- লুট হওয়া অবৈধ অস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি
- সীমান্ত দিয়ে আসা অস্ত্র নিয়ন্ত্রণে অগ্রগতি নেই
- প্রার্থীরা পাবেন অস্ত্রের লাইসেন্স
- শিগগির শুরু হচ্ছে অপারেশন ডেভিল হান্ট: ফেজ-২
- সহিংসতা ও গুজব রোধে প্রশাসনের পদক্ষেপ জরুরি
ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের আগে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় হত্যাকাণ্ড ও গুলির ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। ছিনতাই, আধিপত্য বিস্তার কিংবা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে এসব আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে গুলির ঘটনা হত্যাকাণ্ডে রূপ নিচ্ছে। এমন সহিংসতায় জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। ভোটের সময় যত ঘনিয়ে আসছে, ততই ভোটার ও প্রার্থীদের মধ্যে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে।
বিজ্ঞাপন
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, গত তিন মাসে সারাদেশে অন্তত অর্ধশত গুলির ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ঢাকায় প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা ও হত্যাচেষ্টার একাধিক ঘটনা নগরবাসীর পাশাপাশি নিরাপত্তা বিশ্লেষকদেরও ভাবিয়ে তুলেছে। একই সঙ্গে জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে যাওয়া প্রার্থীদের জীবননাশের ঝুঁকি বাড়ছে।
সর্বশেষ রাজধানীতে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদিকে গুলি করে হত্যাচেষ্টার ঘটনা প্রশাসনের ব্যর্থতাকেই সামনে এনে দিয়েছে। দিনেদুপুরে প্রকাশ্য সড়কে জুলাই আন্দোলনের এই পরিচিত মুখের মাথায় গুলি চালানোর ঘটনা নগরবাসীর নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে।
পুলিশ সদর দফতরের তথ্যমতে, চলতি বছরের প্রথম ১১ মাসে সারাদেশে বিভিন্ন অপরাধে মামলা হয়েছে ১ লাখ ৬৮ হাজার ৫০৫টি। শুধু ঢাকা মহানগরীতেই মামলা হয়েছে ১৭ হাজার ৫০২টি। এসব মামলার মধ্যে খুনের ঘটনায় হয়েছে ৩ হাজার ৫০৯টি মামলা।
গত চার মাসের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রতি মাসেই সারাদেশে শতাধিক হত্যাকাণ্ডের মামলা হয়েছে। ঢাকায়ও প্রায় নিয়মিতভাবে গড়ে ২৫ থেকে ৩০টি করে হত্যাকাণ্ড ঘটছে। একইসঙ্গে অস্ত্র সংক্রান্ত মামলার সংখ্যাও উদ্বেগজনক। এই চার মাসে ঢাকায় গড়ে প্রতি মাসে ২৬টি হত্যাকাণ্ড ও ১২টি অস্ত্র মামলা হয়েছে।
পুলিশ সদর দফতরের চার মাসের তথ্যমতে, আগস্ট মাসে সারাদেশে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ৩২১টি মামলা হয়। আর অস্ত্রের মামলা হয় ১৪৮টি। এই মাসে ঢাকায় ৩২টি হত্যা ও ১৪টি অস্ত্র মামলা হয়।
বিজ্ঞাপন
>> আরও পড়তে পারেন
যুবদল পরিচয়ে চাঁদাবাজির পর ফ্ল্যাট ছাড়ার হুমকি, আতঙ্কে নিপার পরিবার
পরের মাস সেপ্টেম্বরে ২৯৭টি হত্যাকাণ্ড এবং ১৪৫টি অস্ত্রের মামলা হয়। তার মধ্যে ঢাকাতেই ২৫টি হত্যাকাণ্ড ও ১৬টি অস্ত্রের মামলা হয়।
অক্টোবর মাসে সারাদেশে ৩১৯টি হত্যাকাণ্ডের মামলা হয়। এছাড়াও অস্ত্রের মামলা হয় ১৫৬টি। শুধুমাত্র ঢাকাতেই ২২টি হত্যাকাণ্ড এবং ১৬টি অস্ত্রের মামলা হয়েছে।
নভেম্বর মাসে সারাদেশে হত্যার ঘটনায় ২৭৯টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকাতেই ২৭টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। আর পুরো মাসজুড়ে অস্ত্র মামলা হয়েছে ১৫০টি। তার মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন থানায় ১৩টি মামলা হয়েছে।
‘ডেভিল হান্ট’ ঝিমিয়ে পড়ায় মাথাচাড়া দেয় অপরাধীরা
২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার ও চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের ধরতে যৌথ বাহিনীর উদ্যোগে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ শুরু হয়। তবে মাঝপথে সেই অভিযান ঝিমিয়ে পড়ায় অপরাধীরা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এর প্রভাব হিসেবে গত তিন মাসে দেশজুড়ে সন্ত্রাসী তৎপরতা ও সহিংস অপরাধ বেড়েছে বলে মনে করছেন অপরাধ বিশ্লেষকেরা।
পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, তারা মাঠে কাজ করছেন। তবে অনেক সময় অপরাধী ধরতে গেলে মব তৈরি করে গ্রেফতারে বাধা দেওয়া হচ্ছে, যা আইন প্রয়োগকে জটিল করে তুলছে।
গত ১১ ডিসেম্বর পুরান ঢাকার শ্যামবাজারে আবদুর রহমান ভূঁইয়া নামে এক মসলা ব্যবসায়ীকে দোকানে ঢুকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
এর আগে ১৭ নভেম্বর মিরপুরে একটি হার্ডওয়্যার দোকানে ঢুকে পল্লবী থানা যুবদলের সদস্য সচিব গোলাম কিবরিয়াকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
রাজধানীর বাইরেও গুলির ঘটনা ঘটছে। গত এক বছরে চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলায় সবচেয়ে বেশি গুলির ঘটনা ঘটেছে। শুধু এই উপজেলাতেই গত বছরের আগস্ট থেকে অন্তত ১২টি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।
>> আরও পড়তে পারেন
চাঁদাবাজদের ভয়ে দেশছাড়া প্রবাসী সিআইপি!
চট্টগ্রাম ও পাবনার বিভিন্ন আসনে নির্বাচনী প্রচারণা চলাকালে প্রার্থী ও নেতাকর্মীদের ওপর গুলিবর্ষণ ও হামলার ঘটনাও ঘটেছে।
৫ নভেম্বর চট্টগ্রাম-৮ আসনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী ও দলের মহানগরের আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহ গণসংযোগ চালানোর সময় গুলিবিদ্ধ হন। ওই ঘটনায় একজন নিহত ও দুইজন আহত হন।
২৭ নভেম্বর পাবনা-৪ (ঈশ্বরদী-আটঘরিয়া) আসনে জামায়াতের প্রার্থী ও দলের জেলা আমির আবু তালেব মণ্ডলের জনসংযোগ ঘিরে হামলা, গুলি ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।
১৮ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের রাউজানে মোটরসাইকেলে এসে রাজীব চৌধুরী (৪৮) নামে এক ঠিকাদারকে লক্ষ্য করে গুলি করেছে সন্ত্রাসীরা। তবে তিনি ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। সেদিন বিকেল পাঁচটার দিকে রাউজানের বিনাজুরী ইউনিয়নের কাগতিয়া বাজারে এ ঘটনা ঘটে।
৭ অক্টোবর রাউজানের খামারবাড়ি থেকে ফেরার পথে হাটহাজারীর মদুনাঘাটে চলন্ত গাড়িতে গুলি করে হত্যা করা হয় বিএনপির কর্মী মুহাম্মদ আবদুল হাকিমকে।
গত ২৫ অক্টোবর রাউজানে দুর্বৃত্তদের গুলিতে খুন হন মুহাম্মদ আলমগীর আলম নামের যুবদলের এক কর্মী। সেদিন বিকেলে পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের পশ্চিম রাউজানের চারাবটতল বাজারসংলগ্ন কায়কোবাদ জামে মসজিদের সামনে এ ঘটনা ঘটে।
>> আরও পড়তে পারেন
মোহাম্মদপুরে যুবক হত্যা: আসামিদের চেনেন না মামলার বাদী ও নিহতের বাবা!
গত ৬ জুলাই রাউজান উপজেলার কদলপুর ইউনিয়নের ইশানভট্টের হাটে প্রকাশ্যে বাজারের মধ্যে মুহাম্মদ সেলিম নামে এক যুবককে গুলি করে হত্যা করা হয়। অটোরিকশায় করে আসা বোরকা পরা অস্ত্রধারীরা তাকে খুন করে।
গত ২২ এপ্রিল দুপুরে রাউজান সদর ইউনিয়নের পূর্ব রাউজান ৮ নম্বর ওয়ার্ডের গাজীপাড়ায় সিএনজি ট্যাক্সি স্টেশন এলাকায় ইব্রাহিম নামের যুবদলের এক কর্মীকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয়। এছাড়া দেশের বিভিন্ন এলাকায় গুলি করে হত্যার ঘটনা প্রায়ই গণমাধ্যমের শিরোনাম হচ্ছে। গুলির এসব ঘটনায় নির্বাচনী পরিবেশ নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
শুরু হচ্ছে অপারেশন ডেভিল হান্ট: ফেজ-২
এমন প্রেক্ষাপটে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকার আবারো নতুন অভিযান শুরুর প্রস্তুতি নিচ্ছে। ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট: ফেজ-২’ নামে এই অভিযানে শীর্ষ সন্ত্রাসী ও আগের সময়ের ফ্যাসিস্ট কার্যক্রমে জড়িতদের ধরার পরিকল্পনা রয়েছে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানিয়েছেন, জাতীয় নির্বাচনে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করতে অবিলম্বে এই অভিযান শুরু করা হবে। লুট হওয়া ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা জোরদার করা হবে বলেও জানান তিনি।
অস্ত্রের লাইসেন্স পাবেন প্রার্থীরা
নির্বাচনী প্রচারণায় সহিংসতার প্রেক্ষাপটে প্রার্থীদের অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়ার সিদ্ধান্তও নিয়েছে সরকার। তবে বৈধ অস্ত্রের ব্যবহারও যে সহিংসতা ঠেকাতে পারবে-এমন নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারছে না বলে মত বিশ্লেষকদের।
আসন্ন সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রচার-প্রচারণা এবং তফসিল ঘোষণার আগে ও পরে যে গুলির ঘটনা ঘটেছে, তা প্রার্থী ও ভোটার-উভয়ের মধ্যেই আতঙ্ক সৃষ্টি করবে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক।
তার মতে, এই ভয় কাটিয়ে একটি সহিংসতামুক্ত নির্বাচনী পরিবেশ নিশ্চিত করতে যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে, সেগুলোর কার্যকর সমাধান এখন সবচেয়ে জরুরি।
>> আরও পড়তে পারেন
পুলিশের ওপর একের পর এক হামলা, মাঠ পর্যায়ে কঠোর নির্দেশনা
চ্যালেঞ্জগুলোর বিষয়ে ঢাকা মেইলকে ড. তৌহিদুল হক বলেন, ‘অবৈধ অস্ত্র এখনো বড় সমস্যা হয়ে আছে। বিশেষ করে থানা থেকে পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্রের একটি বড় অংশ এখনো উদ্ধার হয়নি। এছাড়া সীমান্ত দিয়ে দেশে প্রবেশ করা অস্ত্র উদ্ধারের ক্ষেত্রেও দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। নির্বাচনী প্রচারণাকে ঘিরে যেসব সহিংস ঘটনা ঘটছে, সেগুলোতে দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে তা বিলম্বিত হচ্ছে, আবার কোথাও কোথাও কার্যকর পদক্ষেপই নেওয়া হচ্ছে না। পাশাপাশি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সদস্যদের সক্রিয় করার বিষয়টিতেও ঘাটতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে এবং সামাজিক মাধ্যমে এআই দিয়ে গুজব ছড়ানোর বিষয়টি তো আছেই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেই এগুলো এড্রেস করা ও সমাধান করতে হবে।’
সমাধানের পথ তুলে ধরে এই অপরাধ বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘আসনভিত্তিক সমস্যা চিহ্নিত করে সেগুলো সমাধান করা প্রয়োজন। তবে যারা নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন তাদেরও উচিত প্রোগ্রামগুলোার এক বা দুই দিন আগে সে বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসনকে জানানো। তাহলে প্রশাসন ও গোয়েন্দারা মাঠ পর্যায়ে সেই প্রার্থীর নির্বাচনী অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে কোনো নিরাপত্তা ঝুঁকি আছে কি না, তারা তা পর্যবেক্ষণ করতে পারবে। এতে সহিংসতা কমবে ও আতঙ্ক কেটে যাবে।’
এমআইকে/এমআর

