মঙ্গলবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

রাজনীতি, রাজনৈতিক দল ও জননীতি

আহসান হাবিব
প্রকাশিত: ২১ নভেম্বর ২০২৩, ০৭:৩৪ পিএম

শেয়ার করুন:

আহসান হাবিব
আহসান হাবিব

২৮ অক্টোবর বিএনপির সমাবেশের মধ্যদিয়ে এমন কিছু কর্মকাণ্ড ঘটে যায় যার ফল দল হিসেবে বিএনপিকে সাধারণ জনগণের কাছেও প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর হামলা, হাসপাতালে হামলা, পুলিশের ওপর হামলা প্রভৃতি। যেসব গণমাধ্যমকর্মী পেশাগত কাজে বিএনপির সমাবেশ কভার করতে গিয়েছিল সেই গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর হামলা করে বিএনপি আসলে কি বোঝাতে চাইছিল তা বোঝা মুশকিল। নাকি অন্য কেউ হামলা করে বিএনপির মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খেতে চেয়েছিল সেটাও বোঝা মুশকিল। এক যুগ আগেও বিএনপি ও জামায়াতসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল বাসে আগুন দিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়েছে। এতে প্রাণ হারিয়েছে অনেক নিরীহ মানুষ। সাধারণ মানুষ মনে করেছিল বিএনপি হয়তো নিজেকে শুধরে নিয়েছে। কিন্তু না। এখনও বাসে আগুন দেওয়ার মতো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এবং হরতাল-অবরোধ চালিয়ে যাচ্ছে তারা। এর শেষ কোথায় তা জানে না কেউ। বিএনপির মহাসমাবেশের দিন থেকে আওয়ামী লীগও ঘরে বসে নেই। তারাও রাস্তায় রাস্তায় শোডাউন, মিছিল, মিটিং চালিয়ে যাচ্ছে।

অন্যদিকে নিত্যপণ্যের মূল্যের পাগলা ঘোড়া ছুটছে দানবের মতো। আলু থেকে শুরু করে পেঁয়াজ-মরিচ-শুঁটকি সবখানেই সিন্ডিকেট। রফতানি আয় কমতে কমতে তলানিতে। আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে সব মাত্রা ছাড়িয়ে। তৈরি পোশাক শিল্প খাতেও বিপর্যয়। প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স খাতে অবিরাম খরা। কোনো সূচকেই সুসংবাদ নেই। দেশে বর্তমানে যে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা চলছে, তার ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ। তাদের জীবন দুর্বিষহ। অথচ সেদিকে কোনো রাজনৈতিক দলের খেয়াল নেই। এরই মধ্যে হরতাল, অবরোধকে পেছনে ফেলে তফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন আগামী ৭ জানুয়ারি। তফসিল ঘোষণাকে কেন্দ্র করে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো একের পর এক কর্মসূচি দিয়ে যাচ্ছে। জ্বালাও-পোড়াও রাজনীতি চলছেই। এটা কি রাজনীতি না প্রতিহিংসা? এর ব্যাখ্যা কী?


বিজ্ঞাপন


দেশ থেকে অর্থ পাচার হচ্ছে। বিপর্যস্ত শেয়ার বাজারে মানুষের কোটি কোটি টাকা আটকে আছে। দেশে সিন্ডিকেট করে যে যেখান দিয়ে যেভাবে পারছে লুটপাট করছে। এসবের পরিণতিতে সব জিনিসপত্রের দাম এখন লাগামছাড়া। এভাবে একটা দেশ চলতে পারে না। এরপরও চলছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ ফণাতলা সাপের মতো ফুঁসে উঠছে না। আজ সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। অথচ এসব জনসম্পৃক্ত ব্যাপার নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা নেই। একমাত্র বাম রাজনৈতিক দলগুলো ছাড়া কারো কোনো কর্মসূচি নেই। তার মানে রাজনীতি জননীতি শূন্য হয়ে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন

গত পনেরো বছর ধরে বিএনপি ক্ষমতার বাইরে। এ সময়ে বারবার চেষ্টা করেও সরকারবিরোধী সফল আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি দলটি। এমনকি সরকারের অনেক বিতর্কিত কিংবা অজনপ্রিয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি তারা। বিএনপি তাদের চেয়ারপারসনকে জেলে নেওয়ার সময় কার্যত তেমন কোনো প্রতিরোধই গড়ে তুলতে পারেনি। খালেদা জিয়ার জেলে যাওয়ার পরে বিএনপির আন্দোলনের মধ্যে এক ধরনের অদূরদর্শিতা ও সমন্বয়হীনতা পরিলক্ষিত হয়েছে। অনেক সুযোগ পেয়েও সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্তের অভাবে বিএনপি আন্দোলনের ফসল ঘরে তুলতে পারেনি। কারণ, বিএনপি কখনই সাধারণ মানুষের পক্ষে কথা বলেনি। তারা শুধু তাদের নেত্রীকে নিয়েই ব্যস্ত। দেশের সাধারণ মানুষ যে অস্থির জীবনযাপন করছে সেদিকে তাদের কোনো খেয়ালই নেই।

 


বিজ্ঞাপন


রাজনীতির নামে পথেঘাটে হয়রানি করা এখন মানুষের জন্য বিরক্তিকর আইটেম। সাধারণ মানুষ এর থেকে পরিত্রাণ চায়। অথচ সাধারণ মানুষ মাঠে নামছে না। কেন নামছে না, তা আরেক প্রশ্ন। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি আর সেইসঙ্গে আয় কমে যাওয়ায় মানুষ এখন দিশেহারা। ডলারের দামে ঊর্ধ্বগতি। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। আগামীতে এই সংকট আরো বাড়বে। তার ওপর মানুষের নৈতিকতায়ও বেদম অবনতি। ধনীরা আরো ধনী হচ্ছে। দরিদ্ররা আরো দরিদ্র হচ্ছে। এর মাঝেও আমাদের যে পরিমাণ জাতীয় আয়, তা দক্ষ ব্যবস্থাপনায় ব্যয় করা গেলে বাইরের কারো কাছে হাত পাতা লাগে না। চুরি-দুর্নীতি, লুটপাট-পাচার রোধে ব্যবস্থা নিলেও এ খরা অনেকটা কেটে যেত। কিন্তু ক্ষমতাসীন বা বিরোধীদল কারো মধ্যেই এ বিষয়ে কোনো এজেন্ডা নেই। বিপরীত দিকে দুর্নীতিবাজ আর লুটেরারা অনেক বেশি শক্তিশালী।

দেশের চলমান রাজনীতির সমাধান অহিংস পথে হবে নাকি সংঘাতের মাধ্যমে হবে— তার ওপর নির্ভর করবে দেশের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ। উভয় দলের মধ্যেই বিধ্বংসী মনোভাব। চলমান রাজনীতির সমাধান না হলে দেশের অর্থনীতি আরো অন্ধকারে ডুববে। মূল্যস্ফীতির চাপ নির্দিষ্ট বা অল্প আয়ের মানুষের জন্য আরও কত দুর্বিষহ হয়ে উঠবে তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।

বড়াইমূলক ঘোষণা ছিল ‘খেলা’ নিয়ে। সেটা অবশ্য রাজনৈতিক ‘খেলা’। কূটনীতিও থাকতে পারে। ‘খেলা হবে-খেলা হবে’ করতে করতে খেলাটা চলে গেছে বাজারে। এ বাজারি খেলায় ধুলা ওড়াচ্ছে কথিত সিন্ডিকেট। আজ ডিম, কাল লবণ-মরিচ। পেঁয়াজ-আদা, চাল-ডাল-তেল। কিছুতেই ছাড় নেই। তাদের ওড়ানো ধুলায় চোখে অন্ধকার, মুখে বোবাকান্না নিরন্ন ও মধ্যবিত্তদের। ধনাঢ্যদের কথা আলাদা। কারণ তাদের আছে অঢেল টাকা। এ চক্র আচ্ছা খেলোয়াড়। এ খেলার মধ্যে ধুলা ওড়ানো অতি খেলোয়াড়রা সমানে পেনাল্টি মারছে মানুষকে। ঘায়েল করছে সরকারকেও। চাল, ডাল, তেল, নুন, চিনি, আটা, ময়দা, আদা, পেঁয়াজ, রসুন— সবকিছু নিয়েই খেলছে সমানে। ফ্রি স্টাইলে ধুলা ওড়াচ্ছে। ডিমের বাজারেও দফায়-দফায় তাদের হাটটিমা-টিম গেমের শিকার মানুষকে বোবা দর্শক হয়েই থাকতে হচ্ছে।

দুহাতে অর্থ হাতানোর এ পদ্ধতিতে চাহিদা, জোগানের পরিমাণ, কে সরবরাহকারী, কে বিপণনকারী, কে ভোক্তা— এসবের কোনো বালাই নেই। শিকার ধরাই আসল। বাজার নিয়ন্ত্রক সিন্ডিকেটের কাছে বাদবাকিরা কেবলই শিকারের বস্তু। বাজার চড়ানোর পেছনে শীত-গরম, বৃষ্টি-খরা, মন্দা-যুদ্ধসহ হরেক অজুহাত তাদের হাতে থাকে। বাজারে চাহিদার বিপরীতে জোগান কমে যাচ্ছে নাকি কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তাও বিবেচনার বিষয়। মানুষকে আপসেই নিজের চোখে নিজে মলম মেখে বোবাকান্না কাঁদতে হচ্ছে। একবার পেঁয়াজ, আর একবার মরিচ, কখনো ডিম তো কখনো মুরগি! এক মাসে তেল আরেক মাসে ডাল— চক্রাকারে চক্রশূলে চড়ছে। বাজারে অনিয়ম-নৈরাজ্য এতটাই যে সেখানে আগুন-পানিও আর নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় না। সিন্ডিকেট কোনোমতেই দমে না।

আরও পড়ুন

এদিকে সমাবেশের সহিংসতার রেশ কাটতে না কাটতেই লাগাতার অবরোধের মতো সহিংস কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে দলটি। বিএনপি যেভাবেই ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করুক না কেন, ভুলে গেলে চলবে না চিরাচরিত নিয়ম অনুযায়ী, কর্মসূচি যার সেই কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ঘটা সব দায়দায়িত্ব তার ঘাড়েই বর্তায়। কাজেই এই অবরোধ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে মৈত্রী এক্সপ্রেসের ট্রেনে যখন আক্রমণ করা হয় তখন প্রতিবেশী রাষ্ট্রের কাছে বিএনপির ভাবমূর্তিই বিনষ্ট হয়। আগেও আমরা দেখেছি, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের এক প্রভাবশালী নেতার ফোনকলকে কেন্দ্র করে কিংবা সেই দেশের রাষ্ট্রপতির সাথে সাক্ষাৎকে কেন্দ্র করে যে অস্বস্তিকর পরিস্থিতির অবতারণা হয়েছিল তা থেকে তো দলটি বের হতে পারেইনি, বরং ট্রেনে আক্রমণ সেই অস্বস্তিকর পরিস্থিতির আগুনে ঘি ঢালার মতো।

একটি বিষয় না বললেই নয়, সেটা হচ্ছে— রাজনীতিকে যুগোপযোগী করা। এই কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, দল হিসেবে বিএনপির কর্মী রয়েছে, সমর্থক রয়েছে। কাজেই এই কর্মী কিংবা নীরব সমর্থকদের কাজে লাগাতে হলে অবশ্যই বিএনপির নেতৃত্বকে চিন্তাধারা ও কর্মপন্থা যুগোপযোগী করতে হবে। কোনো বিশেষ এক পন্থার কর্মসূচি ১৫ বছর আগে সফল হয়েছে বলে এখনও সফল হবে— এই ধরনের চিন্তা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। সহিংস কর্মসূচির বদলে জনসম্পৃক্ত কর্মসূচি পালনে অধিক মনোযোগী হতে হবে। নির্বাচনমুখী দল বিএনপি নির্বাচন বর্জন করে ক্রমশ জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে দেশের মানুষ করোনার পর থেকেই দ্রব্যমূল্যের চাপে চিড়ে-চ্যাপ্টা, তা নিয়ে তাদের কোনো প্রোগ্রাম নেই। যেসব কর্মসূচি দিয়ে মানুষের কাছাকাছি যাওয়া যায় তা না দিয়ে হরতাল-অবরোধ দিয়ে মানুষকে শঙ্কায় ফেলা হচ্ছে। করোনার সংকট থেকে আসা শিক্ষাকে আবার ঝুঁকির মুখে ফেলা হচ্ছে। বিএনপির নীতিনির্ধারকরা যদি এই সত্য অনুধাবনে ব্যর্থ হয় তাহলে রাজনীতির চিরাচরিত নিয়ম অনুযায়ী চড়া মাশুল দিতে হবে দলটিকে।

লেখক: আহসান হাবিব, সাংবাদিক ও কলামিস্ট

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর