শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

মিরপুরে আগুন: ২৫ ফুট দূরত্বে দুই প্রতিষ্ঠানে আগুন ছড়াল কীভাবে

মোস্তফা ইমরুল কায়েস
প্রকাশিত: ১৯ অক্টোবর ২০২৫, ১০:১৫ পিএম

শেয়ার করুন:

মিরপুরে আগুন: ২৫ ফুট দূরত্বে দুই প্রতিষ্ঠানে আগুন ছড়াল কীভাবে

মিরপুরের রূপনগরে গার্মেন্টস ও কেমিক্যাল কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সন্দেহ দেখা দিয়েছে—এটি কি কেমিক্যাল থেকে, নাকি অন্য কিছুর বিস্ফোরণ থেকে ঘটেছে? ফায়ার সার্ভিস, ক্রাইম ও পুলিশ শুরু থেকেই বলছে, কেমিক্যাল গুদাম থেকেই আগুনের সূত্রপাত। কিন্তু আসলে কোন প্রতিষ্ঠান থেকে এবং কীভাবে আগুন একই সঙ্গে গার্মেন্টস কারখানা ও কেমিক্যাল গুদামে ছড়াল, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

তবে ঢাকা মেইলের কাছে কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী দাবি করেছেন, এটি কেমিক্যাল থেকে নয়, বরং অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে সিলিন্ডার বিস্ফোরণ থেকে। তাদের দাবি, বিস্ফোরণের আগে সিলিন্ডারগুলোতে তিতাসের টানা লাইনের গ্যাস ভরা হচ্ছিল। হঠাৎ একটি সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়, সেখান থেকেই দুর্ঘটনা ঘটে।


বিজ্ঞাপন


এলাকাবাসী ও কয়েকটি কারখানার শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলেও একই দাবি পাওয়া গেছে।

তবে গত পাঁচ দিনেও কেউ স্পষ্ট করে বলতে পারেনি আগুনের উৎস কী। সবাই এক কথায় বলছে, কেমিক্যাল গুদাম থেকেই বিস্ফোরণ হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো—কেমিক্যাল গুদামে তো ছিল শুষ্ক কেমিক্যাল। তাহলে সেই শুষ্ক কেমিক্যাল থেকে আগুন ধরল কিভাবে?

২৫ ফুট দূরত্বে দুটি প্রতিষ্ঠানে একই সময়ে আগুন লাগল কীভাবে

রূপনগরের শিয়ালবাড়ীর ঘটনাস্থল পরিদর্শনে দেখা গেছে, সেখানে আগুনে তিনটি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে—একটি কেমিক্যাল গুদাম ও দুটি গার্মেন্টস কারখানা। কেমিক্যাল গুদাম থেকে দুই গার্মেন্টস কারখানার দূরত্ব প্রায় ২৫ ফুট, মাঝখানে একটি পিচঢালা পাকা রাস্তা। তাহলে এই দূরত্বে একই সময়ে দুটি প্রতিষ্ঠানে আগুন লাগল কিভাবে? বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে পুলিশ, আনসার, ফায়ার সার্ভিস, সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিট ও গোয়েন্দাদের। তারা শুরু থেকেই বলছেন, কেমিক্যাল গুদাম থেকেই আগুনের সূত্রপাত। তবে সেই শুকনো কেমিক্যালে আগুন ধরল কিভাবে, সেটিও তাদের কাছে প্রশ্ন।


বিজ্ঞাপন


ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক কাজী নজমুজ্জামান বলেন, আমরা সেখানে একটি কাভার্ড ভ্যান পেয়েছি। তবে কোন সাইট থেকে আগুনের সূত্রপাত, তা তদন্তসাপেক্ষ।

এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের মিরপুর স্টেশনের সিনিয়র অফিসার শাহজাহান সিরাজ বলেন, আমি প্রথমে ঘটনাস্থলে যাই। গিয়ে দেখি দুটি কাভার্ড ভ্যানের চাকা ও পাশে থাকা গার্মেন্টস ও কেমিক্যাল গুদামে আগুন জ্বলছে। তখন আমি দ্রুত কন্ট্রোলে কল করে জানাই, আগুন ছড়িয়ে গেছে। এরপর আমরা কাজ শুরু করি।

আরও পড়ুন: মিরপুরে ১৬ শ্রমিকের মৃত্যুর সম্ভাব্য কারণ জানাল বোম্ব ডিসপোজাল টিম

সিআইডির ক্রাইম সিনের টিম সদস্য এসআই শহীদুল ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, এত দূরত্বে একই সময়ে দুটি প্রতিষ্ঠানে আগুনের ঘটনাটা আমাদেরও ভাবাচ্ছে। কিভাবে সম্ভব এত বড় আগুন? তার ধারণা, বড় কোনো বিস্ফোরণ ছাড়া এই দুর্ঘটনা অসম্ভব। তবুও তারা তদন্ত চালাচ্ছেন।

এলাকাবাসী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য

এলাকাবাসী জানিয়েছে, ৫ নম্বর সড়কের এক পাশে তিনতলা গার্মেন্টস কারখানা এবং সড়কের অপরপাশে কেমিক্যাল কারখানা। একটি প্রতিষ্ঠান থেকে আরেকটির দূরত্ব কমপক্ষে ৩০ থেকে ৩৫ ফুট—এটাই রাস্তার প্রস্থ।

প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, রাস্তার উত্তর পাশে যে গার্মেন্টস কারখানাটি রয়েছে, সেটির নিচে সব সময় সিলিন্ডার রাখা হতো। সেগুলোতে লাইনের গ্যাস ভরে কারখানার বয়লারের কাজ চালানো হতো। প্রতিদিনের মতো সেদিনও গ্যাস ভরানো হচ্ছিল। হঠাৎ একটি সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়, সেখান থেকেই ঘটে এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা।

picture

তারা আরও জানান, সিলিন্ডারটি বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে মাটি থেকে ওপরে উঠে যায়। কয়েক ফুট ওপরে উঠে নিচে পড়ার সময় পাশেই থাকা তিনটি মোটরসাইকেলের ওপর পড়ে বিস্ফোরণ ঘটে। মোটরসাইকেলগুলো বিস্ফোরিত হলে সেগুলোর তেল ছড়িয়ে পড়ে দুই পাশের রাস্তার ধারে থাকা গার্মেন্টস ও কেমিক্যাল কারখানায়। মুহূর্তেই আগুন লেগে যায়।

সেই ঘটনার পাশের গার্মেন্টস কারখানায় চাকরি করেন রাজু, মনির ও সোহেল। তারা আগুন লাগার পরের প্রত্যক্ষদর্শী।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ওই সময় সকালের শিফটে কাজ চলছিল আরএন গার্মেন্টস কারখানায়। দেড় ঘণ্টা পর দুপুরের খাবারের বিরতি দেওয়ার কথা ছিল, তাই সবাই কাজে ব্যস্ত ছিলেন। হঠাৎ বিকট শব্দ শোনা যায়। অনেকে ভেবেছিলেন বিদ্যুতের খুঁটিতে থাকা ট্রান্সফরমার বিস্ফোরিত হয়েছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই কারখানায় ধোঁয়া ঢুকতে শুরু করে।

প্রত্যক্ষদর্শী সোহেলের ভাষ্য, তারা আগুন লাগার ১০ মিনিটের মধ্যে সেখানে পৌঁছে দেখেন, গার্মেন্টস কারখানার সামনে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। তিনি বলেন, তিনি স্পষ্ট দেখেছেন তিনটি মোটরসাইকেল ও একটি কাভার্ড ভ্যান জ্বলছে। পরে জানতে পারেন, প্রথমে সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ঘটে, সেটি উড়ে গিয়ে মোটরসাইকেলগুলোর ওপর পড়ে। তার ধারণা, মোটরসাইকেলগুলো ব্লাস্ট হয়ে আগুন ধরে কেমিক্যাল গুদাম ও গার্মেন্টস কারখানার সামনে।

তিনি আরও বলেন, ওই সময় গার্মেন্টস কারখানার এক মেয়ে ভবনের দ্বিতীয় তলা থেকে জানালা ভাঙার চেষ্টা করছিল। তখনো নিচতলায় আগুন ঢোকেনি, শুধু বাইরে গেটের মুখে আগুন জ্বলছিল। আগুনের তাপ এত বেশি ছিল যে, আমরা তাকে বের করে আনতে সাহস পাইনি। আমি দ্বিতীয় তলার সিঁড়ি পর্যন্ত উঠলেও গরমের তাপে উপরে যেতে পারিনি, বাধ্য হয়ে নেমে আসি।

প্রত্যক্ষদর্শী মনিরের দাবি, যে গার্মেন্টস কারখানা থেকে ১৬ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে, সেটির নিচে লাইনের গ্যাস ছিল। প্রায় প্রতিদিনই সেখানে সিলিন্ডারে গ্যাস ভরানো হতো। বিষয়টি এলাকার সবাই জানে, কিন্তু এখন কেউ মুখ খুলবে না।

তার দাবি, ঘটনার সময় সিলিন্ডারে গ্যাস ভরানো হচ্ছিল। হঠাৎ একটি সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়, সেখান থেকেই এত বড় আগুন লাগে। প্রথমে গার্মেন্টস কারখানায় আগুন ধরে, পরে প্রায় ১০ মিনিট পর কেমিক্যাল গুদামেও আগুন ছড়িয়ে পড়ে।

তবে গার্মেন্টস কারখানা ও কেমিক্যাল গুদামের দূরত্ব প্রায় ২৫ ফুট হওয়ায়, একই সময়ে দুটি প্রতিষ্ঠানে আগুন লাগার বিষয়টি সিআইডির ক্রাইম সিন টিমকেও ভাবিয়ে তুলেছে।

picture

তাদের সহকর্মী রাজুর দাবি, আগুন লাগার ২০-২৫ মিনিট পর ফায়ার সার্ভিসের টিম আসে। তারা এসে পাইপ লাগানো, মেশিন চালু ও অন্যান্য কাজ শেষ করতে আরও ১০ মিনিট নেয়। এরপর আগুন নেভানোর কাজ শুরু হয়। ততক্ষণে আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছিল। রাজুও দেখেছেন, তিনটি মোটরসাইকেল ও একটি কাভার্ড ভ্যানে আগুন জ্বলছে।

তবে শ্রমিকদের দাবি অনুযায়ী গার্মেন্টস কারখানার নিচে লাইনের গ্যাস ছিল না বলে জানিয়েছেন মিরপুর ফায়ার স্টেশনের সিনিয়র অফিসার শাহনেওয়াজ সিরাজ। তিনি বলেন, আমরা গার্মেন্টস কারখানার নিচে কোনো গ্যাস লাইন পাইনি। তবে দুটি কাভার্ড ভ্যান দেখেছি, যা এখনও সেখানে রয়েছে।

সরেজমিন যা দেখা গেল

শনিবার দুপুরে ওই এলাকায় ঢাকা মেইলের পক্ষ থেকে আবারও যাওয়া হয়। সরেজমিন দেখা যায়, গার্মেন্টস কারখানার নিচে একটি পোড়া মোটরসাইকেল পড়ে আছে। তবে কাভার্ড ভ্যানটির কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। তখনও ফায়ার সার্ভিসের বিস্ফোরক টিমের সদস্যরা কাজ করছিলেন।

এদিকে রাজু, মনির ও সোহেল ঘটনার সময় তিনটি মোটরসাইকেল ও একটি কাভার্ড ভ্যানের কথা জানালেও সেখানে একটি মোটরসাইকেলই খুঁজে পাওয়া গেছে। তবে সেটি সেদিন পুড়েছিল কি না, ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা তা নিশ্চিত করতে পারেননি।

তাদের মোবাইলে ধারণ করা সেদিনের একটি ভিডিও ঢাকা মেইলের হাতে এসেছে। সেই ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। আগুন থেকে খানিকটা দূরে একটি কাভার্ড ভ্যানেও আগুন জ্বলছে। তখনও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছাননি।

আশপাশের সব মালিক পলাতক

মিরপুর ফায়ার স্টেশনের সিনিয়র অফিসার শাহনেওয়াজ সিরাজ বলেন, আমরা এ ঘটনায় সিসি ক্যামেরার ফুটেজ খুঁজছি। কিন্তু সেদিনের পর থেকে আশপাশের সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ। কোনো মালিককেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

এলাকাবাসী জানিয়েছে, ওই এলাকার অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান অবৈধ। কারও লাইসেন্স নেই, কারও ফায়ার সেফটি সার্টিফিকেট নেই। আবার কেউ কেউ ভবনের ওপর টিনসেড তুলে অতিরিক্ত তলা তুলেছেন। এসব কারণে অধিকাংশ মালিক এখনো এলাকায় যাচ্ছেন না বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এমআইকে/এআর

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর