সোমবার, ১৪ জুলাই, ২০২৫, ঢাকা

নাগরিক প্রতিবেদন

১০০ ফিট মাদানি এভিনিউ: পৃথিবীর বুকে যেনো চাঁদের রাস্তা

জয়া সরকার
প্রকাশিত: ১৮ জুন ২০২৫, ১২:০০ পিএম

শেয়ার করুন:

100 feet road

দিনপঞ্জির পাতায় জানান দিচ্ছে আষাঢ় এসেছে। অথচ মাথার ওপরে অকৃপণভাবে সূর্য তাপ বিকিরণ করে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে একটু পরপর চোখের সামনে ধুলায় আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে। দুই পায়ের দিকে তাকালে মনে হবে যেনো চাঁদের বুকে দাঁড়িয়ে আছি। বলছিলাম ১০০ ফিট সড়কের কথা। রাজধানী ঢাকার অন্যতম একটি ব্যস্ত সড়ক হলো ভাটারা থানার পাশ ঘেঁষা ১০০ ফিট অভিমুখী সড়কটি। যার পোশাকি নাম মাদানি এভিনিউ। থানার ঠিক বিপরীত পাশেই সৌদি আরব দূতাবাস। বৈদেশিক দূতাবাসের সামনে অবস্থিত এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কের বেহাল দশা কোনোভাবেই দেশের ভাবমূর্তির জন্য ইতিবাচক নয়। সড়কটির আশেপাশেই আরো কয়েকটি দেশের দূতাবাস। এমতাবস্থায় প্রশাসনের ভাবলেশহীন আচরণ, সড়কটি সংস্কারের সদিচ্ছার অভাব বেশ পরিষ্কারভাবেই দৃষ্টিগোচর হবে যে কারো।

আরও পড়ুন: চলাচলের উপযোগিতা হারিয়েছে গুলশানের ঝিলপাড় সড়কটি


বিজ্ঞাপন


সড়কটি দিয়ে একটু সামনে এগিয়ে গেলেই দুই ধারে সারিবদ্ধভাবে বিভিন্ন দোকানের দেখা মেলে। এগুলোর মধ্যে সিংহভাগই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের। প্রতিদিন এই সড়ক জুড়ে আনাগোনা চলে অগণিত মানুষ এবং যানবাহনের। অথচ দীর্ঘদিন ধরে সড়কটি বেহালে আছে। সময়ের হিসাবে সেটি প্রায় এক বছর। শুধু খানাখন্দই নয়, রাস্তার ধারের ড্রেনগুলো থেকে ময়লা  উঠিয়ে ফুটপাতের ওপর রাখা হয়েছে। যার ফলে দুর্গন্ধের কারণে পথচারী ও স্থানীয়দের নানা দুর্ভোগে পরতে হচ্ছে। 

5
দীর্ঘদিন ধরে বেহালে আছে ১০০ ফিট সড়ক। ছবি: লেখক

বিগত বর্ষা মৌসুমের ন্যায় চলমান বর্ষা মৌসুমেও এই ভোগান্তি আরও দ্বিগুণ হবে একথা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় গত ১ বছর আগে পানির পাইপ লাইন বসানোর জন্য ওয়াসা কর্তৃপক্ষ রাস্তাটি খনন করে। সেই থেকে সড়কটি এমন অবস্থায় পড়ে আছে। পাইপ লাইন বসানোর বসানোর কাজ সঠিকভাবে সম্পন্ন হয়েছে কিনা বা আদৌও কবে হবে  এ ব্যাপারে  কেউ কিছু জানেন না।

আরও পড়ুন: অপরিকল্পিত আবাসনে জলাবদ্ধতা ঝুঁকিতে গুলশান-বনানী


বিজ্ঞাপন


মাঝেমধ্যে সড়কটি আরো বৃহৎ পরিসরে খনন করার জন্য ওয়াসার লোকজন আসেন। কিন্তু কোনো প্রশ্নের উত্তর তারা দেন না কখনোই।  শাহজালাল (৪০) নামের একজন অটোরিকশা চালক জানান, এই রাস্তা দিয়ে নিয়মিত যাত্রী পরিবহন করেন তিনি। রাস্তার বেহাল অবস্থার জন্য ঠিকমতো অটোরিকশা চালাতে কষ্ট হয়। অগের তুলনায় যাত্রী সংখ্যা যেমন কমেছে, তেমনিভাবে রিকশার অবস্থাও খারাপ হচ্ছে। যাত্রী পরিবহনে স্বাভাবিকের চাইতে অনেক বেশি সময় লাগছে। এতে করে তার রোজগার অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে। 

3
পিচ ঢালাই উঠে গিয়ে ইট বের হয়ে গেছে সড়কটির।

একই অভিযোগ করেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় একজন দোকানি। তার ভাষ্যমতে, গেলো ৫ আগস্টের পর অনেক কিছুরই পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু  এখানকার স্থানীয় ও দোকানিদের অবস্থার দিনদিন অবনতি হচ্ছে। খানাখন্দে পরিপূর্ণ পথ দিয়ে প্রতিনিয়ত কয়েকবার তাকে যাতায়াত করতে হয়। এতে করে শারিরীকভাবে তিনি বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। 

১০০ ফিটের সড়কটি যেনো ধুলার রাজ্যে পরিণত হয়েছে। যেকোনো সুস্থ মানুষ সড়কটি দিয়ে প্রতিদিন একবার করেও যদি যাতায়াত করেন তবে খুব দ্রুতই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়বেন। তিনি আরো জানান রাস্তাটির এমন অবস্থার জন্য ভালো কোনো ক্রেতা সেখানে আসতে চান না। ফলে বিক্রি অনেকটাই পড়তির দিকে। সমস্যা থেকে সাময়িক নিস্তার পেতে তিনিসহ আশেপাশের দোকানিরা মিলে প্রতিদিন ৫০ থেকে ১০০ টাকা চাঁদা দিয়ে ওয়াসা থেকে পানি কিনে নিয়মিত রাস্তায় ছিটানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। সাময়িকভাবে ধুলাবালি থেকে নিস্তার মিললেও ব্যয়বহুল হওয়ায় বেশিদিন এই ব্যবস্থা চালু রাখা সম্ভব হয়নি। 

road_7
সড়কটি দিয়ে চলাচলকারীদের ভোগান্তি নিত্যদিনের

এক্ষেত্রে ওয়াসার ভূমিকা যেনো ‘সর্প হয়ে দংশন করো, ওঝা হয়ে ঝাড়ো’ গানের কথাটির মতো। প্রতিকারের আশায়  প্রতিবাদ মিছিল নিয়ে ভাটারা থানা অভিমুখে গেলেও সেখান থেকে তারা আশানুরূপ কোনো সাড়া পাননি।  থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) তাদেরকে সিটি করপোরেশনের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন। কারণ সড়কের নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর ন্যস্ত। সড়ক মেরামতের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের আওতাধীন। থানার পক্ষ থেকে করণীয় কিছুই নেই। 

কিন্তু ভুক্তভোগীরা জানেন না সেখানে কার সঙ্গে বা কোথায় যোগাযোগ করলে আশু সমাধান মিলবে। কেননা, ৫ আগস্টের পর কার্যতপক্ষে সিটি করপোরেশনে কোনো মেয়র না থাকায় কার্যক্রমে অনেকাংশেই স্থবিরতা বিরাজ করছে। কিছুদিন আগে দেশের প্রথম সারির একটি গণমাধ্যম এসে সরেজমিনে প্রতিবেদন তৈরি করলেও সেটি সম্পর্কে কোনো অগ্রগতি তারা জানেন না। 

road
বৃষ্টি হলে কাদা হয়। আর ধুলার রাজত্ব অন্য দিনগুলোতে।

ধুলাময় ভাঙ্গাচোরা পথ ধরে  কিছুদূর এগিয়ে যেতেই দেখা মিললো সদ্য কৈশোর উর্ত্তীণ এক তরুণের। কথায় কথায় জানালেন ১২ বছরের ধরে চলা একটি গাড়ির তেল বিক্রির দোকানে তিনি ৮ বছর ধরে কাজ করছেন। ধুলার আধিক্যে নিয়মিত দোকানে বসা খুবই কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। উপরন্তু সড়কটির দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থায় আগের থেকে গাড়ির তেল বিক্রি অর্ধেকে নেমে এসেছে। কারণ খুব প্রয়োজন না হলে এই পথে কেউ সহজে গাড়ি নিয়ে আসতে চাননা। এই অবস্থায় দোকান ভাড়া পরিশোধ করে জীবিকা নির্বাহ করা কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। তরুণ দোকানির সঙ্গে কথোপকথনের এক পর্যায়ে তাওফিকুজ্জামান (৩৫) নামের একজন এগিয়ে এলেন। 

দারাজে কর্মরত এই ব্যক্তি ভোগান্তির সম্মুখীন হওয়ার কথা স্বীকার করলেও তার বক্তব্যে কিছুটা আশাবাদী মনোভাবের আভাস পাওয়া যায়। তিনি বলেন, সাময়িক ভোগান্তির মাধ্যমে যদি রাস্তার উন্নয়ন হয় তাহলে তিনি দেশের নাগরিক হিসেবে সেটি মেনে নিবেন।

road6
১০০ ফিট নামে পরিচিত এই সড়কটির মতো বেহালে আছে ফুটপাতও।

উল্লেখ্য যে, গত ১২ মার্চ রমজান মাসের দুপুরবেলা স্থানীয় দোকানি এবং লোকজন মিলে এই রাস্তা আটকে আন্দোলন করেছিলেন। তাদের দাবি ছিল সংস্কার কাজের নামে তারা প্রতিনিয়ত ধুলার অত্যাচারে অত্যাচারিত হচ্ছেন। অথচ প্রশাসন এ ব্যাপারে সবকিছু দেখেও নির্বিকার। রাস্তায় পানি ছিটানোর মতো সামান্য কাজটুকুও তারা করতে গড়িমসি করছে। তাই বাধ্য হয়ে প্রতিবাদস্বরূপ তারা রাস্তায় যানচলাচল বন্ধ রেখেছেন। তবে আশ্চর্যজনক ব্যাপার হচ্ছে গত ১৫ জুন সরেজমিনে তথ্য সরবরাহের জন্য গেলে সেই প্রতিবাদের ব্যাপারে কথা বলতে গেলে স্থানীয় দোকানিরা কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। অনেকে বলেই বসেন এমন কোনো প্রতিবাদ সেখানে হয়নি। এক দুইজন অবশ্য বলেন প্রতিবাদটিতে স্থানীয়দের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। পাশ্ববর্তী সাইদনগরের কিছু বাসিন্দা এবং ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির কিছু শিক্ষার্থীদের ইন্ধনে আন্দোলনটি হয়েছিল। তবে সড়কটি নিয়ে অভিযোগের কোনো শেষ না থাকলেও অজানাকারণবশত অধিকাংশ মানুষই এটি নিয়ে কথা বলতে চাননি। 

এত নিরাশার মাঝেও ফুটপাত ঘেঁষে কাপড়ের দোকান দেয়া একজন দোকানি জানালেন ভিন্ন কথা। তিনিও ১২ বছর ধরে এখানে ব্যবসা করছেন। তার মতে, রাস্তার অবস্থা খারাপ থাকলে সেটি ফুটপাতের দোকানগুলোর জন্য লাভজনক। রাস্তায় নিয়মিত যান চলাচল করলে তখন দোকান বসানো কঠিন হয়ে যায়। তবে মেট্রোরেল হতে পারে এখানে, আর সেটি যদি হয় তাহলে সড়কের আশেপাশের দোকানগুলো ভাঙ্গা পড়বে। অবশ্য ক্ষতিগ্রস্ত দোকানিরা ক্ষতিপূরণ পাবেন। এজন্য ইতিমধ্যেই তিনি প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিয়েছেন। 

road2
এই সড়কটির জন্য এখানকার বাসিন্দাদের দুর্ভোগ পিছু ছাড়ছে না

তিনি আরো জানান, লোকমুখে তিনি শুনেছেন রাস্তা সংস্কারের কাজটি বর্তমানে সেনাবাহিনী হাতে নিয়েছে। মাঝেমধ্যে রাতে সেনাবাহিনীকে টহল দিতে দেখা যায়। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক তরুণ জানালেন রাত হলেই এখানে ছোটখাটো পরিসরে মাদকের আসর বসে। সেনাবাহিনীকে সেখানে টহল দিতে দেখা যায়। সেকারণে মাদকের আসর উচ্ছেদ করা নাকি রাস্তা সংস্কার করা সেটি এখনও পরিষ্কারভাবে বলা যাচ্ছে না।

আমরা সকলেই জানি যে চাঁদে কোনো বাতাস নেই, আর প্রাণের অস্তিত্ব না থাকায় সেখানে বায়ু দূষণ ও শব্দ দূষণের অস্তিত্বও নেই। চাঁদের এবড়োথেবড়ো পথে চলাচলের ঝক্কি-ঝামেলাও কাউকে পোহাতে হয়না। কিন্তু ১০০ ফিটের পথটি দিয়ে নিয়মিতভাবে যারা চলাচল করেন তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি পূববর্তী যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে একথা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। তবে একথা মোটামুটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, রাজনৈতিক পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে সহসাই ১০০ ফিট রা¯তার সমস্যার সমাধান হচ্ছেনা। 

লেখক: বেসরকারি চাকরিজীবী

 

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর