষমতার অবসান। বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী সাংবিধানিক কাঠামোয় সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, যা কার্যত একদলীয় কর্তৃত্ববাদের রূপ নিয়েছে। বিএনপি চায় ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, জবাবদিহিমূলক শাসন ও অংশগ্রহণমূলক নীতি। ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধনের প্রস্তাব বিএনপিই প্রথম সাহসের সঙ্গে তোলে, যেখানে বলা হয়েছে—গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দলীয় শৃঙ্খলা বজায় থাকবে, তবে অন্যান্য বিষয়ে সংসদ সদস্যদের স্বাধীন মতপ্রকাশ ও ভোটদানের অধিকার নিশ্চিত করা হবে।
বিএনপির প্রস্তাবিত ফ্লোর ক্রসিং নীতিও ভারসাম্যপূর্ণ। তারা অনাস্থা ভোটের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে ফ্লোর ক্রসিংয়ের অনুমতি দেয়নি, কারণ সেক্ষেত্রে হর্স ট্রেডিংয়ের সুযোগ থেকে যায়। কিন্তু বাকী অধিকাংশ বিষয়ে সাংসদরা যেন স্বাধীন মতামত দিতে পারেন, সে দিকেও মনোযোগ দেওয়া হয়েছে। এই ভারসাম্যই গণতন্ত্রের মূল সৌন্দর্য—একদিকে দায়িত্বশীলতা, অন্যদিকে স্বাধীনতা।
বিএনপির ৩১ দফায় প্রস্তাবিত ছয়টি বড় সংস্কার কমিশনের মধ্যে বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, দুদক এবং প্রশাসনিক সংস্কারের ক্ষেত্রেও সুস্পষ্ট রূপরেখা দেওয়া হয়েছে। বিএনপি বিশ্বাস করে, এই কমিশনগুলোর কাজ হবে ক্ষমতাসীন দলের সেবাদান নয়, বরং জনগণের পক্ষে দায়িত্ব পালন। বাস্তবতা হলো, বর্তমানে যে-সব প্রস্তাব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছে, সেগুলোর অনেকাংশই বিএনপিরই ভাবনা থেকে নেয়া।
বিজ্ঞাপন
"পরপর দুইবারের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে পারবে না"—এই প্রস্তাবও বিএনপিই সর্বপ্রথম তুলে ধরে। আজ যাঁরা এই প্রস্তাবে করতালি দিচ্ছেন, তাঁদের অনেকে বিএনপির প্রস্তাব তখন অগ্রাহ্য করেছিলেন। আজ যখন সেই প্রস্তাব ‘ট্রেন্ডিং আইডিয়া’, তখনও বিএনপির নামটি অনুল্লিখিত থাকে, যেন এটা কেবল অন্যদের সৃষ্টি।
বিএনপির অবস্থান শুরু থেকেই পরিষ্কার—দলটি লোক দেখানো সংস্কার বা কেবল জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য দেওয়া অবাস্তব প্রতিশ্রুতির পক্ষে নয়। বরং বিএনপি এমন সংস্কারকে সমর্থন করে, যা বাস্তবিক প্রয়োগযোগ্য, সময়ের চাহিদা অনুযায়ী এবং দেশের মাটি ও মানুষের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। যেমন, বিচার বিভাগের ক্ষেত্রে প্রস্তাবিত ২৩টি সুপারিশের মধ্যে ২০টিকে বিএনপি ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেছে; দুর্নীতি দমন কমিশনের ২০টির মধ্যে ১৯টি, এবং জনপ্রশাসন সংস্কারের ২৬টির মধ্যে প্রায় অর্ধেক প্রস্তাবকে দলটি কার্যকর ও প্রয়োজনীয় হিসেবে চিহ্নিত করেছে। আবার যে-সব সুপারিশ বাস্তববর্জিত, অবাস্তবায়নযোগ্য বা অনাকাঙ্ক্ষিত প্রতিক্রিয়ার ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে হয়েছে, সেসব ক্ষেত্রে বিএনপি গঠনমূলকভাবে ভিন্নমত পোষণ করেছে—যা একটি দায়িত্বশীল ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তির পরিচায়ক।
বিএনপি কোনোভাবেই অন্ধ সংস্কার সমর্থন করে না। যেমন—সংবিধানের মৌলিক কাঠামো, দেশের নাম পরিবর্তন, জাতীয় পরিচয়ের বিকৃতি—এসব বিষয়ে প্রস্তাব এলে বিএনপি দ্ব্যর্থহীনভাবে বিরোধিতা করেছে। বিএনপি মনে করে, সংস্কার হতেই হবে, তবে সেটি হতে হবে বাস্তবভিত্তিক, জনমানুষের গ্রহণযোগ্য, এবং টেকসই কাঠামোর মধ্যে।
আসলে অনেকে এখন বিএনপির ভোট ব্যাংক ও জনপ্রিয়তা নিয়েই ভয় পাচ্ছেন। নির্বাচনের দ্বারপ্রান্তে এসে কেউ কেউ সেই ভয়কে হালকা করতে চায় ‘সংস্কার বিতর্কে’ ঢেকে দিয়ে। যেন নির্বাচনটা কিছুটা পিছিয়ে গেলে ক্ষমতার কাছাকাছি থাকার পথটা আরও কিছুদিন মেলে।
কিন্তু বিএনপি জানে—সংস্কার আর নির্বাচন পরস্পরবিরোধী নয়। বরং সত্যিকার সংস্কার কেবল সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠা পাবে। কারণ, নির্বাচনের মাধ্যমেই জনগণ তাদের ম্যান্ডেট প্রকাশ করে এবং সেখানেই আসল রাষ্ট্রিক রূপান্তরের ভিত্তি স্থাপিত হয়। যারা শুধু তাত্ত্বিক কথায় সংস্কারের স্বপ্ন আঁকে, তারা হয়ত বিএনপির বাস্তববাদী অবস্থান পছন্দ নাও করতে পারে। কিন্তু এই দেশে সংস্কার বাস্তবায়নের দায়িত্ব নিতে হলে শুধু ধারণা নয়, দরকার সাহস, কাঠামো ও নেতৃত্ব—যা বিএনপি ধারাবাহিকভাবে দেখিয়ে এসেছে।
বিএনপি বিশ্বাস করে—ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেওয়াটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় সংস্কার। এ দেশে আর যেন কেউ পেটোয়া পুলিশ আর প্রশাসনের জোরে ক্ষমতায় যেতে না পারে, সেটিই হোক পরিবর্তিত বাংলাদেশের শপথ। এই শপথ শুধু বিএনপির নয়—এটি গোটা জাতির।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক