ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন স্বচ্ছ ও অবাধ করার লক্ষ্যে ৭৩টি দেশীয় পর্যবেক্ষক সংস্থাকে ভোট পর্যবেক্ষণের নিবন্ধন দিতে চায় নির্বাচন কমিশন (ইসি)। কিন্তু এদের মধ্যে অনেক সংস্থারই মাঠপর্যায়ে অস্তিত্ব নেই। কোথাও অফিসের ঠিকানায় পাওয়া যাচ্ছে ইলেকট্রনিকস পণ্যের দোকান, কোথাও আবার আবাসিক ভবন। কিছু সংস্থার ঠিকানা নিয়েও তৈরি হয়েছে গোলকধাঁধা।
‘প্রসোশনাল রিসার্স এডভোকেসি ট্রেনিং অ্যাকশন ইয়ার্ড (প্রত্যয়)’ নামে একটি সংস্থা ইসির কাছে নিবন্ধনের আবেদন করেছে। সংস্থার শীর্ষ কর্তা হিসেবে নাম দেওয়া আছে রোকেয়া জাহান। অফিসের ঠিকানা-বাড়ি নং ১০৩০, রোড ১৭/বি, বায়তুল আমান হাউজিং সোসাইটি, আদাবর, ঢাকা। কিন্তু ওই ঠিকানায় গিয়ে দেখা যায়, একই নম্বরের চার-পাঁচটি বাড়ি। কোথাও নেই ‘প্রত্যয়’ নামের কোনো অফিস।
১০৩০ নাম্বারের একটি আবাসিক ভবনের দারোয়ান জানান, এক বছর আগে এখানে ‘পঙ্গু শিশুদের চিকিৎসা সহায়তা’ নিয়ে কাজ করা একটি অফিস ছিল, সেটিও এখন আর নেই। তারা এখানে শুধু বসে অফিসের কাজ করত। চিকিৎসা করত বাইরে।’
পাশে আরও একটি আবাসিক ভবন গড়ে উঠেছে সেটিরও বাড়ি ও রোড নাম্বার একই। এ ভবনের কেয়ারটেকার জানান, এখানে তো কোনো মানুষই থাকে না। আর তো অফিস দূরের কথা।
বিজ্ঞাপন
‘আয়শা জেনারেল স্টোর’ নামে একটি মুদির দোকান আছে। সেটারও বাড়ি ও রোড নাম্বার ১০৩০, ১৭/বি বায়তুল আমান হাউজিং সোসাইটি, আদাবর, ঢাকা।
দোকানটির মালিক আয়শা ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘এখানকার হোল্ডিং নাম্বার ঠিক নাই। একই হোল্ডিং নাম্বারে অনেকগুলো বাড়ি আছে। আর আপনি যে অফিসের কথা বলছেন সেটিও আপনার মুখে প্রথম শুনলাম। এছাড়া রোকেয়া জাহান নামের কাউকে আমরা চিনি না।’
কমিউনিটি অ্যাসিস্ট্যান্স ফর রুরাল ডিভেলাপমেন্ট (কার্ড)। ঠিকানা দেওয়া আছে ৪০/১, জাফরাবাদ, রায়ের বাজার (পশ্চিম ধানমন্ডি)। সেখানে গিয়েও এ নামের কোনো অফিস সম্পর্কে তথ্য জানা যায়নি।
এই ঠিকানায় আছে একটি আবাসিক ভবন আর নিচে রয়েছে এ কে ইলেকট্রিক নামে দোকান। স্থানীয়রা জানান, বিগত কয়েক বছরেও এমন কোনো প্রতিষ্ঠনের নাম তারা শোনেননি।
ভলান্টারি রুরাল ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি ঠিকানা বনশ্রীর ‘ফ’ ব্লকের সাত নাম্বার রোডের ৫৯ নাম্বার বাসা। অথচ সেখানে ‘ফ’ ব্লক বলে কিছুই নেই এমনকি ‘এফ’ ব্লকেও নেই ৫৯ নাম্বারের কোন বাড়ি।
দক্ষিণ বনশ্রীতে ১০/৭ নাম্বার রোড পাওয়া গেলেও পর্যবেক্ষক সংস্থার কোনো অস্তিত্ব মেলেনি। স্থানীয়রা বলছেন, এগুলো ভুয়া ঠিকানা। এ নামের কোনো প্রতিষ্ঠান আমরা দেখিনি।
‘ফ্রি পর্যবেক্ষক নেই’ নির্বাচন বিশ্লেষকের সতর্কবার্তা
নির্বাচন বিশ্লেষক মুনিরা খান বলেন, ‘যাদেরকে পর্যবেক্ষক হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে, তারা জানেন কি না আমার সন্দেহ আছে। এতে প্রকৃত পর্যবেক্ষকদের বিশ্বাসযোগ্যতাও নষ্ট হবে। একইসঙ্গে নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থা কমে যাবে। তারা কীভাবে এসব পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলো নির্ধারণ করল।’
মুনিরা খান আরও বলেন, ‘এখানে অনুদান প্রাপ্তিটা বেশি কাজ করে। যদি কোনো সংস্থা ৫০০ পর্যবেক্ষক দেয় তাহলে তাদের খরচটা কে দেবে? এসব পর্যবেক্ষক দেখে কি মনে হয় তারা টাকা দিয়ে ভোট পর্যবেক্ষণ করাবে? ফ্রি কিন্তু কেউ করবে না। এটা সরকারকে বন্ধ করতে হবে। অনেক মনে করছে আমরা একটি পর্যবেক্ষক সংস্থা করব আর ডোনারদের কাছে থেকে পয়সা নেব।’
তথ্য পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে: ইসি
অস্তিত্বহীন পর্যবেক্ষক সংস্থার বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দীন বলেন, ‘কোনো পর্যবেক্ষক সংস্থাকে আমরা তো সরাসরি রেজিস্ট্রেশন দেইনি। আমরা পত্রিকায় দিয়েছি তথ্য সংগ্রহ করার জন্য। তথ্য এলে আমরা ব্যবস্থা নেব।’
নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, ‘আমরা তো আর পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন দিয়ে দেয়নি। গণবিজ্ঞপ্তি দিয়েছি। আমাদের কাছে তথ্য এলে আমরা সেসব পর্যবেক্ষক সংস্থাকে নিবন্ধন দেব না। আবার অনেক পর্যবেক্ষক সংস্থার যোগ্যতা থাকার পরও তাদের দিতে পারছি না, কারণ তারা বিগত নির্বাচনগুলোতে সঠিক দায়িত্ব পালন করেনি।’
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে গত ২৭ সেপ্টেম্বর ৭৩টি নিবন্ধনযোগ্য সংস্থার তালিকা প্রকাশ করে ইসি। আগামী ২০ অক্টোবর পর্যন্ত সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে দাবি-আপত্তি জানানো যাবে। এরপর শুনানি শেষে নিবন্ধন চূড়ান্ত হবে।
এর আগে ২৭ জুলাই আবেদন আহ্বান করে ইসি গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। আইন অনুযায়ী ১৫ দিনের মধ্যে আবেদন জমা দিতে বলা হয়েছিল, যা শেষ হয় ১০ আগস্ট। সেইসঙ্গে ২০২৩ সালের নীতিমালা বাতিল করে নতুন দেশীয় পর্যবেক্ষক নীতিমালা-২০২৫ জারি করা হয়।
২০০৮ সালে প্রথমবারের মতো ১৩৮টি সংস্থা পর্যবেক্ষক হিসেবে নিবন্ধন পায়। ২০১৮ সালে ছিল ১১৮টি, আর ২০২৩ সালে ৯৬টি সংস্থা।
গত সংসদ নির্বাচনে দেশীয় পর্যবেক্ষক ছিলেন মোট ২০ হাজার ৭৭৩ জন। এদের মধ্যে কেন্দ্রীয়ভাবে অনুমোদিত ৪০টি সংস্থার ৫১৭ জন এবং স্থানীয়ভাবে ৮৪টি সংস্থার ২০ হাজার ২৫৬ জন।
ওই নির্বাচনে বিদেশি পর্যবেক্ষক ছিলেন ১৬৩ জন-এর মধ্যে ওআইসি ও কমনওয়েলথের ৩৮ জন, বিভিন্ন মিশনের ৬৪ জন এবং দূতাবাস–হাইকমিশনে কর্মরত বাংলাদেশি ৬১ জন।
এমএইচএইচ/এমআর

