শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

গ্যাস অনুসন্ধানে অগ্রগতি নেই কেন?

ঢাকা মেইল ডেস্ক
প্রকাশিত: ২৮ জানুয়ারি ২০২৩, ০৮:২২ পিএম

শেয়ার করুন:

গ্যাস অনুসন্ধানে অগ্রগতি নেই কেন?
ফাইল ছবি

জ্বালানি গ্যাসের দাম বাড়ানোর পরেও দেশে শিল্পকারখানা ও ভোক্তা পর্যায়ে গ্যাসের সরবরাহ পুরোপুরি নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। ডলার ও বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণে একদিকে যেমন এলএনজি আমদানি নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে, তেমনি দেশীয় উৎসগুলো থেকেও গ্যাসের উৎপাদন বাড়াতে পারছে না সরকার। যদিও প্রাকৃতিক গ্যাস দেশের প্রধান খনিজ সম্পদগুলোর অন্যতম।

ফলে গ্যাস-নির্ভর বিদ্যুৎ ও শিল্পখাতগুলো নতুন সংকটের মুখোমুখি হয়েছে। এমনকি গ্যাসের সংকটের কারণে সার কারখানা এবং অনেক শিল্প কারখানাও বন্ধ রাখতে হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন ব্যবসায়ীরা। 


বিজ্ঞাপন


বাংলাদেশে জ্বালানি গ্যাসের মজুদ কতটা আছে?

বাংলাদেশে বর্তমানে মোট গ্যাসক্ষেত্র রয়েছে ২৮টি, যার মধ্যে ২০টি থেকে উৎপাদন করা হচ্ছে। প্রতিবছর এক টিসিএফ করে গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে।

পেট্রোবাংলার হিসাব অনুযায়ী, এসব গ্যাস ক্ষেত্রে মোট মজুদ ছিল ২৮ টিসিএফ গ্যাস। সেখান থেকে ১৯ টিসিএফ গ্যাস উত্তোলনের পর বর্তমানে মজুদ রয়েছে ৯.০৬ টিসিএফ।


বিজ্ঞাপন


আরও পড়ুন: কোন খাতে কত বাড়ল গ্যাসের দাম?

নতুন গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কার না হলে এই মজুদ দিয়ে আগামী আট থেকে নয় বছর পর্যন্ত উত্তোলন করা যাবে।

gas2

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বদরুল ইমাম বলছেন, ’আশির দশকে যখন অনেক গ্যাসক্ষেত্রে পাওয়া গেল, তখন এমন অবস্থা ছিল যে, আপনার অনেক গ্যাস আছে, কিন্তু চাহিদা ততোটা নেই। ফলে এরপর আর গ্যাস ক্ষেত্র অনুসন্ধানে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়নি।’

সেই সময় দেশে গ্যাস নির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন, পরিবহন খাত ও অনেক শিল্প, কলকারখানা গড়ে ওঠে। ২০০১ সালের পর দেশে রাতারাতি গ্যাসের চাহিদা বেড়ে যায়।

বিইআরসির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে জ্বালানি খাতের প্রায় ৪৬ শতাংশ গ্যাস খাত থেকে সরবরাহ করা হয়। কিন্তু বিদেশি কোম্পানিকে দিয়ে গ্যাস অনুসন্ধানও কার্যত বন্ধ রয়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান বাপেক্স-এর মাধ্যমেও গ্যাস অনুসন্ধানে কার্যকর কোন পদক্ষেপ ছিল না।

খনিজসম্পদ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, ’এই পরিস্থিতি যে তৈরি হবে, তা আমরা কেউ জানতাম না। প্ল্যান করতে করতেই আমাদের সময় পার হয়ে যাচ্ছে।'

'আমরা জানতাম না ডলারের এইভাবে ঘাটতি হবে, এনার্জির দাম বেড়ে যাবে। সেই সঙ্গে আমাদের কিন্তু কৃষি, শিল্পসহ সব খাতে জ্বালানি সরবরাহ অব্যাহত রাখতে হচ্ছে। ফলে বাধ্য হয়ে আমাদের আমদানি করতে হয়েছে। তবে আমাদের যে রিজার্ভ আছে, তাতে আট থেকে নয় বছর চলবে।’

আরও পড়ুন: গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়লেও অন্য দেশের চেয়ে কম: প্রধানমন্ত্রী

গ্যাসের চাহিদা মেটাতে ২০১৮ সাল থেকে বাংলাদেশের সরকার তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি করতে শুরু করে। কারণ দেশে ৪০০০ মিলিয়ন ঘনফুটের চাহিদা থাকলেও প্রতিদিন তিন হাজার ৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করে কোম্পানিগুলো। যার মধ্যে ৭৫০ মিলিয়ন ঘনফুট আমদানি করা এলএনজি  গ্যাস।

