খোলামেলার দেশ ব্যাংকক। সব কিছুই হয় জনসম্মুখে। অবাধ মেলামেশা নারী-পুরুষের। ধার্মিক লোক, বিশেষ মুসলিম নারী পাওয়া দুষ্কর— এমন গাল-গল্প শুনেছি অনেকের মুখে। কিন্তু থাইল্যান্ডের পাতায়া ও ব্যাংকক ঘুরে সেই ধারণায় ছেদ পড়ল। নিজ চোখে দেখার পর পাল্টে গেল লোকমুখে শোনা গল্পগুলো। বলে রাখা উত্তম, থাইল্যান্ডে নানান জাতি, ধর্ম ও বর্ণের মানুষের মিলনমেলা। বিভিন্ন দেশ থেকে ট্যুরিস্টরা আসেন বেড়াতে। এই লেখায় শুধু ব্যাংকক ও পাতায়ার দৃশ্যপট তুলে ধরার চেষ্টা করব।
থাইল্যান্ড সফরের তৃতীয় দিন আমরা ব্যাংকক গেলাম। হোটেলের কাজ শেষে রাতের খাবার সারলাম। ১২টা বাজতে তখনো অনেক দেরি। এই সুযোগে কয়েকজন সফর সঙ্গীকে নিয়ে ব্যাংককের রাস্তাঘাট, দোকানপাট ও মার্কেট দেখতে বের হলাম। হোটেলের সামনের রাস্তা ধরে হাঁটলাম। কিছু দূর যেতে এক সহকর্মী বললেন, তার ছোট্ট শিশুটার জন্য কিছু জিনিস কিনতে চান। কথা শেষ হতে না হতেই চোখ আটকাল পাশের একটি লেডিস মার্কেটে। ছোট এই মার্কেটে শিশু, নারী, যুবক ও বৃদ্ধ— সবার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র মেলে। তবে বেশি পাওয়া যায় নারী ও শিশুদের। একটু সামনে যেতেই মার্কেটের গেটে পৌঁছালাম। বাইরে ঝিরঝির বৃষ্টি।
বিজ্ঞাপন

গেটে পৌঁছাতেই অটো খুলে গেল গ্লাসের দরজা। কোনো সিকিউরিটি গার্ড নেই। একটু অবাক হলাম ছোট এই মার্কেটেও আধুনিকতার ছোঁয়া! যাহোক, মার্কেটের ভেতরে ঢুকতেই বিভিন্ন ধরনের ব্যাগ ও কসমেটিকসে চোখ পড়ল। দামও বেশ চড়া। এবার আরেকটু ভেতরে ঢুকলাম। সামনে পড়ল আতরের দোকান। বিস্মিত হলাম। দোকানে হিজাব পরিহিতা দুই নারী সেলম্যান। কিছুটা আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে গেলাম দোকানের দিকে। আতর কেনার ছলে বেশ কিছুক্ষণ গল্প হলো তাদের সঙ্গে। তাদের একজন মারিয়া তাবাসসুম। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ফাঁকে পার্টটাইম কাজ করেন আতরের দোকানে। অপরজন সুমাইয়া। তিনি জানান, এই দোকানে দীর্ঘদিন কাজ করছেন তারা। গল্পের ফাঁকে জানতে চাইলাম হিজাব পরায় কোনো বাধার সম্মুখীন হয়ে হয় কি না। সানন্দে জবাব দিলেন, সমস্যা হবে কেন? এটা তো আমাদের অধিকার।
আরও পড়ুন: পাতায়া বিচ যেভাবে পর্যটনের দুয়ার খুলেছে
তাদের কাছ থেকে জানা গেল, থাইল্যান্ডে বসবাসকারী মুসলিম নারীরা হিজাব পরেই বাইরে বের হন। এটা নিজ নিজ পারিবারিক শিক্ষা। সরকারের পক্ষ থেকে কোনো বাধা নেই। তাদের মতে— আমি মুসলিম। আর এটা আমার পোশাক। মারিয়া বলছিলেন, ছোট বেলা থেকেই হিজাব পরেন তিনি। তারা দুই বোন এক ভাই পারিবারিক সব শিক্ষাই পেয়েছেন মায়ের কাছ থেকে। মা-ই শিখিয়েছেন হিজাব করা। গল্পে গল্পে রাত পেরোতে লাগলো। এরপর হোটেলে ফেরার পালা।
বিজ্ঞাপন
ব্যাংককের দ্বিতীয় দিন। বের হলাম সেন্ট্রাল মস্ক অব থাইল্যান্ড দেখার জন্য। আশপাশের পুরো এলাকায় মুসলমানদের বসবাস। এখানে সত্যতা পেয়েছি সেই আতর দোকানের সেলসম্যান মারিয়ার কথার। হিজাব পরিহিতা নারীরা এসেছেন এখানে। তাদের মধ্যে মসজিদের সিঁড়িতে দেখা হলো আফিফা ও তার দুই বান্ধবীর সঙ্গে। কথা হলো তাদের সঙ্গে। স্থানীয় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন তারা। কথাবার্তার এক ফাঁকে বান্ধবীকে নেকাব বেঁধে দিচ্ছিলেন আফিফা।
শুধু ব্যাংককে নয়, পাতায়াতেও দেখা মেলে পর্দাশীন হিজাবি নারীর। কোরাল আইল্যান্ড যাওয়ার আগ মুহূর্তে দেখা হলো আরেক নারীর সঙ্গে। হিজাব পরিহিতা সেই নারীকে প্রশ্ন করলাম, তুমি মুসলিম। তার জবাব, অবশ্যই কেন নয়।
থাইল্যান্ডের মুসলিম নারীদের সাথে কথা বলে জানা গেল, দেশটিতে বসবাসকারী নারীদের অধিকাংশই মাথায় হিজাব বাঁধেন। নামাজও পড়েন। তারা মনে করেন, হিজাব তাদের পরিচয় বহন করে। দেশটির বৌদ্ধ ও তাদের মধ্যে পার্থক্যকারী পোশাকটিই হলো হিজাব।
আরও পড়ুন: কোরাল আইল্যান্ড: দস্যুদের আস্তানায় পর্যটনের হাতছানি
কথা হচ্ছিল বাঙালী যুবক আরমানের সাথে। তিনি দীর্ঘদিন দেশটিতে আছেন। আরমান বলছিলেন, এখানে যত হিজাব পরিহিতা নারীকে দেখবেন তারা মুসলিম। হিজাবকে তারা বাঙালির শাড়ির মতো ঐত্যিহ্য মনে করেন। ছোট-বড় সবাই এই হিজাব পরেন। তবে এই হিজাবে দেশটির সরকার ও জনগণের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। বরং হিজাবিদের সবাই বেশ সম্মাণের চোখেই দেখে। তারা শুধু হিজাবই পরেন না, সাথে বোরকাটাও সুন্দর করে মেইনটেন করেন।
ব্যাংককের কয়েকটি মার্কেট ঘুরে দেখা গেল, বিভিন্ন শপিং সেন্টারের দোকানগুলোতে সেলসম্যান হিসেবে কাজ করা নারীরা হিজাব বেঁধে দায়িত্ব পালন করছেন। তাদের দেখে প্রথম দিকে আরব মনে হলেও পরে জানা গেল, তারা দেশটির পূর্ব সীমান্ত সংলগ্ন মালয়েশিয়ান বংশভূত মুসলিম নারী। দেশটিতে এখন মুসলিমদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। তারা কেমন আছেন সেই গল্প শোনাবে আরেক পর্বে।
শেষ দিন ব্যাংককে আমাদের হোটেলের সামনের সড়কের শেষ প্রান্তে সুকুমভিত এলাকার একটি ছোট মার্কেটে ঢুকলাম আতর কেনার জন্য। মার্কেটির দোকানগুলোতে বিভিন্ন জিনিসপত্রের পাশাপাশি খুচরা ও পাইকারি দরে আতর মেলে। সেখানে গেলে দোকানে দুই নারী কর্মী ছাড়া আর কেউ ছিল না। তাদের মাথায় হিজাব। জিজ্ঞেস করলাম, আপনারা মুসলিম? মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিলেন। জানলাম তারা স্কুল ও কলেজ পড়ুয়া। ফেরার সময় এক সহকর্মী বলছিল, বেপর্দার দেশে পর্দাশীল নারী দেখে বিষয়টি ভালোই লাগলো।
এমআইকে/এইউ

