পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া আকাশটা যেন নীরবে কাঁদছিল সেদিন। একটি প্রশিক্ষণ বিমান হঠাৎ করে হুমড়ি খেয়ে পড়ল স্কুল ক্যাম্পাসে। মুহূর্তেই আগুন, আর্তনাদ, দৌড়াদৌড়ি। মাইলস্টোন স্কুলের শিশুদের কারও বই ছিল হাতে, কারও পকেটে চকোলেট, কারও চোখে ছিল শুধু আনন্দ আর দুষ্টুমি।
একটু পরেই ছুটি হবে। বাইরে অপেক্ষায় থাকা মা-বাবাকে জড়িয়ে ধরবে। কিন্তু তারা জানত না, ওটাই হবে তাদের শেষ দৌড়, শেষ হাসি। তারা জানত না- মা-বাবার বুক পর্যন্ত তারা যেতে পারবে না। এর আগেই হারিয়ে যেতে হবে চীরতরে।
বিজ্ঞাপন
বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে আগুন যেন গিলে ফেলল এক ঝাঁক শিশুর জীবন, কয়েকশ পরিবারের বেঁচে থাকার স্বপ্ন।
আরও পড়ুন: ‘টিফিন দিতে পারিনি বলেই হয়তো বেঁচে গেছে আমার ছেলেটা’
আর চারপাশে? কেউ ছবি তুলছে, কেউ ‘ফেসবুক লাইভ’, কেউ ৩০ টাকার রিকশাভাড়া চাচ্ছে ২০০ টাকা। পানির বোতলের দাম হয়ে গেছে ২০ থেকে ১৫০! মৃত্যুর কাছে দাঁড়িয়ে যেন এক নিষ্ঠুরতার হাট বসেছে।
কিন্তু…
বিজ্ঞাপন
লেলিহান সেই আগুনের মধ্যে জন্ম নিল এক মানবতা। মেহেরীন চৌধুরী। শিক্ষিকা, তারচেয়েও বড় পরিচয়—একজন মা।
শিশুরা চিৎকার করছিল, কেউ নিস্তেজ, কেউ অচেতন। আর তিনি? ছুটলেন আগুনের দিকে—জীবনকে উপেক্ষা করে। গায়ে আগুন জ্বলছিল, তবু হাত বাড়িয়ে একটার পর একটা ক্ষুদ্র শরীর বের করতে থাকলেন।
জানেন, একজন মানুষ কতবার আগুনে হাত ঢুকিয়ে অন্যকে বের করতে পারে? ততবার, যতবার সে একজন ‘মা’।
শেষবারের মতো মাটিতে পড়ে গিয়ে, দগ্ধ চোখজোড়া যেন প্রশ্ন করছিল— ‘আর কেউ কি রইল আগুনে?
এক সাংবাদিক ঝুঁকে প্রশ্ন করল- ‘এত বড় ঝুঁকি নিলেন? নিজের সন্তানদের কথা একবারও ভাবেননি?’ তার কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে এলো- ‘যাদের বাঁচাতে গিয়েছিলাম… ওরাও তো আমারই সন্তান।’
আরও পড়ুন: আগুনে ঝাঁপ দিয়ে মেয়েকে বের করে নিয়ে আসেন বাবা
তারপর? নীরবতা। এক মহান আত্মত্যাগের গর্বমাখা নীরবতা। একটা জ্বলন্ত আকাশের নিচে, সময়ও থেমে দাঁড়াল মাথা নিচু করে— নীরবে শ্রদ্ধা জানাতে এক মায়ের মহাকাব্যিক বিদায়কে।
সেদিন যারা শুধুই দেখছিল, বাণিজ্য করছিল, তাদের হৃদয়ে কি পোড়ার গন্ধ ঢুকেছিল—জানি না।
কিন্তু আমরা যারা সেই আগুনে একজন মায়ের আত্মত্যাগ দেখেছি, তারা জানি—
সেদিন মেহেরীন চৌধুরী আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছেন, মা কাকে বলে। মানুষ কাকে বলে।
মেহেরীন চৌধুরী, আপনি শুধু শিক্ষক নন— আপনি এই জাতির বিবেক, হৃদয়ের দীপ্ত আলো।
আপনি প্রমাণ করেছেন— মায়েরা সৃষ্টি হন জ্বলতে জ্বলতে আলো ছড়ানোর জন্য। সেদিন, সেই পোড়া আকাশের নিচে আপনি নিজে পুড়ে জ্বেলে দিয়েছিলেন আশা ও মানবতার বাতি।
আপনার আগুনই আজ আমাদের পথের আলো, এই ঘন অন্ধকারেও এগিয়ে যাওয়ার সাহস।

