চারদিনের মাথায় ঢাকায় মহাসমাবেশ করতে যাচ্ছে বিএনপি। দিনক্ষণ ঘনিয়ে এলেও এখনো ঠিক হয়নি সমাবেশস্থল। তবে ১০ ডিসেম্বরের সেই সমাবেশকে ঘিরে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে ইতোমধ্যেই রাজধানীজুড়ে নিরাপত্তা জোরদার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এরই ধারাবাহিকতায় সমাবেশকে কেন্দ্র করে ঢাকার আবাসিক হোটেলগুলোতেও কড়াকড়ি আরোপ করেছে পুলিশ। এমনকি ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকটি আবাসিক হোটেলেও অভিযান চালানো হয়েছে।
যদিও বিএনপির দাবি- সমাবেশ বানচাল করতেই পুলিশ আবাসিক হোটেলগুলোতে অভিযানের নামে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। তবে এটিকে নিয়মিত অভিযানের অংশ বলেই জানিয়েছে পুলিশ।
বিজ্ঞাপন
এদিকে, আবাসিক হোটেলগুলোয় কড়াকড়ি আরোপের ফলে গেস্ট আসা কমে গেছে বলে দাবি করেছেন হোটেল ব্যবসায়ীরা। সেই সঙ্গে যেসব গেস্ট হোটেলে আছেন, অভিযানের ফলে তাদের মাঝেও চাপা আতঙ্ক বিরাজ করছে বলে জানিয়েছেন তারা।
আবাসিক হোটেল ব্যবসায়ীদের দাবি- সমাবেশকে ঘিরে অলিখিত নির্দেশনায় রাজধানীর আবাসিক হোটেলগুলোতে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। নতুন করে অতিথিকে থাকতে দেওয়া হচ্ছে না। সেই সঙ্গে পুরনো অতিথিদেরও সমাবেশের আগেই হোটেল ছেড়ে যেতে বলা হয়েছে।
মঙ্গলবার (৬ ডিসেম্বর) দিনভর রাজধানীর গুলিস্তান, ফার্মগেট, পল্টন, ফকিরাপুল, বংশাল, মতিঝিল, যাত্রাবাড়ী, শাহবাগ, রমনা, মগবাজার, মৌচাকসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে হোটেল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্যই মিলেছে।
তারা জানিয়েছেন, ডিসেম্বরের শুরু থেকে পুলিশের পক্ষ থেকে মৌখিকভাবে কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে হোটেলগুলোতে বিএনপির সমর্থকদের রুম ভাড়া দেওয়া বা হোটেলে উঠাতে নিষেধ করা হয়েছে। এমনকি যেসব অতিথি রয়েছেন তাদের ৮ ডিসেম্বরের মধ্যে হোটেলে থেকে চলে যেতে বলা হয়েছে। যদিও ঝামেলা এড়াতে এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চান না কোনো হোটেল কর্তৃপক্ষ।
বিজ্ঞাপন
ফকিরাপুল এলাকার হোটেল সাকিল ইন্টারন্যাশনালের এক কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা মেইলকে বলেন, গত দুই-তিন থেকে হোটেলে গেস্ট আসা কমে গেছে। আর যারা হোটেলে আছে, তাদের মনেও একটা ভয় কাজ করছে।
একই কথা জানিয়েছেন ফার্মগেট এলাকার সম্রাট আবাসিক হোটেলের অপর এক কর্মচারী। ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, এই মাসের শুরুর দিকে পুলিশ এসে মৌখিকভাবে আমাদের বলেছে- বিএনপির কোনো নেতাকর্মী যাতে হোটেলে অবস্থান না করে। এরপর থেকে অতিথির সংখ্যাও কমে গেছে।
অতিথি কমে যাওয়ার কারণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কে বিএনপি করে, আর কে আওয়ামী লীগ করে- সেটা তো আমরা জানি না। তাই অতিথিদের একদিনের বেশি রাখা হচ্ছে না। এ জন্য যারা বেশিদিন থাকতে চান তাদেরও রাখা হচ্ছে না। তাই অতিথির সংখ্যাও কমে গেছে।
বিএনপির সমাবেশ ঘিরে যে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে নিরাপত্তার স্বার্থে গত ৩ ডিসেম্বর থেকে রাজধানীর বিভিন্ন আবাসিক হোটেলে অভিযান শুরু করে পুলিশ। বিশেষ করে বনানী, পল্টন, মগবাজার, দৈনিক বাংলার মোড়, মতিঝিল, গুলশান, গ্রীন রোড, তেজগাঁওসহ বিভিন্ন এলাকায় অবস্থিত হোটেল ও মেসবাড়িতে নিয়মিত এই অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। এমন অবস্থায় হোটেলের গেস্টদের ব্যাগ তল্লাশি ছাড়াও তারা কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত কি-না সে বিষয়েও জেনে হোটেল ভাড়া দেওয়া হচ্ছে। ফলে হোটেলগুলোর এমন কড়াকড়িতে ভোগান্তিতে পড়েছেন বিভিন্ন জেলা থেকে রাজধানীতে ছুটে আসা রোগীসহ সাধারণ মানুষ।
মঙ্গলবার বিকেলে তাসমিনা আক্তার সুমা নামে এক তরুণী ঢাকা মেইলকে বলেন, আমার বাড়ি সিলেটে। আমেরিকা অ্যাম্বাসিতে আজ আমার ইন্টারভিউ ছিল। তাই গত ২৯ নভেম্বর আমার স্বামীকে নিয়ে আমি ঢাকায় আসি। ঢাকায় আসার পর পান্থপথ এলাকায় একটি আবাসিক হোটেলে আমরা রুম ভাড়া করি। তবে সেখানে দীর্ঘদিন থাকা যাবে না, হোটেল কর্তৃপক্ষের এমন বক্তব্য শুনে পরদিন হোটেল ছেড়ে দেই।
সুমা জানান, হোটেল ছেড়ে আমরা ফকিরাপুলে অন্য একটি হোটেলে রুম ভাড়া করি। এরমধ্যে মতিঝিলসহ রাজধানীর বেশ কয়েকটি হোটেলে অভিযান চালায় পুলিশ। এরপর থেকে আমাদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয়। ওই আতঙ্ক নিয়েই আজ অ্যাম্বাসিতে যাই। ইন্টারভিউ শেষ করে আরও কয়েকদিন ঢাকায় থাকার কথা ছিল আমাদের। কিন্তু আগামী ১০ ডিসেম্বরকে কেন্দ্র করে হোটেলগুলোতে কড়াকড়ি চলছে। তাই আজই আমরা সিলেট ফিরে যাচ্ছি।
>> আরও পড়ুন: সব বাধা উপেক্ষা করে কর্মসূচি সফল করতে চায় বিএনপি
অন্যদিকে, বগুড়া থেকে ঢাকায় আসা রবিউল ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, আমি গত শনিবার পারিবারিক কাজে ঢাকা এসে যাত্রাবাড়ীর একটি আবাসিক হোটেলে উঠি। কিন্তু আমার বাড়ি বগুড়া হওয়ায় হোটেল কর্তৃপক্ষ মনে করছে আমি বিএনপির সমাবেশে আসছি। তাই আজ হোটেল ছেড়ে দিয়ে বগুড়া চলে যাচ্ছি। বিএনপির সমাবেশের পর ফের ঢাকায় এসে আমার কাজ শেষ করব।
শুধু সুমা কিংবা রবিউলই নন, তাদের মতো অনেকেই জরুরি কাজ থাকা সত্ত্বেও বর্তমানে ঢাকায় অবস্থান করছেন না।
এদিকে, হোটেলে কড়াকড়ির বিষয়ে কথা হলে যাত্রাবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাজহারুল ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে যাতে কোনো ধরনের নাশকতা কেউ করতে পারে, সে জন্য হোটেলগুলোতে বাড়তি নজরদারি রয়েছে। তবে কাউকে হয়রানি করা হচ্ছে না বলেও দাবি করেছেন তিনি।
সার্বিক বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস্) এ কে এম হাফিজ আক্তার ঢাকা মেইলকে বলেন, পুলিশ সদর দফতরের নির্দেশনা অনুযায়ী রাজধানীর আবাসিক হোটেল-মেসসহ বিভিন্ন এলাকায় অভিযান অব্যাহত আছে। ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই অভিযান চলবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
>> আরও পড়ুন: আরামবাগে সমাবেশ করতে চায় বিএনপি, সিদ্ধান্ত হতে পারে আজ
উল্লেখ্য, গত ১ থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে বিশেষ অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছে পুলিশ সদর দফতর। দফতর থেকে পাঠানো এক আদেশে দেশের সব পুলিশ ইউনিটের প্রধান ছাড়াও সব জেলার পুলিশ সুপারদের এই অভিযান চালাতে বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে আদেশে বলা হয়েছে, গত ২০ নভেম্বর ঢাকা সিএমএম আদালত থেকে দণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার প্রেক্ষাপট বিবেচনা এবং মহান বিজয় দিবস, বড়দিন ও থার্টিফার্স্ট নাইট উদ্যাপন নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন করার লক্ষ্যে ১ থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিশেষ অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই অভিযানে সারাদেশের আবাসিক হোটেল, মেস, হোস্টেল, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, কমিউনিটি সেন্টারসহ অপরাধীদের লুকিয়ে থাকার সম্ভাব্য স্থানগুলোতে অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একই সময় জঙ্গি, সন্ত্রাসী, মাদকসেবী ও কারবারি, অবৈধ অস্ত্রধারী, পরোয়ানাভুক্ত আসামি গ্রেফতারের পাশাপাশি মাদক ও অবৈধ অস্ত্রও জব্দের নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে।
কেআর/আইএইচ