বুধবার, ৮ মে, ২০২৪, ঢাকা

সড়কে মৃত্যুর মিছিল রোধ করা যাবে কি

আহসান হাবিব
প্রকাশিত: ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৫:২৬ পিএম

শেয়ার করুন:

সড়কে মৃত্যুর মিছিল রোধ করা যাবে কি

প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনা যেন নিয়মিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সড়ক ও সেতু গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত আধুনিক হলেও দুর্ঘটনা বেড়েছে কয়েক গুণ। সড়ক দুর্ঘটনার রাশ টানা কোনোমতেই সম্ভব হচ্ছে না। সবখানে উন্নয়ন হলেও উন্নয়ন হচ্ছে না সড়ক সুরক্ষায়।

সম্প্রতি ঈদে ঢাকা ফিরতি যাত্রায় ঘটেছে ভয়াবহ দুটি দুর্ঘটনা। ফরিদপুরে যাত্রীবাহী বাস ও পিকআপের মুখোমুখি সংঘর্ষে ১৪ জন নিহত এবং তিনজন আহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে ৫ জন একই পরিবারের। ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের ফরিদপুর সদর উপজেলার কানাইপুরের তেঁতুলতলায় মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনাটি ঘটে ঈদের (১১ এপ্রিল) পর ১৬ এপ্রিল। ১৭ এপ্রিল ঝালকাঠিতে আরও একটি দুর্ঘটনা ঘটে। এখানেও ১৪ জন নিহত হয়। তার মধ্যে একই পরিবারের ৭ জন। ঝালকাঠি-রাজাপুর সড়কটি উপজেলা সংযোগ সড়ক। সড়ক বিভাগের তথ্য মতে, ১৮ থেকে ২২ ফুট চওড়া এই সড়কে গাড়ির সর্বোচ্চ গতিবেগ থাকার নিয়ম ঘণ্টায় ৪০ থেকে ৬০ কিলোমিটার। সেখানে ৮০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে আঘাত হানে ট্রাকটি। সেখানে সিসিটিভির ফুটেজে দেখা যায়, টোল পরিশোধ করে ধীরে ধীরে এগুচ্ছে একটি মালবোঝাই ছোট ট্রাক। তার ঠিক পেছনে সাদা রঙের একটি প্রাইভেটকার এবং যাত্রীবোঝাই দুটি থ্রি-হুইলার। সময় দুপুর দেড়টা। বাসা পালটানোর আসবাবপত্র নিয়ে সবার আগে থাকা ট্রাকটি টোল দিয়ে একটু সামনে এগিয়েছে। টোল পয়েন্টের কর্মীরা এগিয়ে যাচ্ছেন দাঁড়িয়ে থাকা প্রাইভেটকারের দিকে। ঠিক তখনই দানবের মতো ছুটে আসা একটি সিমেন্টবোঝাই ট্রাক পেছন থেকে আঘাত করে গুঁড়িয়ে দেয় দুই থ্রি-হুইলার ও প্রাইভেটকারকে। সড়কের বাম পাশে থাকা থ্রি-হুইলার থেকে একজন যাত্রী লাফিয়ে বাঁচলেও ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হন বাকি সবাই। ঝালকাঠির গাবখান টোল পয়েন্টে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ১৪ জনের প্রায় সবাইকে উদ্ধার করতে হয়েছে গুঁড়িয়ে যাওয়া গাড়ি আর থ্রি-হুইলার কেটে। দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া প্রাইভেটকারের ভেতরে যেন জড়াজড়ি করে ঘুমিয়ে ছিল দুজন শিশু। তাদের আঁকড়ে ধরে ছিলেন দুই মা। বোঝার উপায় ছিল না যে বেঁচে নেই কেউ। ভেঙে গুঁড়িয়ে যাওয়া গাড়ির ভেতর থেকে এই ৪ জনসহ একই পরিবারের ৭ জনের লাশ বের করা হয় একে একে।


বিজ্ঞাপন


আর কত জীবন চলে গেলে সড়কে বন্ধ হবে লাগাতার মৃত্যুর মিছিল। আদৌ সড়কে মৃত্যুর মিছিল রোধ করা যাবে কি?

২০১০ সাল থেকে দুর্ঘটনাজনিত আইনটি প্রণয়নে আট বছর ব্যয় করেছে সরকার। এর মধ্যে চারবার খসড়া করা হয়েছে। তাহলে কি শিক্ষার্থীদের খুশি করতে সরকার কঠোর আইনটি করেছে? এখন শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নেই। কিন্তু সরকারের ওপর পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের চাপ আছে। তাই আইনের বিভিন্ন ধারা সংশোধনের মাধ্যমে তা শিথিল করা হয়েছে। যার কারণে চালকরা সহসাই আইনের ফাঁক-ফোকর দিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে। তাহলে কি আইনের মাধ্যমে নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করা মূল লক্ষ্য নয়?

নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) এর প্রতিষ্ঠাতা অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন বহু বছর ধরে নিরাপদ সড়কের জন্য আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। দুর্ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে অদক্ষতার পাশাপাশি চালকের গোঁয়ার্তুমি অন্যতম বড় কারণ। তাদের হতাহতের সংখ্যাও উদ্বেগজনক।

২০১৮ সালের ২৯ জুলাই রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সামনের বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহত হন। প্রথমে ওই স্কুলের শিক্ষার্থীরা মাঠে নামেন। পরে নিরাপদ সড়কের দাবিতে এই আন্দোলন ঢাকাসহ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। ছয় বছর পর দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির চিত্র এখনও বদলায়নি বরং সড়ক দুর্ঘটনা আগের চেয়ে বেড়েছে। এছাড়াও ট্রাফিক আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগের অভাবে লাফিয়ে বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা। সড়ক-মহাসড়কে ২৪ লাখ অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালকের দাপটে দুর্ঘটনায় লাগাম টানা যাচ্ছে না। প্রতিদিনই সড়কে ঝরছে অসংখ্য তাজা প্রাণ। দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল।


বিজ্ঞাপন


যাত্রীকল্যাণ সমিতি বলছে, ২০১৬ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ৮ বছরে ঈদযাত্রায় (ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা) রাজধানীসহ সারা দেশে ৩ হাজার ৮৬২টি দুর্ঘটনা ঘটেছে, যেখানে ৪ হাজার ৪৭৫ জন নিহত ও ১১ হাজার ৬৯৫ জন আহত হয়েছেন।

সড়ক দুর্ঘটনা বিশেষজ্ঞ ও যাত্রীকল্যাণ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সড়ক উন্নয়নে মেগা মেগা প্রকল্প নেওয়া হলেও দুর্ঘটনা বন্ধ হয়নি। বরং বছর বছর দুর্ঘটনা যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে প্রাণহানি ও পঙ্গুত্ববরণের সংখ্যা। বিশেষ করে ঈদের সময় পরিবহন সংশ্লিষ্ট মালিক, চালক ও শ্রমিক কোনো নিয়মের তোয়াক্কা না করায় দুর্ঘটনা বাড়ছে। পাশাপাশি নজরদারি কমে যাওয়া, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, অদক্ষ চালক, পরিবহন সংশ্লিষ্টদের প্রভাব ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির নজির না থাকাসহ নানা কারণে বহু উদ্যোগের পরও সড়কে প্রাণহানি বন্ধ করা যাচ্ছে না।

বর্তমানে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হচ্ছে মোটরসাইকেল। চলতি বছরেই শুধু ১৮১টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ২০৩ জন নিহত ও ১৬৬ জন আহত হয়। গত মার্চ মাসেই রাজধানীসহ সারা দেশে ৫৫২টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫৬৫ জন নিহত ও ১ হাজার ২২৮ জন আহত হয়েছেন। এছাড়া সড়ক, রেল ও নৌপথে সর্বমোট ৫৯৭টি দুর্ঘটনায় ৬১২ জন নিহত ও ১ হাজার ৩৩১ জন আহত হয়। সাম্প্রতিক সময়ে সংবাদমাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছেন বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী। দেশের জাতীয়, আঞ্চলিক ও অনলাইন সংবাদপত্রে প্রকাশিত সড়ক, রেল ও নৌপথের দুর্ঘটনার সংবাদ মনিটরিং করে এই প্রতিবেদন তৈরি করেন তারা।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, মোট দুর্ঘটনার ৩২.৭৮ শতাংশ এবং নিহতের ৩৫.৯২ শতাংশ ও আহতের ১৩.৫১ শতাংশ মোটরসাইকেলে হয়েছে। একই সময়ে রেলপথে ৩৮টি দুর্ঘটনায় ৩১ জন নিহত ও ৮৬ জন আহত হয়েছেন। নৌপথে সাতটি দুর্ঘটনায় ১৬ জন নিহত ও ১৭ জন আহত হয়েছেন। সড়ক, রেল ও নৌপথে সর্বমোট ৫৯৭টি দুর্ঘটনায় ৬১২ জন নিহত ও ১ হাজার ৩৩১ জন আহত হয়েছেন।

ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, বেপরোয়া গতি, চালকদের অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা, বেতন-কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকা ও মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল। দুর্ঘটনার জন্য আরও দায়ী— তরুণ-যুবদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো, জনসাধারণের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, বিআরটিএ’র সক্ষমতার ঘাটতি এবং গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজি।

সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং সড়কে শৃঙ্খলা আনতে একটি কঠোর আইনের দাবি দীর্ঘদিনের। ছয় বছর আগে ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে মাঠে নামলে বিষয়টি পুনরায় সামনে আসে। ওই বছরের ২০ সেপ্টেম্বর সরকার শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে কঠোর শাস্তির বিধানসংবলিত একটি আইন সংসদে পাস করে। এরপর প্রায় ৭ বছর পেরিয়ে গেছে, কিন্তু আইনটি এখনো পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। সরকার শুধু পরিস্থিতি সামাল দিতে নানা পদক্ষেপের ঘোষণা দিয়েছে। শুধু কাগজ-কলমেই আবদ্ধ রয়েছে। কিন্তু এগুলোর কার্যকর বাস্তবায়ন কখনোই হয়নি। এমনকি সড়ক পরিবহন আইন শিরোনামের একটি নতুন আইন প্রণয়ন করা হলেও সেটি প্রয়োগের ক্ষেত্রে কয়েকটি ধারা শিথিল করা হয়েছে। সেখানে মৃত্যুজনিত বিষয়, চালকদের লাইসেন্সসহ বিভিন্ন বিষয় রয়েছে।

একদিকে যেমন ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেই, অন্যদিকে ভবিষ্যতের জন্যও কোনো সুপরিকল্পিত উদ্যোগ নেই। যাদের এটা নিয়ে কাজ করার কথা তাদের ফোকাস দেখি না। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে পরিবহন সেক্টরে অনিয়ন্ত্রিতভাবে বিশৃঙ্খল হচ্ছে। এ অবস্থা মোকাবিলায় পেশিবহুল পরিবহন সিন্ডিকেটকে একটি সিস্টেমের মধ্যে আনা অত্যন্ত জরুরি। সড়ক দুর্ঘটনার কারণ চিহ্নিত করে অনেক সুপারিশ দেওয়া হলেও তা কাগজেই আবদ্ধ থেকে গেছে বাস্তবে কিছুই হয়নি। সুপারিশ বাস্তবায়ন না করা গেলে কখনো দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বন্ধ হবে না।

এ অবস্থা থেকে উত্তরণে দক্ষ চালক তৈরি, রাস্তায় পাল্লাপাল্লি করে গাড়ি চালানো যাবে না। ওভারটেকিং করা যাবে না। ট্রাফিক আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ, মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহনের জন্য আলাদা রাস্তা (সার্ভিস লেন) তৈরিসহ বেশকিছু উদ্যোগ নিতে হবে। এসব বাস্তবায়নে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকতে হবে। তাহলেই হয়তো সড়কে দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

লেখক: সংবাদকর্মী ও কলামিস্ট

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর