কুসংস্কার ও ভ্রান্ত ধারণার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের কয়েকটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর গর্ভবতী নারীরা ৬৪টি পুষ্টিকর খাবার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।
বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট) বিএমইউর সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের কনফারেন্স রুমে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্যদের নিয়ে পরিচালিত তিনটি গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়। ৯ আগস্ট বিশ্ব আদিবাসী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সেমিনার ও ফলাফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ডা. মো. শাহিনুল আলম।
বিজ্ঞাপন
এই গবেষণাগুলোর বিষয় ছিল: কমিউনিটি পর্যায়ে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ম্যালেরিয়া প্রতিরোধ, পার্বত্য চট্টগ্রামের অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত প্রবীণদের স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণসংক্রান্ত আচরণ এবং খাগড়াছড়ি জেলায় বসবাসরত গর্ভবতী নারীদের খাদ্যসংক্রান্ত কুসংস্কার বা ‘ফুড ট্যাবু’। গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করেন ডা. রাজন তালুকদার, ডা. অনির্বাণ চাকমা এবং ডা. মো. খালেকুজ্জামান।
গবেষণায় বলা হয়, ত্রিপুরা, চাকমা এবং মারমা সম্প্রদায়ের মধ্যে ৬৪টি খাবার চিহ্নিত করা হয়েছে, যেগুলো গর্ভাবস্থায় খাওয়া নিষিদ্ধ বলে মনে করা হয়। অথচ এই খাবারগুলোর প্রায় সবই মা এবং গর্ভস্থ শিশুর জন্য পুষ্টিকর ও উপকারী। ফলে এসব ভ্রান্ত ধারণা ও কুসংস্কার দূর করে মায়েদের এসব খাবার গ্রহণে উৎসাহিত করা প্রয়োজন, যাতে মা ও নবজাতকের স্বাস্থ্য সুরক্ষিত থাকে।
ম্যালেরিয়া প্রতিরোধ বিষয়ক গবেষণার প্রধান ছিলেন ডা. অনির্বাণ চাকমা। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে রাঙামাটি জেলার কাউখালী, নানিয়ারচর ও রাঙামাটি সদর উপজেলার বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে ২৩৪ জন নারী ও পুরুষের মুখোমুখি সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এতে দেখা যায়, ম্যালেরিয়া সম্পর্কে এই জনগোষ্ঠীর জ্ঞান ও প্রতিরোধমূলক অভ্যাস সীমিত। গবেষণায় সুপারিশ করা হয়, ম্যালেরিয়ার লক্ষণ, আবদ্ধ পানি অপসারণ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং সুরক্ষা ব্যবস্থার গুরুত্ব সম্পর্কে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে সচেতন করতে হবে। একই সঙ্গে সময়মতো চিকিৎসাসেবা নিতে উদ্বুদ্ধ করতে সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ জরুরি।
অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত প্রবীণদের স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণসংক্রান্ত আচরণবিষয়ক গবেষণার প্রধান ছিলেন ডা. রাজন তালুকদার। ফলাফল উপস্থাপনকালে তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপী ৭৫ শতাংশ এবং বাংলাদেশে প্রায় ৭০ শতাংশ মৃত্যুর জন্য দায়ী হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, ক্যান্সারের মতো অসংক্রামক রোগ। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রবীণরা এসব রোগে অন্যদের তুলনায় বেশি ভোগেন, কিন্তু গবেষণা ও নীতিনির্ধারণী আলোচনায় তাঁরা প্রায়ই উপেক্ষিত থাকেন। গবেষণায় জানা যায়, স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণসংক্রান্ত আচরণ মূলত নির্ভর করে আর্থসামাজিক অবস্থা, স্বাস্থ্যসম্পর্কিত বিশ্বাস এবং প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিবন্ধকতার ওপর। বিশেষ করে, স্বাস্থ্যকর্মীরা বাংলায় যোগাযোগ করায় প্রবীণরা ভাষাগত বাধার সম্মুখীন হন এবং সেবাকেন্দ্রে দীর্ঘ সময় অপেক্ষার কারণে সেখানে যেতে আগ্রহ হারান।
বিজ্ঞাপন
গবেষণায় আরও বলা হয়, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষাজ্ঞানসম্পন্ন স্থানীয়দের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে নিয়োগ দেওয়া, পরিবারের সদস্য ও প্রতিবেশীদের সহযোগিতায় প্রবীণদের সেবাকেন্দ্রে পৌঁছাতে উৎসাহিত করা, সেবাপ্রাপ্তির সময়সীমা কমানো এবং ওষুধের দাম হ্রাস করার মতো পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।
গর্ভবতী নারীদের খাদ্যসংক্রান্ত কুসংস্কার (ফুড ট্যাবু) বিষয়ে খাগড়াছড়ি জেলায় পরিচালিত গবেষণা করেন ডা. লাবণ্য ত্রিপুরা। সেমিনারে তাঁর পক্ষে গবেষণা উপস্থাপন করেন ডা. মো. খালেকুজ্জামান। তিনি জানান, গর্ভাবস্থায় নারীর পুষ্টির চাহিদা বেড়ে যায়। কিন্তু কুসংস্কারজনিত কারণে অনেক সহজলভ্য ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়া থেকে তাঁরা বিরত থাকেন, যা মা ও শিশুর জন্য বিশেষ করে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করে। গবেষণায় দেখা যায়, ত্রিপুরা, চাকমা ও মারমা সম্প্রদায়ের নারীরা ফলমূল, শাকসবজি, মাছ, পশুজাত খাবার, পানীয় ও জলখাবারসহ ৬৪টি খাবার গর্ভাবস্থায় নিষিদ্ধ মনে করেন। তাঁদের ধারণা—এই খাবারগুলো গর্ভস্থ শিশুর ক্ষতি করে। মূলত এটি একটি কুসংস্কার, যা মা ও শিশু—উভয়ের জন্য বিপজ্জনক।
গবেষণায় আরও উল্লেখ করা হয়, গর্ভবতীর মা, শাশুড়ি, ননদ, দাদি, নানি এবং কখনো কখনো ধাত্রী বা দাইয়েরা এসব ট্যাবু টিকিয়ে রাখতে মুখ্য ভূমিকা রাখেন। গর্ভপাত, প্রসবজনিত জটিলতা, রক্তস্বল্পতা বা জরায়ুর ঘা ইত্যাদির আশঙ্কাও কিছু নির্দিষ্ট খাবার বর্জনের কারণ হিসেবে কাজ করে। দেখা গেছে, ৪৬.৬ শতাংশ গর্ভবতী নারী কোনো না কোনো খাবার ফুড ট্যাবু হিসেবে এড়িয়ে চলেন।
গবেষণার সুপারিশে বলা হয়, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর গর্ভবতী নারীদের ফুড ট্যাবু দূর করে পুষ্টিকর খাবার গ্রহণে উৎসাহিত করতে হবে। এই লক্ষ্যে তাদের সংস্কৃতিকে সম্মান রেখে সচেতনতামূলক স্বাস্থ্যশিক্ষা কর্মসূচি গ্রহণ করা জরুরি। এছাড়া, দেশের সব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও জাতিসত্তার জনগণকে অন্তর্ভুক্ত করে আরও বিস্তৃত গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনারও প্রয়োজন রয়েছে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ডা. মো. শাহিনুল আলম বলেন, জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানে যে গণআকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে, তার গুরুত্ব অনুধাবন করে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক মানের উচ্চতর মেডিকেল শিক্ষা, আধুনিক চিকিৎসাসেবা এবং গবেষণা কার্যক্রম জোরদার ও বিস্তৃত করেছে। গবেষণার মাধ্যমে বিএমইউ আরও এগিয়ে যাবে এবং নতুন বাংলাদেশ নির্মাণে ভূমিকা রাখবে—এটাই আমাদের অঙ্গীকার।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বিএমইউর কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. নাহরীন আখতার বলেন, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর গর্ভবতী নারীদের যেসব খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকতে বলা হয়, তা অনুচিত। এসব খাবারে জন্মগত ত্রুটি হয় না—এ কথা জোর দিয়ে বলতে হবে। গর্ভাবস্থায় মা ও গর্ভস্থ শিশুর পুষ্টি নিশ্চিত করতে ফুড ট্যাবু দূর করার জন্য ব্যাপকভাবে কাজ করতে হবে।
পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. আতিকুল হকের সভাপতিত্বে এবং সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. খালেকুজ্জামানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে আরও বক্তব্য রাখেন জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. জিয়াউল ইসলাম।
এসএইচ/এআর

