রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহরে হাজার হাজার গৃহকর্মী প্রতিদিন বাসাবাড়িতে কাজ করছে। হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া এসব গৃহকর্মীর বেশির ভাগেরই পরিচয়, ঠিকানা, বয়স, অভিভাবক বা পূর্বের কর্মস্থলের কোনো তথ্য সংরক্ষণে নেই গৃহকর্তার। ফলে অনেক সময় গৃহকর্মী হত্যাসহ নানা অপরাধ করেও নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। তাছাড়া গৃহকর্মী নিখোঁজ হওয়া, নির্যাতনের শিকার হওয়া কিংবা বাসাবাড়িতে কোনো অপরাধ সংঘটিত হলেও তথ্যের অভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্তকাজ জটিল হয়ে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে এসব গৃহকর্মীকে খোঁজে পাওয়া যায় না।
সোমবার (৮ ডিসেম্বর) রাজধানীর মোহাম্মদপুরে একটি বাসায় মা ও মেয়েকে হত্যার পর গৃহকর্মীর পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। নতুন করে আলোচনায় এসেছে গৃহকর্মীদের কোনো তথ্য সংরক্ষণে না থাকার বিষয়টি।
বিজ্ঞাপন
স্থানীয় থানাগুলোর তথ্যমতে, গৃহকর্মীদের নিবন্ধন এখনো বাধ্যতামূলক নয়। অনেক সময় মালিকরা মনে করেন—গৃহকর্মীরা বাড়ির ভেতরের লোক। তাই আলাদা তথ্য রাখার প্রয়োজন মনে করেন না। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মতে, গৃহকর্মীদের পরিচয় যাচাই ও তথ্য সংরক্ষণ করা নিজেদের নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আইন কী বলছে
গৃহপরিচারিকা নিবন্ধন অধ্যাদেশ-১৯৬১ আইন রয়েছে। এ আইনটি শুধু ঢাকা সিটি করপোরেশনে প্রযোজ্য। আইনের ৩ ধারা অনুযায়ী, নিকটবর্তী থানায় গৃহকর্মী নিয়োগের পর নিবন্ধন করতে হয়। নিবন্ধনের জন্য গৃহকর্মীর নাম, ঠিকানা, ১ কপি ছবি, শরীরের মাপ, হাতের ছাপ ইত্যাদি প্রয়োজন হয়। আইনের ৪ ধারা অনুযায়ী নিবন্ধন ছাড়া কেউ কাজ করতে পারবে না। করলে ৬ ধারা অনুযায়ী সর্বোচ্চ এক মাসের জেল বা ১০০ টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
যে ঘটনায় আতঙ্কিত গৃহকর্তারা
সোমবার (৮ ডিসেম্বর) রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় মা লায়লা ফিরোজ ও মেয়ে নাফিজা লাওয়াল বিনতে আজিজকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডের পর দেশজুড়ে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে তাদের বাসায় কাজ করা কথিত গৃহকর্মী আয়েশার নাম উঠে এসেছে। তবে, হত্যাকাণ্ড ঘটানো এই গৃহকর্মীর কোনো তথ্য নেই গৃহকর্তাদের কাছে।
গৃহকর্তা বলছেন, তাদের বাসায় কখনো গৃহকর্মী প্রয়োজন হলে বাড়ির দারোয়ানকে বলে রাখা হয়। অনেকে কাজের সন্ধানে দারোয়ানের কাছে কাজের জন্য আসে। তখন যার গৃহকর্মীর প্রয়োজন দারোয়ান তার কাছে গৃহকর্মীকে পাঠিয়ে দেন। এরপর গৃহকর্তা ও গৃহকর্মীর আলাপের মাধ্যমে তাকে বাসায় কাজের সুযোগ দেওয়া হয়। আলোচিত হত্যাকাণ্ডের মাত্র চার দিন আগে ওই গৃহকর্মী কাজ শুরু করে। চার দিনের মাথায় সে এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটায়, যা রীতিমতো উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে।
কথিত এই গৃহকর্মীর কোনো তথ্য নেই গৃহকর্তার কাছে। শুধু তার নাম বলেছিল আয়েশা। এই নাম সঠিক কি না তাও যাচাই-বাছাই করা হয়নি। এছাড়া আগে কোথায় কাজ করতো, পরিচিত আত্মীয়-স্বজনদের মোবাইল নাম্বার কিংবা বাসাবাড়ির কোনো ঠিকানা নেই কারও কাছে।
এর আগে, মোহাম্মদপুর এলাকার আরেক বাসিন্দা মুহসিন উদ্দিনের বাসা থেকে ১০ দিনের মাথায় গৃহকর্মী পাঁচ লাখ টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় গৃহকর্মীর কোনো তথ্য না থাকায় আইনানুগ কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেননি মুহসিন উদ্দিন। তিনি বলেন, আমি বাড়ির দারোয়ানকে বলে রেখেছিলাম, কেউ কাজের জন্য এলে আমার বাসায় পাঠাতে। আমার বাসায় কাজের লোক প্রয়োজন। সে অনুযায়ী এই গৃহকর্মীকে রাখা হয়। সে সকালে এসে কাজ করে দিয়ে যেতো। একদিন সে বাসায় কেউ না থাকার সুযোগে আলমারি ভেঙে পাঁচ লাখ টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়। তার একটা নাম্বার ছিল। সে নাম্বার বন্ধ করে ফেলায় আর তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে কোনো আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পারিনি।
আতঙ্কে নগরবাসী, অনেকে বাদ দিচ্ছেন গৃহকর্মী
পরপর কয়েকটি ঘটনার পর নগরবাসীর অনেকের মনে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। অনেকে লিখছেন, তাদের বাসায় কাজের বুয়া আর রাখবেন না। কেউ কেউ আতঙ্কিত হয়ে কাজের বুয়া অর্থাৎ গৃহকর্মীকে বিদায় করে দিয়েছেন বলেও জানাচ্ছেন।
মোহাম্মদপুর আজিজ মহল্লার বাসিন্দা ইকবাল হোসেন বলেন, আমি গত কয়েক মাস যাবৎ এক বুয়াকে বাসায় কাজ করতে রেখেছি। গতকাল এই হত্যার ঘটনার পর আমি তাকে মানা করে দিয়েছি। তাকে মানা করার সময় অগ্রিম আরও এক মাসের বেতন দিয়ে বলেছি, তোমার আর কাজে আসার দরকার নেই।
একই এলাকার বাসিন্দা সুরভী জাহান বলেন, আমি এক বুয়াকে এক মাস যাবত রেখেছি। সে শুধু সকালে এসে ঘর পরিষ্কার করে কাপড় ধুয়ে চলে যায়। তার মোবাইল নাম্বার ছাড়া আর কোনো কিছুই আমার কাছে নেই। গতকাল এমন ঘটনার পর আমি তাকে নিষেধ করে দিয়েছি। কিন্তু সে মানতে চায় না। সে বলে মাসের মাঝখানে এভাবে মানা করে দিলে আমি কোথায় কাজ পাবো। আমি তখন তাকে এক মাসের বাড়তি বেতন দিয়ে দিয়েছি। এরপরও আমি বুয়া রাখতে চাই না।
গৃহকর্মীদের যাবতীয় তথ্য সংরক্ষণের তাগিদ
দুঃস্থ স্বাস্থ্য কেন্দ্র (ডিএসকে) এর সুনীতি প্রকল্পের আইনজীবী অনুপমা বৌদ্ধ ঢাকা মেইলকে বলেন, আমরা গৃহকর্মীদের নিয়ে ঢাকার চারটি এরিয়া মিরপুর, মোহাম্মদপুর, বাড্ডা ও খিলগাঁওয়ে কাজ করি। এসব এলাকায় যে গৃহকর্মীরা কাজ করে তাদের তথ্য আমরা সংগ্রহ করি। এই চারটি এরিয়ায় মোট ১৬ হাজারের মতো গৃহকর্মীর তথ্য আমাদের কাছে আছে। আমরা শুধু গৃহকর্মী না, যারা বাসায় গৃহকর্মীদের কাজের জন্য রেখেছেন সেই গৃহকর্তাদের তথ্য যেমন, এনআইডি চুক্তিপত্রসহ নানা ধরনের তথ্য রাখি। যেন কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে আমরা যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পারি। তবে মোহাম্মদপুর এরিয়ার গতকাল যে নৃশংস ঘটনা ঘটেছে, এই গৃহকর্মীর কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই। বিষয়টা নিয়ে আমরা অন্যান্য গৃহকর্মীদের সাথে কথা বলেছি তাকে কেউ চিনে কি না। কিন্তু কেউ তার কোনো তথ্য আমাদের দিতে পারেনি।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস)-এর উপ-পরিচালক ইউসুফ আল মামুন ঢাকা মেইলকে বলেন, গৃহস্থালি কর্মী এবং গৃহশ্রমিক নিয়ে বিভিন্ন নির্দেশনা দেওয়া আছে। তবে, গৃহকর্মী বলে কোথাও কোনো নিয়মবিধি নেই। দেশে প্রায় ১২টির মতো অরগানাইজেশন আছে, যারা গৃহকর্মী নিয়ে কাজ করে। আমাদের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিলস ও তাদের সাথে কাজ করে। থানাতে নিয়মিত বাসাবাড়ির ভাড়াটিয়া কিংবা বাড়ির মালিকদের সেসব তথ্য দেওয়া হয়। সে সময় গৃহকর্মীদের তথ্য দেওয়ার নিয়ম আছে। সেসব তথ্য পুলিশ সরাসরি ভাড়াটিয়া ফরমের মাধ্যমে নিচ্ছে। কিন্তু অনেক বাড়ির মালিক কিংবা গৃহকর্তা গৃহকর্মীদের তথ্য পুলিশকে দিতে চায় না। যার ফলে গৃহকর্মীদের তেমন কোনো তথ্য খুঁজে পাওয়া যায় না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মো. তৌহিদুল হক ঢাকা মেইলকে বলেন, গৃহকর্মী দ্বারা যে নৃশংস হত্যার ঘটনা ঘটেছে এর নেপথ্যে হতে পারে, ওই গৃহকর্মী একজন সাইকো কিলার। এজন্য সে তাকে সবকিছু থেকে আড়াল করে কোনো তথ্য কিংবা ফোন নাম্বার পরিবারের কাউকে দেয়নি। আমাদের দেশে বিভিন্ন বিদেশি চ্যানেলের ছবি কিংবা এমন নৃশংস ডকুমেন্টরি দেখে দেখে সমাজে এমন ঘটনাগুলো বেশি ঘটছে। তবে এই কথিত গৃহকর্মীকে গ্রেফতারের পর হয়ত জানা যাবে সে এর আগে এমন আর কোনো ঘটনা ঘটিয়েছে কি না।
এই বিশেষজ্ঞ বলেন, এমন অপরাধ কর্মকাণ্ড থেকে রক্ষা পেতে হলে আমাদের পরিবারের গৃহকর্মীর কাজ করা প্রতিটা গৃহকর্মীর যাচাই বাছাইয়ের মাধ্যমে সঠিক নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর, এনআইডি এবং একজন নিকটাত্মীয়ের বায়োডাটা রাখা জরুরি। সেই সাথে থানাগুলোতে জমা দেওয়া ভাড়াটিয়া ফরমের সাথে গৃহকর্মীদের জন্মনিবন্ধন কিংবা ভোটার আইডিসহ তথ্য দিতে হবে। এমন আইন প্রয়োগ করলে গৃহকর্মী দ্বারা এমন নৃংশস ঘটনা কিংবা গৃহকর্মীকে নির্যাতন অনেকটা কমে যাবে। এছাড়াও, কেউ নিখোঁজ হলে খুব দ্রুত তাকে খুঁজে পাওয়া সহজ হবে। গৃহকর্মীদের সাথে আমাদের সবাইকে এগিয়ে এলে এমন ঘটনা আমাদের সমাজ থেকে দূর হবে।
একেএস/জেবি

