সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

ফ্যাসিজম ও সংবেদনশীল সমাজ

ড. হাফিজ রহমান
প্রকাশিত: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৫:৪৪ পিএম

শেয়ার করুন:

ফ্যাসিজম ও সংবেদনশীল সমাজ
গত ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতন ঘটে। ছবি: সংগৃহীত

ফ্যাসিজম ও সংবেদনশীল সমাজ দুটি বিপরীতার্থক প্রত্যয়। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে ফ্যাসিজমের মারাত্মক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। জাতীয়তাবোধের প্রেক্ষিতে ফ্যাসিজমের কিছু ইতিবাচক দিক থাকলেও ফ্যাসিজম মূলত কর্তৃত্ববাদিতার নামান্তর। ফ্যাসিবাদের গোড়াপত্তন ইতালির শাসক মুসোলিনীর হাত ধরে হলেও পরবর্তী সময়ে তা জার্মানির শাসক এডলফ হিটলারের হাতে ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ সময়কালে বিকশিত হয়। জাতীয়তাবাদী উগ্রতা ও স্বৈরাচারী মনোভাব প্রকাশ ও তদ্রূপ কর্মকাণ্ড করতে ফ্যাসিজম সর্বৈবভাবে সমর্থন করে। তাহলে ভিন্ন জাতি বা অন্য রাষ্ট্রকে দমন পীড়ন অথবা যুদ্ধে লিপ্ত করতেও ফ্যাসিজম একটি অন্যতম নেতিবাচক চেতনার নাম। সংবেদনশীল ব্যক্তি বা সমাজ হয় ফ্যাসিজমের পুরোপুরি বিপরীত। সংবেদনশীল ব্যক্তি সুন্দর, সুখী ও স্বচ্ছ সমাজ বিনির্মাণ করতে পারেন। সমগ্র পৃথিবী তখন সংবেদনশীল হয়ে ওঠে। প্রত্যেকেই প্রত্যেকের জীবন ও কর্মের সমান গুরুত্ব অনুধাবন করেন ও সকল সুন্দরের প্রতি একাত্মতা ও নিবিড়তা আত্মস্থ করেন। এভাবে শান্তিময়, নিরাপদ এবং সাম্য-সমতায় সমুজ্জ্বল একটি পৃথিবী গড়া সম্ভব; যে পৃথিবীতে একটি সমাজ থাকবে এবং সেটি অবশ্যই সংবেদনশীল সমাজ।

ফ্যাসিজম (Fascism): ফ্যাসিজম শব্দটি ইতালীয় শব্দ ফ্যাসিসমো (Fascismo) হতে আগত। এই শব্দটির অর্থ এক গোছা লাঠি। অর্থাৎ অনেকগুলি লাঠির একটি বান্ডল। লাঠি নামক শব্দের ব্যবহার থেকে প্রমাণিত হয় যে, ফ্যাসিজম হলো অত্যাচারী শাসন ব্যবস্থা। কঠোর শাস্তি প্রয়োগের দন্ড। অর্থাৎ কর্তৃত্ববাদের প্রতিবাদ করলেই অত্যাচারের খড়গ্ নামবেই। যদিও এটিকে রাজনৈতিকভাবে সংজ্ঞায়িত করা সম্ভব- ফ্যাসিবাদ হলো একই চেতনার সিন্ডিকেট যারা নিজেদের চিন্তা ও দর্শন রাষ্ট্রের সকলকে মানতে বাধ্য করে। প্রয়োজনে ভিন্ন মতাবলম্বীদের হত্যা করে। অথবা কারান্তরীণ করে। জার্মানির অ্যাডলফ হিটলারের নাৎসি পার্টি ফ্যাসিবাদের উদাহরণ, যা উগ্র ইহুদি বিদ্বেষ ও সমাজতন্ত্র বিরোধী হিসেবে নাৎসি পার্টির বিশেষ বৈশিষ্ট্য। একদেশ, একদল; এমন কর্তৃত্বপরায়ণতা ও অন্যের মতামতের কোনো মূল্যায়ন না করাই ফ্যাসিজমের কার্যিক ভূমিকা সব সময় প্রশ্নবিদ্ধ। ফ্যাসিজমের শুরু থেকে গত শতাব্দীর সত্তরের দশক পর্যন্ত উগ্র জাতীয়তাবাদীতা ছিল ফ্যাসিজমের অন্যতম নিয়ামক শক্তি। কিন্তু ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ নামক নতুন রাষ্ট্র গঠনের পর থেকে ফ্যাসিজম নতুন রূপ পরিগ্রহ করে। সেই বিরল ফ্যাসিবাদের বিশেষ রূপ উপলব্ধি করার জন্য ব্যক্তিগত ফ্যাসিজম (Individual Fascism) সম্পর্কে জানা প্রয়োজন।


বিজ্ঞাপন


আরও পড়ুন

গণ-বিপ্লবের গণ-প্রত্যাশা পূরণ হবে কি!

প্রত্যেকের মাঝেই ফ্যাসিস্ট চরিত্র বিদ্যমান। সামষ্টিক ফ্যাসিজমের থেকে ব্যক্তিক ফ্যাসিজম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও গুরুতর। ব্যক্তিক ফ্যাসিজম বলতে অন্যের মতামতকে/ আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে নিজের মতামত/ চিন্তা/ দর্শন অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়াকে বোঝায়। অন্যের চিন্তা দর্শনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হওয়া অথবা এক পক্ষের মতামত/অভিযোগ/ বিষোদগার শুনে অন্যপক্ষকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করানো ফ্যাসিস্ট চরিত্রের অন্যতম উদাহরণ। অন্যের ন্যায্য অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া অথবা বাছ-বিচার বিশ্লেষণ বহির্ভূতভাবে একজনের ন্যায্য অধিকার অন্যকে প্রদান-ও হতে পারে ফ্যাসিজমের চিরায়ত রূপ। এমনই একটা ঘটনা ছিল- স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রিত্ব নিয়ে। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে দেশে ফিরেই তাজউদ্দিন সাহেবের কাছ থেকে প্রধানমন্ত্রিত্ব কেড়ে নেন। এই কেড়ে নেওয়াটাও ছিল ফ্যাসিজমের একটি লক্ষণ।

পরবর্তী সময়ে একক শক্তি হিসেবে (Absolute Power) নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য রাষ্ট্রপতি হন। যখন তিনি প্রধানমন্ত্রী হন তখন প্রধানমন্ত্রীকেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা কার্যকর হয়। পক্ষান্তরে রাষ্ট্রপতি হয় আলংকারিক পদ। তিনি যখন রাষ্ট্রপতি হলেন তখন আবার রাষ্ট্রপতিকেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা চালু হলো। অদ্ভুত এক গণতন্ত্রের সূচনা হলো তার অদ্ভুত চিন্তার মাধ্যমে। এরপর বাকশাল নামক বহুবিরল এক শাসনব্যবস্থা চালু করে বাংলাদেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর আশা-আকাঙ্ক্ষা ও মতামতকে পদদলিত করলেন। কেউ প্রতিবাদী হলে রক্ষী বাহিনী দিয়ে গুম-খুন করানো হতো। অর্থাৎ তিনি ব্যক্তিগত চাওয়া পাওয়া পূরণ করে ফ্যাসিস্ট মুজিব থেকে হলেন ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রনায়ক। এবং এই ফ্যাসিজমের সাথে 'র' এর ষড়যন্ত্র শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে। তাই প্রয়াত রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের ফ্যাসিজমের দর্শন উগ্র জাতীয়তাবাদতো নয়-ই বরং পার্শ্ববর্তী দেশের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যস্ত এক বিরল ফ্যাসিবাদের উদ্যোক্তা তিনি।

এরপর ২০১০ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর পিতার অসমাপ্ত ফ্যাসিজমকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়ার শক্ত প্রয়াস শুরু হয়। এবারও ফ্যাসিজম-এর ধারাবাহিকতা রক্ষায় ফ্যাসিস্ট পিতার অনুসরণ করতে এসে পিতার মতো কন্যা ভুল করেননি। বরং পিতাকে হারিয়ে আরও বেশি ভারতের সেবাদাসে পরিণত হন। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার 'র' এর সকল পরিকল্পনা বাংলাদেশে বাস্তবায়ন শুরু হয় সুচতুর ও অতিনিখুঁতভাবে।


বিজ্ঞাপন


বাকশালে কিছুটা হলেও অন্তর্ভুক্তিমূলক (Inclusiveness) ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগ ছাড়া কোনো দলেরই অস্তিত্ব রাখার পক্ষে নয়। গত ১৫ বছরে বাংলাদেশে সত্যিকার মুসলমান যারা তাদের কল্যাণে কিছুই করা হয়নি। বরং নিরীহ আলেম-ওলামা ও মাদরাসার ছাত্রদের জঙ্গি বানিয়ে নাটক মঞ্চস্থ করা হয়েছে। পুলিশ বাহিনী সরকারি অর্থে পুলিশ লীগে পরিণত হয়ে আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠনের দায়িত্ব পালন করেছে। ভারতীয় দালালির বাইরে কোনো মতামত ব্যক্ত করলেই হত্যা গুম বা আয়না ঘরে বন্দী রাখা হয়েছে। শেখ শাসকদের চরিত্র তাই মুসোলিনি এবং হিটলারদের সম্পূর্ণ বিপরীত। মুসোলিনি বা হিটলার, তারা নিজের দেশকে শক্তিশালী করতেন, যা নিজের দেশের জন্যই ইতিবাচক। অপারপক্ষে শেখদের ফ্যাসিজম হচ্ছে, নিজের দেশকে অন্য দেশের গোলামে পরিণত করা। ভারতের সেবাদাস হওয়া।

