প্রাকৃতিকভাবে অর্ধশতাধিক খাল ও নদীবেষ্টিত রাজধানীর বেশিরভাগই দখল-দূষণের শিকার। যার মূলে রয়েছে অপরিকল্পিত নগরায়ণসহ নিম্নভূমি ভরাট করে আবাসন কোম্পানিগুলোর বাণিজ্য। এতে বৃষ্টির পানি সহজেই নেমে যেতে পারে না। ফলে বিভিন্ন স্থানে দেখা দেয় জলাবদ্ধতা। সঙ্গে ভোগান্তি বাড়ে নগরবাসীর।
স্বাভাবিক বর্ষণেও নগরীতে জলাবদ্ধতা যেখানে চিরচেনা রূপ, সেখানে ভারী বর্ষণে স্থবির হয়ে পড়ে প্রায় পুরো রাজধানী। ঢাকা মহানগরের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) তথ্য বলছে- বেসরকারি আবাসন প্রকল্পগুলো নিম্নাঞ্চল ভরাট করে গড়ে তুলছে স্থাপনা। সঙ্গে কমছে ভূমির প্রাকৃতিক ঢাল। এতে রাজধানীর অভিজাত এবং পরিকল্পিত এরিয়া হিসেবে খ্যাত গুলশান-বনানীর মতো এলাকায়ও সৃষ্ট হতে পারে জলাবদ্ধতা। সবমিলিয়ে বাড়ছে জলাবদ্ধতার শঙ্কা।
বিজ্ঞাপন
প্রতিষ্ঠানটি থেকে পাওয়া তথ্য মতে- ভূমি উন্নয়নে তল সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫ দশমিক ৫ মিটার। আর এই অঞ্চলের (গুলশান-বনানী) গড় বন্যার তল সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬ দশমিক ১ মিটার উঁচু। ফলে এখানে মানব নিয়ন্ত্রিত কর্মকাণ্ডে জলাবদ্ধতা ও বন্যার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। বর্তমানে এই অঞ্চলের (গুলশান-বনানীর আশপাশ) বেশকিছু এলাকার জলাবদ্ধতাই এর প্রমাণ।
এছাড়াও ড্যাপ আরও বলছে- গুলশান-বনানী ছাড়াও আশপাশের এলাকায় পর্যাপ্ত কমিউনিটি সুবিধার (নাগরিক সুবিধা) অভাব রয়েছে। সেই সঙ্গে নেই বর্জ্য ফেলার নির্দিষ্ট স্থান। সাথে রয়েছে উন্নতমানের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার অভাব। পাশাপাশি এই অঞ্চলে পরিকল্পিত উন্নয়নমূলক নানা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে গিয়েও বিভিন্ন বাধার সম্মুখীন হতে হয় খোদ সরকারি সংস্থাগুলোকে। যার ফলে এখানে ভূগর্ভে বর্জ্য স্থানান্তর কেন্দ্র বা সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশনের বিষয়টিও ঝুলে আছে।
এ ব্যাপারে ডিএনসিসির প্রধান বর্জ্য কর্মকর্তা এস এম শরীফ-উল-ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, সেনাবাহিনীর মাধ্যমে বাংলাদেশ মেশিন ট্যুলস ফ্যাক্টরি সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন বা ভূগর্ভে বর্জ্য স্থানান্তরের বিষয়ে কাজ করছে। একটি নকশা প্রণয়ন করা হয়েছে। তবে এখনো এটা অনুমোদিত হয়নি। শহরের সবাই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা চায়, কিন্তু বর্জ্য স্থানান্তর কেন্দ্র করার জন্য কেউ জায়গা দিতে চায় না।
ডিএনসিসির এই কর্মকর্তা বলেন, আমরা বেশ কয়েকটি জায়গায় বাধার সম্মুখীন হয়েছি। তাই আমরা চাচ্ছি এটা একেবারে ভূগর্ভে নিয়ে যেতে, যাতে কেউ দুর্গন্ধ না পায়। যদিও এর আগে একই নিয়মে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) হাজারীবাগ ও মেরাদিয়ায় প্রায়ই একই ধরনের দুটি বর্জ্য স্থানান্তর কেন্দ্র নির্মাণ করেছিল। তবে বড় ধরনের কারিগরি ত্রুটির কারণে তা আর ব্যবহার করা যায়নি।
বিজ্ঞাপন
এ নিয়ে নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, ঢাকা দেশের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক, রাজনৈতিক, শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। ফলে অসহনীয়ভাবে জনঘনত্ব বেড়েছে। অন্যদিকে দেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা লাভ করার পথে। উন্নত রাষ্ট্র গঠনের এই উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় রাজধানী ঢাকার এই পরিকল্পনার সুষ্ঠু বাস্তবায়ন প্রয়োজন। সেই সঙ্গে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) ঢাকা মহানগর এলাকার ‘বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) ২০২২-২০৩৫ যথাযথ বাস্তবায়নের দাবিও জানিয়েছেন তারা।
অন্যদিকে, বিশেষজ্ঞরা বলেছেন- এবারের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় আধুনিক নগর পরিকল্পনার বেশকিছু কৌশল যেমন: ব্লক ডেভেলপমেন্ট, কমিউনিটিভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনা ও সেবার বিকেন্দ্রীকরণ, মেট্রো স্টেশনভিত্তিক ট্রানজিট ওরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্ট (টিওডি), জনঘনত্ব পরিকল্পনা, ট্রান্সফার অব ডেভেলপমেন্ট রাইট (টিডিআর), ওয়ার্ডভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা এবং মানসম্পন্ন সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিনোদনকেন্দ্র সৃষ্টি, পথচারীবান্ধব পরিকল্পনা, পরিবেশ সংরক্ষণ প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ স্থান পেয়েছে, যা নগরবাসীর জীবনমান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। বাংলাদেশের ঢাকাসহ বিভিন্ন নগর এলাকার পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হলেও ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত জনসংখ্যার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও নাগরিক সুবিধাদির প্রকট অভাবের কারণে নগর এলাকাসমূহ বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। এই বাস্তবতায় এবারের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় শহরের টেকসই উন্নয়ন ব্যবস্থাপনা ও বাসযোগ্যতা বাড়াতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
বিষয়টিতে নগর বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মোহাম্মদ খান ঢাকা মেইলকে বলেন, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে নগরায়ণ প্রক্রিয়া খুব দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। শুধু ঢাকার মতো বড় শহরেই নয়, নগর, বন্দর কিংবা মফস্বল এলাকা ছাড়াও এর আশপাশেও অপরিকল্পিত নগরায়ণ গড়ে উঠছে। তবে এই বৃদ্ধির ধারা সব জায়গায় সমান নয়।
সার্বিক বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুহাম্মদ মেহেদী আহসান ঢাকা মেইলকে বলেন, অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে ঢাকা শহরে তিল পরিমাণ স্থান খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়েছে। এখানে পাহাড়সম সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। বাসস্থানের অভাবের ফলে গড়ে উঠছে ভাসমান মানুষের বস্তি। যার ফলশ্রুতিতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের সৃষ্টি হচ্ছে।
শেখ মুহাম্মদ মেহেদী আহসান বলেন, এ শহরে ময়লা-আবর্জনা-দুর্গন্ধ ইত্যাদি নিত্যদিনের সঙ্গী। শহরের বিপুল জনসংখ্যার বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে গিয়ে অবৈধ দখলদারিত্ব বেড়ে চলেছে আশঙ্কাজনক হারে। লেক ও নদীর পাড়গুলো দখল করে নিচ্ছে কিছু অসাধু লোক। যার ফলে নদী হারাচ্ছে নাব্যতা, লেক হচ্ছে দূষিত। ফলশ্রুতিতে ঢাকা শহরে জলাবদ্ধতার মতো সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে।
এমন পরিস্থিতির মাঝে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) গুলশান-বনানী এলাকায় জলাবদ্ধতার ঝুঁকি এড়াতে কিছু সমাধানও দিয়েছে। রাজউকের বাস্তবায়নাধীন প্রকল্প ড্যাপ বলছে- গুলশান-বনানী ছাড়াও নিকেতনসহ আশপাশে (উপ-অঞ্চলে) গুলশান লেক, বনানী লেক এবং হাতিরঝিল লেক থাকায় বিভিন্ন ধরনরে বিনোদন কার্যক্রম গ্রহণ করা যেতে পারে। এছাড়াও এই উপ-অঞ্চলে কুড়িল ফ্লাইওভার থেকে পূর্বাচল ৩০০ ফুট সড়কের উভয় দিকে ১০০ ফুট প্রশস্ত লেক নির্মাণাধীন রয়েছে। যা অঞ্চলটিতে নাগরিকদের বসবাসের উপযোগিতা বাড়াতে সহায়ক হবে।
গুলশান-বনানী এলাকায় পরিকল্পিত নগর গড়তে পাঁচটি উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে ড্যাপ। এগুলো হলো-
১. নিয়ন্ত্রিত উপায়ে মিশ্র ভূমি ব্যবহারে প্রসার।
২. গুলশান ২ চত্বর থেকে হাতিরঝিল সংযোগ সড়ক পর্যন্ত সাইকেলেরে পথ তৈরি করা যেতে পারে। এছাড়া গুলশান ১, গুলশান ২ এবং নিকেতন এলাকায় এনএমটি ও পথচারী চলাচল প্রকল্প নিতে হবে।
৩. যে কোনো উপায়ে গুলশান লেক, বনানী লেক এবং হাতিরঝিল লেকের সমন্বয়ে ওয়াটার ট্যাক্সি সার্ভিস চালু করতে হবে।
৪. গুলশান, বনানী এবং বারিধারা আবাসিক এলাকার জন্য পরিবহণ, পরিবেশ, জন ঘনত্ব এবং বাণিজ্যিক চাহিদা ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে রাজউক কর্তৃক প্রস্তুতকৃত লেআউট পরিমার্জন প্রকল্প গ্রহণ করা জরুরি।
৫. ড্যাপ প্রদত্ত সারণির ২.১.২৬ এ উল্লেখিত নাগরিক সুবিধাসমূহ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে।
ডিএইচডি/আইএইচ