তখন বলা হয়েছিল, দেশে অনুসন্ধান ও উৎপাদনে যে খরচ পড়ে, তার চেয়ে কম দামে বিদেশ থেকে গ্যাস আমদানি করতে পারছিল বাংলাদেশ।

কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে স্পট মার্কেটে চড়া দামের কারণে চাহিদা অনুযায়ী এলএনজিও আমদানি করতে পারছে না সরকার।

২০১০ সাল থেকে বাংলাদেশের সরকার গুরুত্বের সঙ্গে দেশে গ্যাসের অনুসন্ধান শুরু করে। সেই সময় ২০১১ সালে নোয়াখালী সুন্দরপুরে এবং ২০১২ সালে কুমিল্লায় গ্যাস ক্ষেত্র পাওয়া যায়।

এছাড়া ২০১৪ সালে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে একটি গ্যাসক্ষেত্র পাওয়া গেলেও সেটি থেকে এক বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস তোলার পর বন্ধ হয়ে যায়।

gas3

ভোলার ভাদুরিয়ায় ২০১৮ সালে একটি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করে বাপেক্স। সর্বশেষ ২০২১ সালে সিলেটের জকিগঞ্জে একটি গ্যাসক্ষেত্রে আবিষ্কার হয়। তবে এদুটি থেকে এখনো পুরোপুরি উত্তোলন শুরু হয়নি।

ভারত ও মিয়ানমারের সাথে সমুদ্র-বিরোধ নিষ্পত্তি হলেও বঙ্গোপসাগরে এখনো কোন অনুসন্ধান কূপ খনন করতে পারেনি বাংলাদেশ।  সাগরে এখন পর্যন্ত আবিষ্কার হওয়া একমাত্র গ্যাসক্ষেত্র সাঙ্গুও পরিত্যক্ত হয়েছে।

বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমার তাদের ব্লক থেকে গ্যাস তুলতে শুরু করেছে। বাংলাদেশও তাদের সমুদ্র ব্লকগুলোকে ২৬টি ব্লকে ভাগ করেছে।

এসব ব্লকে গ্যাস উত্তোলনের জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্রে চারটি প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছিল। তার মধ্যে কনোকোফিলিপস দুই বছর অনুসন্ধান করার পর গ্যাসের দাম নিয়ে মতবিরোধে ব্লক ছেড়ে দেয়।

কনোকোফিলিপস ও সান্তোস দাবি করেছিল যেন তাদের সাথে যে চুক্তি করা হয়েছিল, গ্যাসের দাম যেন তা থেকে বাড়িয়ে দেওয়া হয়। তাতে বাংলাদেশ সরকার রাজি না হওয়ায় তারা চলে যায়। পরবর্তী সময়ে সান্তোস ও ক্রিস এনার্জি, ভারতীয় কোম্পানি ওএনজিসি ভিদেশ ও অয়েল ইন্ডিয়া ইজারা নিয়েছিল। কিন্তু তারাও সরে যায়।

আরও পড়ুন: মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা

সর্বশেষ ২০১৬ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার দাইয়ু কর্পোরেশনের সঙ্গে ১২ নম্বর ব্লকে গ্যাস উত্তোলনের উৎপাদন-অংশীদারিত্ব চুক্তি (পিএসসি) করে পেট্রোবাংলা। এই ব্লকের পাশেই মিয়ানমার অংশে সমুদ্র থেকে গ্যাস তুলছে দাইয়ু।

জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ’আমরা যতবারই দেখেছি, যে কোম্পানিগুলো এসেছে, ড্রিল করতে গিয়ে তারা চলে গেছে। তারা মনে করেছে, যে লেভেলে গ্যাস পাওয়া যাবে, সেটা তুলে তাদের জন্য লাভজনক হয় না। এই জন্য তারা চলে গেছে। দুই বছর আগেও তারা চলে গেছে। এখন যেমন সার্ভে আবার শুরু হয়েছে।’

নতুন গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কার কতদূর?

