ভাড়াটে শ্যুটারের গুলিতে গুরুতর আহত হয়ে এক সপ্তাহ চিকিৎসাধীন থেকে মারা গেছেন ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও জুলাই বিপ্লবী শরীফ ওসমান বিন হাদি। ঘটনার দিন থেকেই গুঞ্জন, হত্যাকারীরা ভারতে পালিয়েছে। তবে এত দিনেও সে বিষয়টি নিশ্চিত হতে পারেনি পুলিশ।
রোববার (২১ ডিসেম্বর) বিবিসি বাংলাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এমনটাই জানিয়েছেন হাদি হত্যা মামলার তদন্তকারী সংস্থা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) প্রধান মো. শফিকুল ইসলাম। মূল সন্দেহভাজনদের সঠিক অবস্থান শনাক্তে এখনো তদন্ত চলমান রয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
গত ১২ ডিসেম্বর (শুক্রবার) রাজধানীর বিজয়নগরের কালফার্ট এলাকায় রিকশায় করে যাওয়ার সময় গুলিবিদ্ধ হন ওসমান হাদি। চলন্ত মোটরসাইকেলের পেছনে বসে তাকে খুব কাছ থেকে মাথায় গুলি করে ফয়সাল করিম মাসুদ নামে একজন। মোটরসাইলটি চালাচ্ছিলেন তার সহযোগী আলমগীর কবির।
হাদির মৃত্যুর ঘটনায় শ্যুটার ফয়সাল করিমকে প্রধান আসামি করে মামলা হয়েছে। তাকে এবং তার সহযোগী আলমগীর কবিরকে গ্রেফতারের বিষয়ে অগ্রগতি জানাতে সরকারকে রোববার (২১ ডিসেম্বর) সন্ধ্যা পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছে হাদির হাতে গড়া সংগঠন ইনকিলাব মঞ্চ। না পারলে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারীর পদত্যাগ দাবি করেছে তারা।
এ অবস্থায় রোববার (২১ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলন ডাকা হয়। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা উপস্থিত থেকে সেখানে হাদির হত্যা মামলার তদন্তের ব্যাপারে সবশেষ তথ্য জানাবেন বলে নিশ্চিত করেছেন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
বিজ্ঞাপন
মামলার তদন্তকারী সংস্থার প্রধান হিসেবে ওই সংবাদ সম্মেলনে ডিবি প্রধান শফিকুল ইসলামেরও উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে। তিনি দাবি করেছেন, গত আট দিনে তারা মামলাটির বিষয়ে ‘বেশ খানিকটা অগ্রগতি’ সাধন করতে সক্ষম হয়েছেন।
ডিবি প্রধান বলেন, ‘কারা ঘটনাটা ঘটিয়েছে এবং যে অস্ত্র ও মোটরসাইকেল ব্যবহার করে ঘটনাটা ঘটানো হয়েছে, সেটা আমরা ইতোমধ্যেই উদ্ধার করেছি। বেশ কয়েকজন আসামিকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এখন আমরা অন্য আসামিদের ব্যাপারে জানার চেষ্টা করছি।’
হাদি হত্যা মামলায় এখন পর্যন্ত ডজনখানেক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে, যাদের মধ্যে প্রধান আসামি ফয়সাল করিমের পরিবারের বেশ কয়েক সদস্যও রয়েছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ। কিন্তু ফয়সাল ও তার সহযোগী আলমগীরের অবস্থানের বিষয়ে এখনো সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য জানাতে পারেননি গোয়েন্দারা।
তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন পোস্টে দাবি করা হয়েছে, তারা দুজনই ভারতে পালিয়ে গেছেন। ডিবি প্রধান শফিকুল ইসলাম বলছেন, ‘আমরাও সেগুলো দেখেছি এবং তথ্যটি যাচাই-বাছাই করে দেখছি। কিন্তু এ ব্যাপারে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।’
এর আগে গত ১৪ ডিসেম্বর ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) পক্ষ থেকে জানানো হয়, হাদির ওপর হামলাকারীদের দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার তথ্য তারা ইমিগ্রেশন ডাটাবেজে পাননি। এছাড়া ফয়সালদের পাসপোর্ট ব্লক করে দেওয়ায় বৈধভাবে তাদের পক্ষ দেশ থেকে পালানো সম্ভব নয় বলেও জানানো হয়।
কিন্তু সন্দেহভাজন হত্যাকারীরা অবৈধভাবে সীমানা পেরিয়ে ইতোমধ্যে অন্য দেশে চলে গেছে কি-না, সে ব্যাপারে সুনিশ্চিত কোনো তথ্য নেই গোয়েন্দা পুলিশের কাছে।
গ্রেফতার হয়েছেন কারা?
শরিফ ওসমান হাদিকে হত্যার মামলায় এখন পর্যন্ত ১৩ জনকে গ্রেফতার করেছেন র্যাব-পুলিশের সদস্যরা। তাদের মধ্যে মূল অভিযুক্ত ফয়সাল করিমের বাবা, মা, স্ত্রী এবং শ্যালকও রয়েছেন। এছাড়া তার এক বান্ধবীকেও গ্রেফতার করা হয়েছে।
হাদিকে গুলি করার আগে ফয়সাল করিম একাধিকবার তার স্ত্রী, বান্ধবী ও শ্যালকের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলেন বলে জানতে পেরেছেন তদন্তকারী কর্মকর্তারা। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাদের তিনজনকে দুই দফায় ৯ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।
এছাড়া হামলার আগে-পরে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করার অভিযোগে আরও আটজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ময়মনসিংহ হালুয়াঘাট সীমান্ত দিয়ে পালানোর তথ্য পাওয়ায় সেখানকার মানব পাচারকারী চক্রের দুজন সদস্যকেও গ্রেফতার করেছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যা।
ডিবি প্রধান শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আটককৃত সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে, তদন্ত এগিয়ে যাচ্ছে। এর বাইরে হামলায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলের ‘ভুল নিবন্ধন’ নম্বরের সূত্র ধরে আরও একজনকে আটক করা হলেছিল। কিন্তু তদন্তে হত্যার ঘটনার সঙ্গে কোনো যোগসূত্র না পাওয়ায় তাকে মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়নি।’
গত ১২ ডিসেম্বর গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর হাদিকে প্রথমে নেওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে একটি অপারেশনের পর নেওয়া হয় এভারকেয়ার হাসপাতালে। তিন দিন পর উন্নত চিকিৎসার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে পাঠানো হয় সিঙ্গাপুরে। সেখানে চিকিৎসারত অবস্থায় বৃহস্পতিবার (১৮ ডিসেম্বর) রাতে মারা যান এই জুলাই বিপ্লবী।
এরপর শুক্রবার (১৯ জুলাই) দেশে আনা হয় হাদির মরদেহ। রাখা হয় হাসপাতালের হিমঘরে। শনিবার (২০ ডিসেম্বর) জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। তাতে অংশ নেয় ১০-১২ লাখ মানুষ। ওইদিনই হাদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সমাধির পাশে দাফন করা হয়। সূত্র: বিবিসি বাংলা
এএইচ

