‘বইমেলা’ শব্দ বাঙালির প্রাণের ভিতরে জায়গা করে নিয়েছে বেশ আগে থেকেই। ফেব্রুয়ারি এলেই প্রতিটি বাঙালির নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে ধ্বনিত হয় এই বইমেলা। ‘বইমেলা’ শব্দটি শুনলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে বাংলা একাডেমি আয়োজিত ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’। আধুনিক বিশ্বে যত রকম মেলা হয় তার মধ্যে বাঙালির বইমেলার ভিন্নতা এখানেই যে এটি ভাষা আন্দোলনের শহীদদের চেতনায় ঋদ্ধ। পৃথিবীর অনেক দেশের মতো বাংলাদেশের বইমেলা বাঙালির প্রাণের মেলা।
বছর ঘুরে ফেব্রুয়ারি আসে, আসে বইমেলা। এবারও যথারীতি শুরু হয়েছে বইমেলা। ফেব্রুয়ারি মাসব্যাপী চলবে মেলা। দেশের লেখক-কবি, সাহিত্যিক, পাঠক ও প্রকাশকদের এ মিলনমেলার জন্য সারাটা বছর সবাই উন্মুখ হয়ে থাকে। ‘পড়ো বই গড়ো দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’— প্রতিপাদ্য নিয়ে ১ ফেব্রুয়ারি শুরু হয়েছে ‘বাঙালির প্রাণের মেলার’ ৪০তম আসর। মেলার আয়োজক প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি জানিয়েছে, এবারের বইমেলা হচ্ছে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রায় সাড়ে ১১ লাখ বর্গফুট জায়গায়। এবার ৬৩৫টি প্রতিষ্ঠানকে ৯৩৭টি ইউনিট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে একাডেমি প্রাঙ্গণে ১২০টি প্রতিষ্ঠানকে ১৭৩টি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ৫১৫টি প্রতিষ্ঠানকে ৭৬৪টি ইউনিট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। গত বছর বইমেলায় অংশ নিয়েছিল ৬০১ প্রতিষ্ঠান। সেই হিসেবে এবার প্রকাশনা সংস্থা বেড়েছে ৩৪টি। এবার মেলায় ৩৭টি (একাডেমি প্রাঙ্গণে একটি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ৩৬টি) প্যাভিলিয়ন থাকবে। মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে বড় বড় স্টল ও প্যাভিলিয়ন অংশগ্রহণ করেছে। এবার করোনার মতো মহামারি কিংবা তেমন কোনো রাজনৈতিক অস্থিরতা নেই। লিপইয়ার হওয়ায় মিলছে একদিন বাড়তি সময়। সঙ্গে যোগ হয়েছে মেট্রোরেল সুবিধা। সব মিলে ভালো একটি মেলার আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। যে কোনোবারের চেয়ে এবারের বইমেলা আরও বেশি জমজমাট হবে, পাঠক ও দর্শনার্থী আরও বাড়বে। দেশের নানা প্রান্ত থেকে অনেক মানুষ আসবে।
বিজ্ঞাপন
বিশ্বে বই সংগ্রহের রীতিটি বেশ পুরনো। প্রাচীন চীনারা বই সংগ্রহ শুরু করে ৯৬০ সালের পর। তারা এর নাম দেয় ‘শানবিন’। বইকে তারা খুবই গুরুত্ব দিতো। চীনারা তাদের সংস্কৃতি ইতিহাসকে ধরে রাখার জন্যই বই সংগ্রহ শুরু করে। খ্রিস্টীয় পনেরো শতকে জোহানস গুটেনবার্গ মুদ্রণযন্ত্র বা ছাপাখানা আবিষ্কার করেছেন। বলা হয়, সেই সময় থেকেই বইমেলার সূচনা হয় জার্মানিতে। অনেকের মতে, জার্মানির লিপজিগ শহরে প্রথম বইমেলা হয়েছিল। কিন্তু কারও কারও ধারণা এর বিপরীত। তারা মনে করেন, প্রথমে বইমেলা শুরু হয় ফ্রাঙ্কফুর্টে, লিপজিগ খুব বড় করে মেলার আয়োজন করায় তাদের নামই লোকজন জানতো বেশি। সে সময় বইমেলাগুলো তেমন জনপ্রিয়তা না পেলেও সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। ১৭ শতকের পর ইউরোপসহ বিশ্বের আরও কিছু দেশে বইমেলা শুরু হয়।
কিন্তু আমরা হয়তো অনেকেই জানি না আমাদের বইমেলার ইতিহাস। কিভাবে শুরু হলো এই বইমেলা? চিত্তরঞ্জন সাহা একুশের বইমেলার প্রবর্তক হিসেবে স্বীকৃত হলেও বইমেলার শিকড় আরও গভীরে প্রোথিত। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে প্রথম বইমেলা অনুষ্ঠিত হয় ১৯৬৫ সালে। উদ্যোগটি নিয়েছিলেন সরদার জয়েনউদ্দীন। ১৯৬৫ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) গ্রন্থাগারের নিচতলায় কিছু শিশুতোষ বই প্রদর্শন শুরু করেন। তখন তিনি শিশুদের বই নিয়ে ইউনেস্কোর একটি প্রকল্পে কাজ করছিলেন। ১৯৭০ সালে জয়েনউদ্দীন নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের সহযোগিতায় নারায়ণগঞ্জে একটি বইমেলার আয়োজন করেন। ইউনেস্কো ১৯৭২ সালকে ‘আন্তর্জাতিক বই বর্ষ’ ঘোষণা করায় ডিসেম্বরে জয়েনউদ্দীন বাংলা একাডেমিতে বইমেলার আয়োজনের উদ্যোগ নেন। এরপর থেকে বাংলা একাডেমি বইমেলার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত হয়।
এরপরে ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বর্ধমান হাউজ প্রাঙ্গণের বটতলায় চটের ওপর কলকাতা থেকে আনা ৩২টি বই সাজিয়ে বইমেলার গোড়াপত্তন করেছিলেন চিত্তরঞ্জন সাহা। স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ (বর্তমান মুক্তধারা প্রকাশনী) থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশি শরণার্থী লেখকদের লেখা নিয়ে তিনি আয়োজন করেছিলেন এ মেলার। চিত্তরঞ্জন সাহা চার-পাঁচ বছর পর্যন্ত এই চর্চা একাই চালিয়ে যান। পরে বই বিক্রি করার এই আইডিয়ায় অনুপ্রাণিত হয়ে আরও কয়েকটি প্রকাশনী সেখানে বই সাজানোতে যুক্ত হয়। ১৯৭৬ সালে কিছু প্রকাশক এসে একাত্ম হন এবং আরও দুই বছর পর ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমি তাতে সংযুক্ত হয়। চিত্তরঞ্জন সাহা এক টুকরো চটের ওপর কয়েকটি বই সাজিয়ে যে মেলার সূচনা করেছিলেন, সেই মেলা আজ পুরো জাতির দর্পণের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ মেলায় দেশি, প্রবাসী বাঙালি লেখক-পাঠক-প্রকাশক-দর্শনার্থীদের প্রাণের উৎসবে পরিণত হয়। সারা বছর সবার অপেক্ষা থাকে এই মেলা নিয়ে।
বিজ্ঞাপন
ফুটপাতে চটের ওপর যে মেলা শুরু হয়েছিল আজ তা পত্র-পল্লবে বিকশিত। ১৯৮৪ থকে আনুষ্ঠানিকভাবে অমর একুশে গ্রন্থমেলার সূচনা হয়। এরপর প্রতিবছর বইমেলা বিশাল থেকে বিশালতর আকার ধারণ করে। মেলা উপলক্ষে বিপুল বই প্রকাশিত হয়। বলা চলে এই মেলা উপলক্ষ করেই বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্প একটি শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে গেছে। এখন অনেক নতুন প্রকাশক এই শিল্পে এসেছেন। পাঠকের সংখ্যাও প্রতিবছর বাড়ছে। এই মেলা এক মাস ধরে চলে। বিশ্বের আর কোনো বইমেলাই এত দিন ধরে চলে না। সেই দিক থেকে দেখতে গেলে এটি পৃথিবীর দীর্ঘদিনব্যাপী আয়োজিত একটি বইমেলা।
আগে প্রতি বছর ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অমর একুশে বইমেলা অনুষ্ঠিত হতো। এরপর ক্রেতা, দর্শক ও বিক্রেতাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে এই মেলা নিয়মিতভাবে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। সারাবিশ্বে এখন অনেক আন্তর্জাতিক বইমেলা হয়ে থাকে। সেখানে লোকজনের ভিড়ও দেখার মতো। এর মধ্যে অন্যতম বইমেলাগুলো হলো— লন্ডন বইমেলা, আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা, নয়াদিল্লি বইমেলা, কায়রো বইমেলা, হংকং বইমেলা, বুক এক্সপো আমেরিকা (বিইএ), আবুধাবি বইমেলা ইত্যাদি।
অমর একুশে গ্রন্থমেলার তথ্যকেন্দ্র থেকে প্রতিনিয়ত নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের খবর, প্রতিদিন প্রকাশিত বইগুলোর নাম, লেখক ও প্রকাশকের নাম প্রকাশ করা হয়। এছাড়া বিভিন্ন রেডিও ও টেলিভিশন চ্যানেল মেলার মিডিয়া স্পন্সর হয়ে মেলার তাৎক্ষণিক খবরাখবর দর্শক শ্রোতাদের অবহিত করে। তবে প্রকাশকরা বলেছেন, কাগজের দাম বেশি হওয়ায় বইয়ের দামও বাড়ছে। তাই মানুষের বই কেনার হারও কমতে পারে। এ ব্যাপারে দোদুল্যমানতায় ভুগছে ব্যবসায়ীরা। সবকিছু মিলিয়ে বাঙালির এই প্রাণের মেলা প্রতিনিয়ত গতি পাবে এমন প্রত্যাশা আমাদের।
লেখক: সাংবাদিক, লেখক ও কলামিস্ট