বেঁচে থাকা মানুষের অধিকার। মানুষ বাঁচতে চায় মর্যাদা নিয়ে এবং অধিকার নিয়ে। কিছু মৌলিক চাহিদা মানব জীবনের জন্য আবশ্যকীয়। এ চাহিদাসমূহ হচ্ছে— খাদ্য, বস্ত্র, আবাসন, শিক্ষা ও চিকিৎসা। যে কোনো চাহিদার অ-পূর্ণতায় জীবন চলা অসম্ভব। বিশেষত আবাসন প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ। আবাসন বা বাসস্থানকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র। একটি নির্দিষ্ট বাসগৃহে মানুষ শান্তিতে ও স্বাস্তিতে বসবাস করতে চায়। সুন্দর আবাস প্রত্যেকের সুখের ঠিকানা। আমরা কী গৃহহীন মানুষদের জীবনচিত্র কিরূপ, আমরা কী ভাবি! সমাজের ছিন্নমূল মানুষেরা কী মর্যাদা নিয়ে চলতে পারে? একটি গৃহ হচ্ছে পরিবারের সকল প্রকার উন্নয়নের মূলভিত্তি। এ গৃহকে কেন্দ্র করে মানুষ সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বপ্ন রচনা করে। প্রাকৃতিক, অ-প্রাকৃতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকসহ বিবিধ কারণে সমাজের অনেক মানুষ গৃহহীন হচ্ছে। আাশ্রয়হীন ব্যক্তিদের সুরক্ষার জন্য প্রয়োজন সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ। এ ক্ষেত্রে ‘আশ্রয়ণ’ হচ্ছে সরকারের একটি অন্যতম সামাজিক সুরক্ষামূলক কর্মসূচি।
বাংলাদেশ বিশ্বের একটি অন্যতম দুর্যোগ প্রবণ এলাকা। সমুদ্র উপকূলের মানুষগুলো দুর্যোগের সাথে সংগ্রাম করে টিকে আছে। দেশের দক্ষিণ-পূর্ব সমুদ্র উপকূলে আমার জন্ম। তাই শৈশবকাল হতে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়েছে। গত শতাব্দীর ৭০ ও ৯১ সালের ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসের কথা স্থানীয় প্রবীণদের মুখে বহুবার শুনেছি বার বার। ওই সময় জান-মালের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। এতে বিপুল মানুষ নিঃস্ব হয়েছে এবং ভিটামাটি ছাড়া হয়েছে। তাছাড়া সুনামি, আয়লা ও অন্যান্য জলোচ্ছ্বাসে উপকূলের মানুষগুলো চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। অন্যদিকে ‘টর্নেডো’ একটি অন্যতম প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যার কোনো পূর্বাভাস নাই। টর্নেডোর আচমকা আঘাতে লণ্ডভণ্ড হয় আবাসস্থল ও বাসগৃহ। নদীমাতৃক দেশ হিসেবে বন্যা, নদী ভাঙন ও পাহাড়ী ঢলের প্রভাবে প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষের বাসগৃহ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। নদী গর্ভে বিলীন হচ্ছে ফসলি জমি ও বসতভিটা।
বিজ্ঞাপন

জাতির পিতার হাত ধরে এ দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার ভূমিহীন, গৃহহীন ও আশ্রয়হীন মানুষদের পুনর্বাসনে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের সূচনা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ঘূর্ণিদূর্গত লক্ষীপুর জেলাধীন রামগতি উপজেলার চরপোড়াগাছা গ্রাম পরিদর্শন করেন। বঙ্গবন্ধু ওই পরিদর্শনকালে দূর্গত ছিন্নমূল মানুষের জন্য গুচ্ছ গ্রাম গড়ে তোলার ঘোষণা প্রদান করেন। এ ঘোষণার মাধ্যমে দেশের আশ্রয়হীন মানুষগুলো প্রাকৃতিক বিপর্যয় হতে ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি পায়। সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটে। দীর্ঘদিন পর ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধকন্যা শেখ হাসিনা দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হন। ১৯৯৭ সালে কক্সবাজার জেলার সেন্টমার্টিন দ্বীপ প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়। ওই বর্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্থ বিপন্ন মানুষদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তত্ত্বাবধানে শুরু হয় ‘আশ্রয়ণ প্রকল্পে’ নামে একটি কার্যক্রমের যাত্রা। এ প্রকল্প দেশের একটি অন্যতম সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি।
‘আশ্রয়ণ প্রকল্প’ হচ্ছে বিপন্ন মানুষের ঠিকানা। ‘আশ্রয়ণ’ নিগৃহীত ও ছিন্নমূল মানুষের উন্নয়নে রাষ্ট্রের কল্যাণমূলক উদ্যোগের দৃষ্টান্ত। এ প্রকল্প একটি কল্যাণরাষ্ট্র গঠনের মাইলফলক। এ কর্মসূচি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অর্থনৈতিক বিপর্যয় ও সামাজিক বঞ্চনার শিকার নিঃস্ব মানুষের জন্য। ‘আশ্রয়ণ’ তাদের সুরাক্ষায় রাষ্ট্রের এক মহৎ প্রচেষ্টা। এ কর্মসূচির উদ্দেশ্য হচ্ছে, দেশের প্রান্তিক মানুষের সুরক্ষা। এ প্রকল্পের মূল লক্ষ্য: বিপন্ন মানুষদের প্রশিক্ষণ ও ঋণ প্রদানের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। আয়বর্ধক কার্যক্রমের মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচনের উদ্যোগ গ্রহণ। ‘আশ্রয়ণ প্রকল্প’ জলবায়ু উদ্বাস্তু, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, তৃতীয় লিঙ্গ, ভিক্ষুক, বেদে, দলিত, হরিজনসহ সমাজের পিছিয়ে পড়া সকলকে নিরাপত্তা বলয়ে সম্পৃক্ত করার জন্য রাষ্ট্রীয় কৌশল।
দারিদ্র মুক্ত, উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ জাতির স্বপ্ন। এ লক্ষ্য অর্জনে প্রয়োজন অন্তর্ভূক্তিমূলক সমাজ। একটি ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের বহুমুখী উদ্যোগ প্রশংসিত হচ্ছে সর্বত্র। ‘আশ্রয়ন প্রকল্প’ যারা মধ্যে অন্যতম। এ প্রকল্প দেশের সকল নিগৃহীত ও বিপন্ন মানুষকে অন্তর্ভূক্তিমূলক উন্নয়নের যাত্রায় সম্পৃক্ত করা হচ্ছে। এ উদ্যোগের অন্যতম লক্ষ্য দেশের দারিদ্র বিমোচন করা। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে অনগ্রসর মানুষকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল ধারায় যুক্ত করা। অর্ন্তভূক্তিমূলক সমাজ গঠন ও দারিদ্র বিমোচনে নব পদ্ধতি হিসেবে ‘শেখ হাসিনা মডেল’ দেশে পরিচিতি লাভ করেছে। এ মডেলের মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে: উপার্জন ক্ষমতা ও সঞ্চয় বৃদ্ধি, সম্মানজনক জীবিকা ও সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা, জমিসহ গৃহের মালিকানা ও নারীর ক্ষমতায়ন, প্রশিক্ষণ ও মানব সম্পদ উন্নয়ন, বনায়ন ও বৃক্ষরোপন এবং গ্রামেই শহরের সুযোগ-সুবিধা নিশিশ্চত করা। বিপন্ন মানুষের জীবনমান উন্নয়ন এবং অন্তভূর্ক্তিমূলক সমাজ গঠনে আশ্রয়ন প্রকল্পের ভূমিকা অনন্য।

‘আশ্রয়ণ’ আশ্রয়হীন মানুষের সামাজিক সুরক্ষা কেন্দ্র। একটি গৃহ কীভাবে পারিবারিক কল্যাণ ও সমাজিক উন্নয়নের হাতিয়ার হতে পারে, ‘আশ্রয়ণ’ যার অন্যতম উদাহরণ। এ কার্যক্রম দেশব্যাপী বিস্তৃত। একটি টিনসেট পরিপাটি নতুন গৃহ আজ বিপন্ন মানুষের সুখের ঠিকানা। এখন তারা ৪ শত ফুট আয়তনের ২ শতক জমিতে স্থাপিত সেমি পাকা ঘরে স্থায়ী মালিক। এ ঘরে আছে সুপরিসর দু’টি কক্ষের সামনে টানা বারান্দা, পেছনে রান্না ঘর ও স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটারি ল্যাট্রিন।
এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৯৭ সাল হতে অদ্য তারিখ পর্যন্ত আশ্রয়ন প্রকল্পের আওতায় ৫ লাখ ৭ হাজার ২৪৪টি ভূমিহীন পরিবারকে আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় পুনর্বান করা হয়েছে। মুজিব বর্ষে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা গৃহহীন থাকবে না কোনো মানুষ। এ মুজিব বর্ষে দেশের গৃহহীন মানুষের জন্য প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উপহার হিসেবে ১ লাখ ৮৩ হাজার ৩ পরিবারকে জমিসহ গৃহ প্রদান করা হয়েছে।

জাতিসংঘ টেকসই উন্নয়ন অভিষ্ট (Sustainable Development Gols) অর্জনে আশ্রয়ণ প্রকল্পের অসামান্য ভূমিকা রয়েছে। এসডিজির মূল দর্শন হচ্ছে ‘কাউকে পেছনে রেখে নয়’। ভূমিহীন একটি পরিবার কেবল একটি গৃহ পাওয়ার মাধ্যমে দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র হতে বের হওয়ার অপার সম্ভাবনা তৈরি করছে ‘আশ্রয়ণ’। এসডিজি’র ১নং লক্ষ্য হচ্ছে ‘দারিদ্র বিলোপ’। এডিজি’র এ লক্ষ্যমাত্রার ১.৪ নং সূচকে উল্লেখ “২০৩০ সালের মধ্যে সকল নারী পুরুষ বিশেষ করে দরিদ্র ও অরক্ষিত জনগোষ্ঠীর অনুকূলে অর্থনৈতিক সম্পদ ও মৌলিক সেবা-সুবিধা, জমি ও অপরাপর সম্পত্তির মালিকানা নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয়েছে। এসডিজির ১০নং লক্ষ্যমাত্রা ‘অসমতা হ্রাস’। এ লক্ষ্যমাত্রার ১০.২ নং সূচকে উল্লেখ “বয়স, লিঙ্গ, প্রতিবন্ধিতা, জাতিসত্তা, নৃ-তাত্ত্বিক পরিচয়, উৎস (জন্মস্থান), ধর্ম অথবা অর্থনৈতিক বা অন্যান্য অবস্থা নির্বিশেষে সকলের ক্ষমতায়ন এবং সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অন্তর্ভূক্তির কথা বলা হয়েছে”। এ বৈশ্বয়িক লক্ষ্য অর্জনে দেশের সকল বঞ্চিত ও নিগৃহীত মানুষদের ২ শতক জমির উপর নির্মিত গৃহের যৌথ মালিকা প্রদানের মাধ্যমে সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করা হচ্ছে।
দেশের সরকার প্রধান প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা “দেশের কোনো মানুষ গৃহহীন থাকবে না”। একটি দেশের সকল গৃহহীন মানুষকে আশ্রয় প্রদানের রাষ্ট্রীয় ঘোষণা বিশ্ববাসীর জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। এ কল্যাণমূলক উদ্যোগ বাস্তবায়নে রাষ্ট্রের সকল পক্ষকে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করতে হবে। আশ্রয়ণ প্রকল্পের নির্মাণ ত্রুটি ও অবকাঠামোগত দূর্বলতা শুধুমাত্র একটি রাষ্ট্রের মানবিক উদ্যোগকে প্রশ্নবিদ্ধ করার কূটকৌশল নয়, বরং সমাজের নিঃস্ব মানুষের অগ্রযাত্রা রোধ করার হীন চক্রান্ত। এরূপ অপকর্মের জবাবদিহিতা শুধুমাত্র ইহকালে নয়, বরং উপযুক্ত বিচার হবে পরকালে। মহান স্রষ্টার দরবারে। জয়হোক গৃহহীন ও বিপন্ন মানুষের।
লেখক: উপপরিচালক, সমাজসেবা অধিদফতর, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়