২০২৪ এর জুলাই আগস্ট-গণহত্যা বিরল প্রকৃতির ফ্যাসিবাদের নগ্ন চেহারা। ভারতের নির্দেশ ও নির্দেশনা মোতাবেক নিজ দেশের ছাত্র-যুবক-তরুণদের ওপর এই গণহত্যা শুধু হত্যাপরাধ নয় বরং রাষ্ট্রদ্রোহিতাও। এই ধরনের নিকৃষ্ট ফ্যাসিজম থেকে বাঁচতে হলে প্রয়োজন সংবেদনশীল সমাজ বিনির্মাণ।

সমাজ ও সংবেদনশীল সমাজ: সাধারণ অর্থে সমাজ বলতে বিভিন্ন ধর্ম-গোত্র, সম্প্রদায় এবং সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর মানুষের একত্রে বসবাসকে বোঝায়। সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আইন কানুন বিধি-বিধান ইত্যাদিকে প্রভাবক হিসেবে প্রয়োগ করা হয়। অগাস্ট কোঁৎ-এর ভাষায় সমাজ হলো: Societies start in the theological stage of development where society based on the laws of God or theology.

 লেখার পরিসর ছোট রাখার স্বার্থে শুধু সমাজ বিজ্ঞানের জনক অগাস্ট কোঁৎ-এর সংজ্ঞা নিয়ে আলোচনা করবো। প্রথমে ইংরেজি সংজ্ঞাটির বাংলা দেখি: ধর্মই হচ্ছে, সমাজ বিকাশের মূল ভিত্তি। সমাজ আল্লাহর আইন বা ধর্মতত্ত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত। অর্থাৎ এখানে ৩টি বিষয় পাওয়া গেলো। ক. সমাজ খ. ধর্মতত্ত্ব ও গ. আল্লাহর আইন।

উপরে বর্ণিত ৩টি বৈশিষ্ট্য দ্বারা এটি প্রতীয়মান হয় যে, মানব সমাজকে সুন্দর, সুশৃংখল, শান্তিময় এবং সুখী করতে হলে ধর্মীয় আইনকানুন বিধিনিষেধ বাস্তবায়নের বিকল্প নেই। আর যখন কোনো সমাজ অসাম্প্রদায়িকতা, সাম্য ও সমতার নীতিতে চলে তখন সেই সমাজ হয় সংবেদনশীল।

আরও পড়ুন

নালায়েক কূটনীতির রণডঙ্কা

সংবেদনশীল সমাজের কিছু বৈশিষ্ট্য এমন হতে পারে:

১. অসাম্প্রদায়িকতা

২. সত্য ও সততা

৩.সর্বাবস্থায় ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণ

৪. সাম্য ও সমতাভিত্তিক অধিকার নিশ্চিতকরণ

৫. ধর্মীয় স্বাধীনতা

৬. স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের নির্ভীক পরিবেশ নিশ্চিতকরণ

৭. প্রশাসনিক বৈষম্য বিলোপের মাধ্যমে প্রশাসনিক ও আর্থিক দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনা

৮. অপবাদ ও কুৎসা রটনাহীন মানব সমাজ

৯. অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিতের আগেই বিরূপ ধারণা পোষণহীন মানব সমাজ গঠন

১০. খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের সুন্দর সুযোগ নিশ্চিতকরণ

১১. অন্যের অধিকারের প্রতি যত্নশীল হওয়া

১২. দায়িত্ব আগে; অধিকার পরে, এই মনস্তত্ত্ব গঠন

১৩. শতভাগ নিশ্চিত না হয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু পোস্ট দেওয়া এবং অন্যের দেওয়া পোস্টে আবেগবান হয়ে মন্তব্য করার আগে বিবেকবান হওয়া

১৪. কথা কাজে বা প্রশাসনিকভাবে কাউকে মজলুম না বানানো

১৫. হিংসা-বিদ্বেষ পরশ্রীকাতরতা মুক্ত সমাজ

১৬. আইন কানুন জানা ও মেনে চলা সমাজ

১৭. গাড়ির হর্ন মুক্ত ও ট্রাফিক আইন মেনে চলা উন্নত সমাজ

১৮. যেকোনো ধরনের সহিংসতা মুক্ত সমাজ

১৯.  ধর্মীয় সহিষ্ণুতা

২০. সর্বোপরি দেশপ্রেমে উজ্জীবিত একটি সমাজ।

যে সমাজে এমন বৈশিষ্ট্য নেই সেই সমাজ অসংবেদনশীল। আর অসংবেদনশীল সমাজ-ই ফ্যাসিস্ট সৃষ্টি করে। সমাজ বদল না হলে বারবার ফ্যাসিস্ট তৈরি হতেই থাকবে। ব্যক্তি জীবন হতে ফ্যাসিজম বিদায় করলেই রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে থেকে চিরতরে ফ্যাসিজম নিশ্চিহ্ন হবে। না হলে বারবার ফ্যাসিস্ট ফিরে আসবে। ব্যক্তি জীবনে ফ্যাসিজম বন্ধ হলেই সমাজ ও রাষ্ট্রে ফ্যাসিস্ট নির্মূল হবে।

লেখক: কলামিস্ট ও রাজনীতি বিশ্লেষক

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর