বুধবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

গণ-বিপ্লবের গণ-প্রত্যাশা পূরণ হবে কি!

শিপন আলম
প্রকাশিত: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯:৪১ এএম

শেয়ার করুন:

গণ-বিপ্লবের গণ-প্রত্যাশা পূরণ হবে কী!

আজ থেকে ৭৫-৮০ বছর পূর্বে বাংলা সাহিত্যের বিপ্লবী কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য ‘আঠারো বছর বয়স’ কবিতার মাধ্যমে ‘আঠারো’-কে এদেশের বুকে নব সূচনার উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছিলেন। এই জুলাই-আগস্টেই যেন সেই দুঃসাহসী আঠারোর তরুণরা নেমে এলো শোষিত বঞ্চিত নিপীড়িত বাংলার বুকে মুক্তির দূত হয়ে। আরেকবার নিষ্কলুষ বুকের তাজা রক্ত বিসর্জন দিলো ক্ষুধা দারিদ্র্য আর আজীবন বৈষম্যের শিকার বাংলার উর্বর জমিতে। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার ইস্যুকে কেন্দ্র করে সংঘটিত এই আন্দোলনই পরবর্তীতে পরিণত হয় ছাত্র জনতার আন্দোলনে। শত শত নিরীহ শিক্ষার্থী জনতার আত্মদানের মাধ্যমে এ আন্দোলন এক সময় পরিণত হয় গণ-আন্দোলনে। আর গণ-আন্দোলন সূচনা করে গণ-বিপ্লবের। গণ-বিপ্লবের গণ-জোয়ারে পতন হয় জনসাধারণের দৃষ্টিতে ‘স্বৈরাচারী হাসিনা’ সরকারের। 

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার টানা সাড়ে পনেরো বছরের শাসনামলে অন্যায় অনিয়মের অভিযোগ বিস্তর। সর্বত্র দলীয়করণের কালো ছায়া, দুর্নীতির সর্বব্যাপী নিষ্ঠুর থাবা, একনায়কতান্ত্রিক ও পক্ষপাতদুষ্ট বিচার বিবেচনা, ন্যায়বিচার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় চরম ব্যর্থতা, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করা, নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংস করা, দ্রব্যমূল্যের লাগাম টানতে ব্যর্থ হওয়া, ব্যর্থতা ঢাকতে সর্বত্র বলপ্রয়োগের নিষ্ঠুর রেওয়াজ চালু রাখা প্রভৃতি কারণে তাঁর শাসলকাল শুরু থেকেই ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। ফলে ধূমায়িত এসব অন্যায় অনিয়মই এক সময় তীব্র জন-অসন্তোষের সৃষ্টি করে। ফলে শাসন ক্ষমতা ফেলে রেখে চরম অপমানজনকভাবে তাঁকে বিদায় হতে হয় স্বৈরাচারী শাসকের তকমা নিয়ে। 


বিজ্ঞাপন


এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে গণ-প্রত্যাশাকে সামনে রেখে ছাত্র জনতার রক্ত বিসর্জনে সংঘটিত গণ-বিপ্লবের মাধ্যমে বাংলার ইতিহাসে যে বাঁক সৃষ্টি হলো তা কতটুকু এ প্রত্যাশা পূরণ করতে সমর্থ হবে। ইতিহাস বলে, ইতিহাসের চরম শিক্ষাই হলো ইতিহাস থেকে আসলে কেউই শিক্ষা গ্রহণ করে না। ২০০৬-০৭ সালে বিএনপি-জামায়াত সরকারের মেয়াদ শেষে সেসময়ে উদ্ভূত পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের শিক্ষাটা যেমন ভুলে গিয়েছিল ২০০৯ সালে গঠিত আওয়ামী সরকার। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও তৎপরবর্তী সরকারগুলো এমন ভুলোমনা স্বভাবের হোক তা জনগণ প্রত্যাশা করে না। 

তবে বাংলাদেশের ইতিহাস বলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা নিরপেক্ষ সরকার যে নামেই সম্বোধন করি না কেন এই সরকারের আমলেই জনপ্রত্যাশার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ বেশ কিছু আইন প্রবর্তিত হয়েছে যা দলীয় সরকারের আমলে সম্ভব ছিল না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০০৬ সালের ড. ফখরুদ্দীন আহমেদ এর নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারই বহুল আকাঙ্ক্ষিত নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের কাজটি সম্পন্ন করে। এছাড়াও ‘তথ্য অধিকার আইন’ এর মতো যুগান্তকারী কিছু পদক্ষেপও এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলেই গ্রহণ করতে দেখা যায়। এরই ধারাবাহিকতায় এবং সময়ের প্রয়োজনে বর্তমান ইউনূস সরকারও এমন কিছু আইন ও পদক্ষেপ গ্রহণ করবে তা অনুমান করাই যায়। ইতোমধ্যে সাবেক স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা (বর্তমানে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা) বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য ‘রাজনৈতিক আইন’ প্রণয়নের প্রস্তাব করেছেন। সময় গড়ানোর সাথে সাথে আরো বেশ কিছু জন-আকাঙ্ক্ষামূলক নীতি ও আইন প্রবর্তিত হবে এমনটি আমরা আশা করতেই পারি। 

গণ-প্রত্যাশা পূরণের জন্য এ সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জও কম নয়। হাসিনা সরকারের পতনের পর একটি নির্বাহী সরকারের অনুপস্থিতিতে ক্রমাবনতিশীল আইন-শৃঙ্খলার উন্নতি ঘটিয়ে স্থিতিশীল অবস্থায় নিয়ে আসাই এই সরকারের বর্তমানের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সংখ্যালঘু ইস্যুকে পুঁজি করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে এ সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করার যে অশুভ তৎপরতা চলছে তা রুখে দেওয়াটাও এক ধরণের চ্যালেঞ্জ। তাছাড়া পতিত সরকারের দেশবিরোধী নানা চক্রান্ত ও বিদেশি অশুভ শক্তির অপতৎপরতা নস্যাৎ করে দিয়ে দেশকে একটি স্থিতিশীল ও টেকসই অবস্থায় নিয়ে আসাটাও বড় ধরণের চ্যালেঞ্জ। এছাড়াও বিভিন্ন গোষ্ঠীর দাবি-দাওয়া পূরণ করা, বন্যার মতো প্রাকৃতিক দূর্যোগ মোকাবেলা করা, মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরে জনজীবনে স্বস্তি আনয়ন করা, আর্থিক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে এ খাতকে শক্ত ও মজবুত ভিত্তির উপর দাঁড় করানো, বৈদেশিক মুদ্রার নিরাপদ রিজার্ভ সংরক্ষণের মাধ্যমে আমদানি রপ্তানির ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা, উদার ও স্বচ্ছ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার পথে দেশকে নিয়ে যাওয়া প্রভৃতি চ্যালেঞ্জগুলোও অন্তর্বর্তীকালীন এ সরকারকে মোকাবেলা করে ভবিষ্যতের পথ চলতে হবে।

কবি নির্ঝর প্রকাশ তাঁর ‘বিপ্লব’ কবিতায় বলেছেন, স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে মানুষ/ আমরাও স্বপ্ন দেখতাম/একদিন ঠিক হয়ে যাবে সব/অগ্নি স্ফুলিঙ্গ থেকেই শুরু হবে/ নতুন প্রজন্মের, শুরু হবে নতুন পৃথিবীর। কবির মতো আমরা সাধারণ মানুষেরাও স্বপ্ন দেখি ক্ষুধা-দারিদ্র‍্য ও বৈষম্যমুক্ত উদার গণতান্ত্রিক নতুন বাংলাদেশের। যে বাংলাদেশ তার সকল নাগরিককে সমান চোখে দেখবে, নিশ্চিত করবে ন্যায়বিচার, সমুন্নত রাখবে তার মানবাধিকার। গণতন্ত্র হরণের কূটকৌশল থাকবে না যে বাংলাদেশে, থাকবে ভোটাধিকার প্রয়োগের সর্বজন স্বীকৃত অধিকার। তবেই ৫ আগস্ট সংগঠিত গণ-জাগরণের গণ-দাবি পূরণ হবে, নিশ্চিত হবে গণবিপ্লবের গণপ্রত্যাশাও।


বিজ্ঞাপন


লেখক: সহকারী অধ্যাপক, হিসাববিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি সা’দত কলেজ, টাঙ্গাইল।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর