গত কয়েক বছর ধরে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তালাকের প্রবণতা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। সামান্য কারণেই ভেঙে যাচ্ছে সাজানো সংসার। এমনকি দাম্পত্য কলহ থেকে হত্যা ও আত্মহত্যার মতো ঘটনাও ঘটছে। এর পেছনে বড় কারণ হিসেবে যৌথ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়াকে চিহ্নিত করেছেন সমাজ বিশ্লেষকরা।
তারা জানিয়েছেন, আগে সাধারণত স্বামী-স্ত্রী যৌথ পরিবারে থাকতেন। দাম্পত্য জীবনে ছোটখাটো সমস্যা হলে পরিবারের সদস্যরা তা মিটমাট করে দিতেন। কিন্তু বর্তমানে নগরজীবনে সাধারণত স্বামী-স্ত্রী আলাদা বাসায় থাকছেন। ফলে তাদের মধ্যে ঘটে যাওয়া মনোমালিন্য ও কলহ মেটানোর মতো কেউ নেই। যে বিষয়টি সামান্যতেই থেমে যেতে পারতো তা অনেক দূর পর্যন্ত গড়াচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে গত পাঁচ বছরে তালাকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬৪ হাজার ৫৯৯টি। যার মধ্যে নারীরা তালাকের দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে। পাশাপাশি পুলিশের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া থেকে হত্যাকাণ্ড কিংবা আত্মহত্যার মতো ঘটনাও ঘটছে।
দুই সিটিতে নারীদের করা ডিভোর্সের আবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, স্বামীর সঙ্গে বনিবনা না হওয়া, ভরণ-পোষণ না দেওয়া, স্বামীর সন্দেহবাতিক মনোভাব, কাবিন না হওয়া, স্বামী মাদকাসক্তি, যৌতুক, নির্যাতন, মানসিক পীড়ন, পরকীয়া, আর্থিক সমস্যা, বেপরোয়া জীবনযাপন, বদমেজাজ, সংসারের প্রতি উদাসীনতা, সন্তান না হওয়া, টিকটকসহ সামাজিক মাধ্যমে অবাধ বিচরণ করাসহ বিভিন্ন কারণে ঘটছে বিচ্ছেদের ঘটনা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, আগে যৌথ পরিবারে বড়দের উপস্থিতি ও পরামর্শে অনেক দাম্পত্য কলহ সহজে মিটে যেত। এখন অনেক দম্পতি কর্মসূত্রে বা ইচ্ছাকৃতভাবে পরিবার থেকে আলাদা হয়ে ফ্ল্যাট বা ভাড়া বাসায় বসবাস করছেন। এতে তারা স্বাধীনতা পেলেও সমস্যার সময় পাশে পরামর্শদাতা বা সমঝোতা করে দেওয়ার মতো কেউ থাকেন না। এতে দেখা যায়, ছোটখাটো ভুল বোঝাবুঝি থেকে অনেক সময় তা বড় আকার ধারণ করে। এক পর্যায়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ হয়ে যায়।
বিজ্ঞাপন
>> আরও পড়তে পারেন
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, গত তিন বছরে নগর এলাকায় ডিভোর্সের আবেদন বেড়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। এর মধ্যে বেশির ভাগ মামলাই এসেছে নতুন দম্পতিদের কাছ থেকে, যারা অনেকে এখনো সন্তান জন্ম দেননি কিংবা এক সন্তানের জনক। তবে, বিয়ের পাঁচ বছরের মধ্যেই বিচ্ছেদের পথ বেছে নিচ্ছেন অনেক দম্পতি।
৫ বছরে ঢাকায় তালাক আবেদনের পরিসংখ্যান
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের তথ্য বলছে, তালাকের ক্ষেত্রে নারীরা সবচেয়ে এগিয়ে। এর মধ্যে ঢাকায় বসবাসরত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) তথ্য মতে, ২০২০ সালে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মোট তালাকের আবেদন পড়েছে ৬ হাজার ১৬৮টি। এর মধ্যে নারী করেছেন ৪ হাজার ৫৩টি আর পুরুষ করেছেন ২ হাজার ১১৫টি। এর মধ্যে মোট তালাক কার্যকর হয়েছে ৩ হাজার ৪৪২টি।
২০২১ সালে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মোট তালাকের আবেদন পড়েছে ৭ হাজার ৪১৪টি। ৪ হাজার ৮১টি আবেদন করেছেন নারী। আর ১ হাজার ৭৬২টি আবেদন করেছেন পুরুষ। এ বছরে মোট তালাক কার্যকর হয়েছে ৪ হাজার ৬৭৪টি।
২০২২ সালে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মোট তালাকের আবেদন পড়েছে ৫ হাজার ৫৯০টি। ৩ হাজার ৬৩৭টি আবেদন করেছেন নারী। আর ২ হাজার ২টি আবেদন করেছেন পুরুষ। মোট তালাক কার্যকর হয়েছে ৪ হাজার ২১১টি।
২০২৩ সালে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মোট তালাকের আবেদন পড়েছে ৬ হাজার ৩৯৯টি। ৪ হাজার ১৮২টি তালাকের আবেদন করেছেন নারী, ২ হাজার ২১৭টি আবেদন করেছেন পুরুষ। এ বছরে মোট তালাক কার্যকর হয় ৩ হাজার ৪৩৫টি।

২০২৪ সালে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মোট তালাকের আবেদন পড়েছে গড়ে ২ হাজার ৫২১টি। ১ হাজার ৫৬১টি তালাকের আবেদন করেছেন নারীরা। আর ৯৬০টি আবেদন করেছেন পুরুষ। মোট তালাক কার্যকর হয় ১ হাজার ৫০৮টি।
এই সিটি থেকে গত পাঁচ বছরে মোট তালাকের আবেদন পড়েছে ২৮ হাজার ৯২টি। এর মধ্যে পুরুষরা আবেদন করেছেন ৯ হাজার ৫৬টি এবং নারীরা করেছেন ১৭ হাজার ৫১৪টি।
>> আরও পড়তে পারেন
এদিকে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) গত পাঁচ বছরে তালাকের জন্য ৩৬ হাজার ৫০৭টি আবেদন করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৬ হাজার ৪৪টি আবেদন করে ডিভোর্স দেওয়ার শীর্ষ স্থানে রয়েছেন নারীরা। এছাড়াও, পুরুষ ডিভোর্সের জন্য ১০ হাজার ৪৬৩টি আবেদন করেছেন।
ডিএসসিসির তথ্য মতে, ২০২০ সালে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তালাকের আবেদন পড়েছে ৬ হাজার ৩৪৫টি। ৪ হাজার ৪২৮টি আবেদন করেছেন নারী। আর এ বছরে ১ হাজার ৯১৭টি আবেদন করেছেন পুরুষ।
২০২১ সালে মোট তালাকের আবেদন পড়েছে ৭ হাজার ২৪৫টি। ৫ হাজার ১৮৩টি আবেদন করেন নারী। আর ২ হাজার ৬২টি আবেদন করেন পুরুষ।
২০২২ সালে মোট তালাকের সংখ্যা ৭ হাজার ৬৯৮টি। নারীরা করেছেন ৫ হাজার ৩৮৩টি। আর পুরুষ ২ হাজার ৩১৫টি।
২০২৩ সালে মোট তালাকের আবেদন ৭ হাজার ৩০৬টি। নারীরা করেছেন ৫ হাজার ২৮৬টি। আর পুরুষ ২ হাজার ২০টি।
২০২৪ সালে মোট তালাকের আবেদন সংখ্যা ৭ হাজার ৯১৩টি। নারীরা করেছেন ৫ হাজার ৭৬৪টি। পুরুষ আবেদন করেছেন ২ হাজার ১৪৯টি।

সামাজিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য অনুযায়ী, গত কয়েক বছরে শহরে আলাদাভাবে বসবাসকারী দম্পতিদের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, যৌথ পরিবারে নানা চাপ থাকলেও সেখানে সমস্যা হলে পরামর্শ, সহায়তা ও অভিভাবকত্বের ভূমিকা থাকে। কিন্তু নিউক্লিয়ার বা পৃথক পরিবারে সেই সাপোর্ট সিস্টেম না থাকায় দাম্পত্যে মানসিক চাপ দ্রুত বেড়ে যায়।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. আরিফুল ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সামান্য তর্ক-বিতর্কও যদি কেউ সামাল দেওয়ার মতো পরিবেশ বা মানুষ না থাকে, তা দাম্পত্য ভাঙনের দিকে ঠেলে দেয়। এর ফলে দাম্পত্য সহিংসতা বাড়ছে, যা কখনো কখনো হত্যাকাণ্ডেও পরিণত হচ্ছে।’
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমাদের দেশে যৌথ পরিবার থেকে আলাদা থাকার প্রবণতা ব্যাপক হারে বেড়েছে। যার ফলে স্বামী-স্ত্রী যৌথ পরিবার থেকে আলাদা থাকছে। সেখানে নানা বিষয় নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ছোটখাটো ঝগড়া থেকে তালাক কিংবা ডিভোর্স অথবা হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা ঘটছে। ছোট-খাটো ঘটনা নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া লাগতেই পারে। কিন্তু স্বামী-স্ত্রী যৌথ পরিবারে থাকলে তাদের ঝগড়া বেশিদূর এগোতে পারে না। পরিবারের মুরব্বিরা সেখানে তাদের ঝগড়া সমাধান করে দেন।’
>> আরও পড়তে পারেন
এই আইনজীবী বলেন, ‘আগে সবচেয়ে বেশি মামলা হতো স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ডিভোর্স হলে কে বাচ্চা নেবে সেটা নিয়ে। এখন সবচেয়ে বেশি যে ঘটনাটি আদালতে দেখা যায়, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ডিভোর্স হলে বাচ্চা কেউ রাখতে চান না। স্বামী চান স্ত্রীর ওপর বাচ্চা চাপিয়ে দিতে। আর স্ত্রী চান স্বামীর ওপর চাপিয়ে দিতে। মোটকথা, কেউ নিজের কাছে বাচ্চাকে রাখতে চান না।’
‘আরেকটা বিষয় সবচেয়ে বেশি আদালত পর্যন্ত গড়ায়, সেটা হলো- বাচ্চার জন্ম নিবন্ধনের ক্ষেত্রে বাবা কিংবা মা তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) দিতে চান না। যার ফলে শিশুর জন্মনিবন্ধন করতে সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। এ বিষয়টি সমাজে সবচেয়ে বেশি ঘটছে এখন এবং বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়াচ্ছে। মূলত আগে যে পারিবারিক মূল্যবোধ ছিল এখন আর সেটা নেই। মূল কথা হলো আমাদের মধ্যে নৈতিকতা নেই।’
জাতীয় মানসিক ইনস্টিটিউটের পরিচালক ডা. মাহবুবুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘সমাজের বেশির ভাগ মানুষ ট্রমাটাইজ। যারা নানা রকম সমস্যার মধ্যে ভুগছে। স্বামী তার স্ত্রীকে সন্দেহ করছে, স্ত্রী তার স্বামীকে সন্দেহ করছে। আর এই সমস্যাগুলো থেকে অনেকে নানা মানসিক সমস্যায় ভুগছে। এমন রোগীদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি এখন। তারা নিয়মিত কনসালটেন্সি নেয়। এছাড়াও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের ফলে নানা রকম নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এতে স্বামী-স্ত্রীর জীবন বিপন্ন হচ্ছে। বেশির ভাগ মানুষ আমাদের কাছে এসে এ সমস্যার কথা তুলে ধরেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাবে কম নিদ্রা ও রাত জেগে থাকার প্রবণতা বৃদ্ধির কারণে এমন সমস্যা সবচেয়ে বেশি। তাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের আমাদের যথেষ্ট সচেতন হওয়া জরুরি।’
একেএস/জেবি/এএস