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বদরুল ইমাম বলছেন, ’বাংলাদেশে এতদিন কেন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানে জোর দেওয়া হয়নি, তার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। এটা বর্তমান সরকারের বিষয় না, বরাবরই আমাদের দেশে গ্যাস অনুসন্ধানে বা নিজেদের গ্যাস উত্তোলনে কখনো জোরালো অনুসন্ধান হয়নি। ২০০১ সালে চাহিদা বেড়ে যাওয়ার পর লক্ষ্য করা হয়, যে চাইলেই গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না।’

‘বিশ্বে যেখানে পাঁচটা কূপ খনন করলে একটা গ্যাস ক্ষেত্রে পাওয়া যায়, আমাদের এখানে গড়ে প্রায় তিনটা কূপ খনন করলে একটা মেলে। ফলে এখানে গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। কিন্তু তারপরেও কেন যেন বাংলাদেশের সরকার গ্যাস উত্তোলনে কখনো খুব বেশি আগ্রহী হয়নি।’

বদরুল ইমাম বলেন, ‘আমরা বহু বছর ধরে শুনে আসছি, গ্যাসের মজুদ শেষ হয়ে আসছে। কিন্তু সেটা হয়নি। কারণ যতো অনুসন্ধান করা হচ্ছে, ততো নতুন নতুন গ্যাস ক্ষেত্রে পাওয়া গেছে। এগুলো কিন্তু যোগ হচ্ছে। ফলে আমাদের এই খাতে আরও ফোকাস করা উচিত।’

বিশ্লেষকরা বলছেন, একটা সময় মনে করা হতো, বাংলাদেশে গ্যাস উত্তোলনে যে খরচ হবে, তার চেয়ে কম দামে বিদেশ থেকে গ্যাস আমদানি করা সম্ভব। এই কারণে বাংলাদেশের সরকার অনুসন্ধানে জোর না দিয়ে বরং গ্যাস আমদানিতে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করেছে।

গ্যাস অনুসন্ধানে এই ধীরগতির কথা স্বীকার করছেন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদও। তিনি বলছেন, ’অনুসন্ধান হচ্ছে, যার কারণে গ্যাসের পরিমাণ বাড়ছে। তবে যে পরিমাণে ড্রাইভটা হওয়া দরকার ছিল, সেটা হয়তো হয়নি। সেটারও কারণ ছিল।’

gas4

‘আমাদের যথেষ্ট গ্রিড নেই। অর্থেরও প্রয়োজন হয়। একেকটা ড্রিল করতে ২১ মিলিয়নের মতো ডলার খরচ হয়। তবে বাপেক্স অনেক সময় যেভাবে চেষ্টা করা উচিত ছিল, সেভাবে পারেনি, এটা সত্যি কথা। আমাদের আসলে আরও অনেক ড্রিলিং করা উচিত ছিল। এখন আমরা ড্রাইভ দিচ্ছি। গত ১৩ বছরেও তো আমরা অনেকগুলো কূপ পেয়েছি।’

আরও পড়ুন: মজুত গ্যাস দিয়ে ১১ বছরের চাহিদা মিটবে: প্রতিমন্ত্রী নসরুল

তবে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বদরুল ইমাম বলছেন, বাংলাদেশে যে জ্বালানি গ্যাসের বিপুল সম্ভাবনা আছে, সেটা বিদেশি কোম্পানিগুলোর কাছে তুলে ধরতে হবে। সেই সঙ্গে দামের ক্ষেত্রেও সমন্বয় করতে হবে। এই সম্ভাবনা ঠিক মতো তুলে ধরতে না পারার কারণেই কোম্পানিগুলো আগ্রহী হচ্ছে না। এজন্য তিনি সরকারি নীতিতে পরিবর্তন আনার পরামর্শ দিচ্ছেন।

তবে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলছেন, বিশ্ববাজারে গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন অনেক কোম্পানি বাংলাদেশের গ্যাসের ব্যাপারে আগ্রহী হচ্ছে। বাপেক্সও জোরেশোরে অনুসন্ধান শুরু করেছে।

তবে তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলছেন, বাংলাদেশের গ্যাসের অনুসন্ধান অনেকটা বিশ্ব বাজারে গ্যাসের দামের ওপরেও নির্ভর করে।

‘এখন গ্যাসের দাম বেড়েছে। ফলে অনেক কোম্পানি আগ্রহী হচ্ছে। গ্যাসের আরও এক্সপ্লোরেশন হচ্ছে। এই বছর আরও ৪৬টি ড্রিল হবে। কিন্তু এটা সত্যি যে, আমাদের গ্যাসের মজুদও কিন্তু কমছে।  কিন্তু সমস্যা হলো, গ্যাসের দাম যদি বিশ্বে আবার কমে যায়, তখন আর কোম্পানিগুলো আগ্রহী হয় না। কারণ তাদের তো ইনভেস্ট করে লাভ করতে হবে,’ তিনি বলছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে এবারের জ্বালানি তেল ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি চোখে আঙ্গুল দেখিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে যে, জ্বালানির জন্য নিজস্ব দীর্ঘমেয়াদি উৎস থাকা দরকার। সেজন্য বাংলাদেশ সরকারের একমাত্র বিকল্প হতে পারে গ্যাসের আরও অনুসন্ধান ও উৎপাদন জোরদার করা। সূত্র: বিবিসি বাংলা

জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর