সোমবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

ব্যয় মেটাতে ‘চিড়েচ্যাপ্টা’ নিম্ন-মধ্যবিত্ত

মুহা. তারিক আবেদীন ইমন
প্রকাশিত: ০৪ নভেম্বর ২০২২, ১০:৫৫ এএম

শেয়ার করুন:

ব্যয় মেটাতে ‘চিড়েচ্যাপ্টা’ নিম্ন-মধ্যবিত্ত

পরিবারকে নিয়ে রাজধানীর মালিবাগে একটি বাসায় ভাড়া থাকেন জাহিদুর রহমান। স্ত্রী-সন্তানসহ পাঁচজনের সংসার তার। স্বামী-স্ত্রী দুইজনই চাকরি করেন প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে। দুইজনের মাসিক আয় প্রায় ৪০ হাজার টাকার মতো। কিন্তু এই টাকাতেও রাজধানীতে বসবাস করা তাদের জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাসের শুরুর কয়েকদিন কিছুটা চলতে পারলেও নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে শেষ দিকে নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। শেষের দিনগুলো যেন যেতেই চায় না।

ঢাকা মেইলকে জাহিদুর বলেন, ‘আগে এই ইনকাম দিয়ে সুন্দর চলতো আমাদের। সারা মাসের খরচ চালিয়ে কিছু সেভিংস করতে পারতাম। এছাড়া গ্রামের বাড়িতেও টাকা পাঠাতে পারতাম। কিন্তু এখন সেটা আর হয় না। এমন কোনো জিনিস নাই যেটার দাম বাড়েনি। সেভিংস করব কী? সংসার চালাতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। উল্টো আরও ধার করতে হচ্ছে।’


বিজ্ঞাপন


সিপিডি গবেষণায় জানিয়েছে, বর্তমানে রাজধানীতে বসবাসরত চার সদস্যের একটি পরিবারের মাসে খাদ্য ব্যয় ২২ হাজার ৪২১ টাকা। মাছ-মাংস বাদ দিলেও খাদ্যের পেছনে ব্যয় হবে ৯ হাজার ৫৯ টাকা। এটা ‘কম্প্রোমাইজড ডায়েট’ বা আপসের খাদ্য তালিকা।

জাহিদুর রহমানের মতো একই অবস্থার কথা জানালেন শাহ নেওয়াজ। তিনিও একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। জাহিদুর বলেন, ‘সংসার চালাতে অনেক খরচ কমিয়ে দিয়েছি। এখন রিকশায় ওঠা বাদ দিয়ে দিয়েছি। সংসারে বাজার খরচ কমিয়ে দিয়েছি। সবকিছুরই দাম বাড়ে শুধু আমাদের আয় ইনকাম বাড়ে না। সামনের দিনগুলো যে কীভাবে চলবে বুঝতে পারছি না।’

শুধু জাহিদুল কিংবা নেওয়াজই নয়, রাজধানীতে বাস করা মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ আছেন তাদের অধিকাংশেরই অবস্থা এমনই। যারা একসময় নিয়মিত ইনকাম দিয়ে মোটামুটি জীবনযাপন করতেন তাদের এখন সংসার চালানো হিমশিম অবস্থা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির চাপে চ্যাপ্টা হওয়ার মতো অবস্থা তাদের। টিসিবির লাইনেও এখন দেখা যাচ্ছে মধ্যবিত্তের ভিড়।

আরও পড়ুন: পাঙ্গাশের কেজিও ১৮০ টাকা!


বিজ্ঞাপন


অনেকদিন ধরেই ভোগ্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে। চাল-মাছ-মাংস থেকে শুরু করে এমন কোনো পণ্য নেই যার দাম বাড়েনি। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শাকসবজির দামও। এমন অবস্থার মধ্যে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি হলে চাপ আরও বেড়ে যায়। পোশাক-আশাক, খাদ্যবহির্ভূত পণ্য থেকে শুরু করে চিকিৎসা-ব্যয় সব দিকেই বাড়তি মূল্য। আর এমন মূল্যবৃদ্ধির চাপে চিড়েচ্যাপ্টা মধ্যবিত্ত।

সরকার নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। দ্রব্যমূল্য লাগামহীন বৃদ্ধি এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে, সবার ওপর চাপ পড়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্তদের ওপর চাপ পড়ছে বেশি।বদিউল আলম মজুমদার, সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক

স্বল্প আয়ের মানুষের অবস্থা তো আরও খারাপ। সংসার চালাতে মাছ-মাংসের বাজারে ডিমের ওপর এই শ্রেণির মানুষ নির্ভরশীল হলে ডিমেও অস্থিরতা চলছে। মাত্র কয়েক মাস আগে যেখানে ডিমের ডজন ছিল ৯০-১০০ টাকা সেখানে ডিম এখন বিক্রি হচ্ছে ১৪০-১৫০ টাকা। ব্রয়লার মুরগি যেখানে ছিল ১৩০-১৪০ টাকা সেখানে দাম বেড়ে বিক্রি হচ্ছে প্রায় ১৮০-২০০ টাকায়। ডিম-মুরগি ছাড়া অন্যান্য পণ্যের দামও আকাশছোঁয়া। সপ্তাহে একদিনও মাছ মাংস জোটে না অনেকের কপালে।

বাজারের চা বিক্রেতা হোসেন বলেন, ১০ কেজি চাল কিনতে গেলে একদিনের রোজগারের টাকা পুরোপুরি শেষ। প্রতি সপ্তাহে একদিনের রোজগারের টাকা চালের পেছনেই চলে যায়। ফলে অন্যান্য প্রয়োজনীয় খরচ জোগাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।’

স্বল্প মূল্যে নিত্যপণ্য কিনতে টিসিবির লাইনে দীর্ঘ্য হচ্ছে মানুষের লাইন। আগে যেখানে এই ধরনের লাইনে শুধু নিম্ন আয়ের মানুষেরাই দাঁড়াত, মধ্যবিত্ত মানুষদেরকেও দেখা যায় এই লাইনে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে।

দুই মাসে মাছ-মাংস, ডিমের দাম কমে নাই, উল্টা বাড়ছে। আগে শুক্রবার আইলে পোলাপান নিয়া ভালোমন্দ খাইতাম, এখন শুধু সবজি-ভাত খাই। মাছ-মাংস, ডিম খাওয়া ছাইড়্যা দিছি।আব্দুস সালাম মোল্লা, রাজমিস্ত্রি

রাজধানীর যেকোনো এলাকায় টিসিবির গাড়ি আসার অনেক আগে থেকেই নির্ধারিত স্থানে অপেক্ষা করেন অসংখ্য মানুষ। টিসিবির গাড়ি চলে এলে সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়েন ট্রাকের ওপর। যেন ট্রাক থামানোর তর সইছে না কারও। এরই মধ্যে লাইনে দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন সবাই। এটা এখানকার নিত্যদিনের চিত্র।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) গবেষণায় জানিয়েছে, দেশে মূল্যস্ফীতি লাগামহীন, শিগগিরই সমাধানের লক্ষণ নেই। পাশাপাশি অনেকেই খাদ্য ব্যয় কমিয়ে আনতে খাবারের তালিকা থেকে বাদ দিচ্ছেন মাছ-মাংসসহ বিভিন্ন আমিষ। সংস্থাটি বলছে, বর্তমানে রাজধানীতে বসবাসরত চার সদস্যের একটি পরিবারের মাসে খাদ্য ব্যয় ২২ হাজার ৪২১ টাকা। মাছ-মাংস বাদ দিলেও খাদ্যের পেছনে ব্যয় হবে ৯ হাজার ৫৯ টাকা। এটা ‘কম্প্রোমাইজড ডায়েট’ বা আপসের খাদ্য তালিকা।

সংস্থাটি আরও বলছে, বিশ্ব মহামন্দায় বাংলাদেশকে ৭টি সংকটের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। সেগুলো হলো- ডলার সংকট, জ্বালানি সংকট, মূল্যস্ফীতি সংকট, খাদ্য সংকট, ইউক্রেন সংকট, কোভিড এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট।

বিশ্লেষকরা বলছেন, নিত্যপণ্যের দাম যে হারে বাড়ছে সে হিসেবে নিম্নবিত্ত মধ্যআয়ের মানুষ তো দূরের কথা, উচ্চ মধ্যবিত্তরাও সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে।

আরও পড়ুন: সংসার চালাতে মানুষ হিমশিম খাচ্ছে

এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘সরকার নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। দ্রব্যমূল্য লাগামহীন বৃদ্ধি এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে, সবার ওপর চাপ পড়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্তদের ওপর চাপ পড়ছে বেশি।’

সাধারণ নাগরিক সমাজের আহ্বায়ক মহিউদ্দীন আহমেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘বর্তমান দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে সাধারণ মানুষের অবস্থা খুবই খারাপ। বিশেষ করে মধ্যবিত্তের অবস্থা। সবকিছুর দাম বাড়লেও মানুষের আয় ইনকাম তো আর বাড়েনি। তার ওপর বাড়ছে গ্যাসের দাম। পানির দাম বাড়ানোরও পাঁয়তারা চলছে। এভাবে চললে মধ্য আয়ের মানুষ ঢাকা শহরে বসবাস করতে পারবে না।’

টিএই/এমআর

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর