আগামী ১৭ অক্টোবর সাক্ষরিত হতে যাচ্ছে জুলাই জাতীয় সনদ। এরপর সনদ বাস্তবায়নে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত বা সম্মতি নিতে গণভোট আয়োজনের বিষয়টি চূড়ান্ত রূপ পেতে যাচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি একমত হন, সরকারের নির্দেশে নির্বাচন কমিশন যেকোনো সময় দেশের জনগণের সরাসরি মত নিতে ভোট আয়োজন করতে প্রস্তুত। জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিষয়টি বাস্তবায়নে প্রস্তুতি নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন।
ইসি কর্মকর্তারা জানান, ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি ইতোমধ্যেই চলছে। এতে ১২ কোটি ৬৩ লাখেরও বেশি ভোটারের জন্য ৪২ হাজারের বেশি ভোটকেন্দ্র স্থাপন করা হবে। প্রবাসী ভোটারদের জন্য ৪০০ কোটি টাকারও বেশি ব্যয় করে আইটি-সাপোর্টেড পোস্টাল ব্যালট ব্যবস্থা আনা হচ্ছে। ভোটগ্রহণ কার্যক্রমে নিয়োজিত থাকবে ১০ লাখের বেশি জনবল।
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন: গণভোটে জনমতের প্রতিফলন কতটা ঘটে?
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জানিয়েছে, গণভোট আয়োজনের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো এখন একমত। তবে নির্বাচনের দিন নির্ধারণে কিছু ভিন্নমত আছে। কেউ চাইছেন সংসদ নির্বাচনের দিন একসঙ্গে ভোট হোক, কেউ চাইছেন এক মাস আগে।
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সময় নিয়ে এমন মতভেদ থাকায় জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে গণভোটের সময়ের বিষয়টি নিজেদের সুপারিশে রাখতে চাইছে না জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। গণভোট আয়োজনের সময়ের বিষয়টি অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দেওয়ার চিন্তা করছে কমিশন। সরকারের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিলে ইসি যেকোনো সময়ে গণভোট আয়োজনের জন্য প্রস্তুত থাকবে।
গণভোট জাতীয় নির্বাচনকে প্রভাবিত করবে না: ইসি
বিজ্ঞাপন
নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গণভোট কোনো প্রভাব ফেলবে না। সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গণভোট আয়োজনে প্রস্তুত থাকবে নির্বাচন কমিশন।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ বলেন, ‘গণভোটের বিষয়টা নির্ভর করছে পলিটিক্যাল কনসেসসাসের ওপর। এটা (গণভোটের সিদ্ধান্ত) রাষ্ট্রীয় ব্যাপার, সরকারের ব্যাপার। সরকার যদি মনে করে গণভোট করবে, তাহলে আমরা গণভোট ইনশাআল্লাহ করব।”
তিনি আরও বলেন, ‘একজন নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নয়, দেশের একজন সিনিয়র সিটিজেন হিসেবে বলছি-গণভোট যদি করতেই হয় তাহলে একদিনের করাটাই ভালো হবে। দুই নির্বাচন একত্রে করলে কোটি কোটি টাকা বেঁচে যাবে।’
আব্দুর রহমানেল মাছউদ বলেন, ‘সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একসঙ্গে সম্ভব। তবে ভোটকেন্দ্র ও ভোটকক্ষ কিছু বাড়ানো লাগতে পারে। আইনগত কোনো সমস্যা থাকার কথা নয়। জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস। এখন একটা জিনিস জনগণের কাছে প্লেস করা হচ্ছে, জুলাই সনদে এই লেখা রয়েছে- আপনি পক্ষে দেবেন, নাকি বিপক্ষে দেবেন।’
গণভোট ও সংসদ নির্বাচন একসঙ্গে করার কথা উল্লেখ করে এই নির্বাচন কমিশনার বলেন, “শত কোটি সাশ্রয়ের জন্য একসঙ্গে ভোট করা ভালো। কোটি কোটি টাকা খরচ, কষ্ট, লোক নিয়োগ, কত অ্যারেঞ্জমেন্ট করতে হয়- সেক্ষেত্রে আলাদা দিনে না করে একত্রে করলে দেশের জন্য অধিকতর মঙ্গল। (ভোটকেন্দ্র, ভোটার, রিটার্নিং অফিসার, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা) সবই একই থাকবে, শুধু দুটো ব্যালট পেপার। একটা জাতীয় নির্বাচনের, আরেকটা নরমাল গণভোটের।”
গণভোট কী এবং দেশের ইতিহাস
গণভোট হলো জনগণের সরাসরি মতামত নেওয়ার একটি প্রক্রিয়া। এর মাধ্যমে জনগণ কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নিজেদের সিদ্ধান্ত প্রকাশ করতে পারে।
বাংলাদেশে এ পর্যন্ত তিনটি গণভোট হয়েছে। প্রথমটি হয়েছে ১৯৭৭ সালের ৩০ মে। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান অনুসৃত নীতি ও কর্মপন্থার প্রতি জনগণের মতামত যাচাইয়ের জন্য ওই গণভোট হয়েছিল। এতে ৯৮.৮% হ্যাঁ এবং ১.১২% না ভোট দেন।
১৯৮৫ সালের ২১ মার্চ দ্বিতীয় গণভোট হয়েছিল। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের অনুসৃত নীতি ও কর্মপন্থার প্রতি আস্থা এবং স্থগিত সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠান পর্যন্ত তার রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত থাকার সম্মতির বিষয়ে ওই গণভোট হয়েছিল। মূলত তার সামরিক শাসনের বৈধতা দেওয়ার জন্য ওই গণভোট হয়েছিল। এতে ৯৪.১১% হ্যাঁ এবং ৫.৫০% না ভোট দেন।

১৯৯১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ১৪২ (১ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তৃতীয়বারের মতো গণভোট হয়। এ গণভোট ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জনগণের সামনে প্রশ্ন ছিল- ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান (দ্বাদশ সংশোধন) বিল, ১৯৯১-এ রাষ্ট্রপতির সম্মতি দেওয়া উচিত কি না?’ এ প্রশ্নের মাধ্যমে মূলত জনগণের কাছে ভবিষ্যতে দেশে কোন ধরনের সরকার পদ্ধতি হবে তা উপস্থাপিত হয়। এতে ৮৪% হ্যাঁ ভোট; আর না ভোট ছিল ১৫.৬২%।
যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা
সংসদ বিষয়ক গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন আহমদ জানান, ‘জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে গণভোট দেওয়াই হচ্ছে এখন সবচেয়ে সহজ উপায়। এক্ষেত্রে গণভোট করতে হলে আরপিও (গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ) সংশোধন করতে হবে, নির্বাচন কমিশনকে বলতে হবে গণভোট করেন।’
এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘২০১১ সালে গণভোটের বিধান বাতিল করা হয়েছে। এ বছর গণভোট বিধান ফেরানোর রায় এসেছে। সরকার চাইলে জনমত যাচাইয়ের জন্য গণভোট করতে পারে। মানুষ সায় দিলে নতুন সংসদ এলে সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় সংশোধনীগুলো আনা হবে। স্পেসিফিসিফিক চারটি আর্টিকেলে গণভোটের বিধান রয়েছে। কিন্তু আইনগত কোনো বাধা নেই। গণভোট করতে পারবেন। হাইকোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংক্রান্ত মামলার রায়ে গণভোট ফেরানোর কথা রয়েছে।’
১৯৯১ সালের গণভোট আয়োজনের অভিজ্ঞতা থাকা ইসির সাবেক কর্মকর্তা মিহির সারওয়ার মোর্শেদ বলেন, ‘১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর গণভোট আইন ও বিধি মেনে নির্বাচনটি হয়। সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে একসঙ্গে গণভোট করলে ব্যয় কমে হয়। দ্বাদশ সংবিধান সংশোধন বিল নিয়ে রাষ্ট্রপতি শাসিত থেকে সংসদীয় পদ্ধতিতে ফেরার বিষয়ে গণভোট হয়েছিল। গণভোটে কোনো প্রার্থী বা ভোটার স্লিপ থাকে না, তাই অংশগ্রহণ কম হয়। তবে রাজনৈতিক দল সহায়তা করলে উপস্থিতি বাড়তে পারে।’
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য আব্দুল আলীম জানান, ‘গণভোট আর সংসদ নির্বাচন ভিন্ন জিনিস। এজন্য নির্বাচন কমিশনকে দুই রকমের ব্যালট পেপার প্রস্তুত ও ব্যালট বাক্স আলাদা করতে হবে। সবশেষ ১৯৯১ সালে দেশের মানুষ গণভোট দিয়েছে, এরপর ভুলে গেছে এ জিনিস। গণভোট নিয়ে সাধারণ মানুষের ধারণা, জ্ঞান সেটার একটা শূন্যতা রয়েছে এতবছরের। কাজেই গণভোট কী, কেন এটা নিয়ে ব্যাপক প্রচার, সিভিক এডুকেশন দরকার পড়বে। সংসদ নির্বাচনের মতো এ প্রক্রিয়াটাও কমবেশি চ্যালেঞ্জিং। তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত হলে তাহলে ইসির জন্য বেশি চ্যালেঞ্জিং হবে না।’

আব্দুল আলীম বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্য হলে, গণভোটে সবাই এখন রাজি, কোন সময় হবে সেটা নিয়ে ভিন্নমত আছে। খুব গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ঐকমত্য। দলগুলো ঐকমত্য হলে এ সময়ে গণভোট করব; তাহলে আর কোনো চ্যালেঞ্জ থাকে না।’
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গণভোট জনমত যাচাইয়ের একটি পদ্ধতি, যা বহু দেশেই প্রচলিত। কমিশন প্রস্তাব করেছে, গণভোটের বিধানটি পরবর্তী সংসদে উত্থাপন করে পুনরায় পাস করা উচিত।
আইনগত পটভূমি
১৯৭২ সালের সংবিধানে গণভোটের বিধান ছিল না। ১৯৭৯ সালে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে জিয়াউর রহমান সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে এ বিধান যুক্ত করেন। পরে ১৯৯১ সালের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এর পরিসর সীমিত করা হয় এবং ২০১১ সালের পঞ্চদশ সংশোধনীতে তা বাতিল করা হয়।
তবে ২০২৪ সালের ১৭ ডিসেম্বর আদালত পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করে গণভোটের বিধান ফিরিয়ে আনেন। যদিও কমিশনের মতে, রায়ের ফলে এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে কার্যকর হয়নি, সংসদে পুনরায় আইন পাস করলেই বিধানটি কার্যকর হবে।
গত ৫ অক্টোবর নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইন ২০০৯ সংশোধন করে জাতীয় সংসদ, রাষ্ট্রপতি স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পাশাপাশি গণভোট আয়োজনের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে অধ্যাদেশ জারি করেন রাষ্ট্রপতি।
এমএইচএইচ/এমআর

