বাংলাদেশ সচিবালয় মেট্রো স্টেশনে মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টায় নামলেন আরিফ ইসলাম (ছদ্মনাম)। নামার পর এমআরটি পাস কার্ড পাঞ্চ করলে ভাড়াসহ অতিরিক্ত ২০০ টাকা কেটে নেওয়া হয়। কিছু বুঝতে না পেরে স্টেশনের দায়িত্বরত কর্মকর্তার কাছে বিষয়টি জানতে চান। তারা বলেন, আগের দিন স্টেশনে কার্ড ঠিকমতো পাঞ্চ করা হয়নি তাই জরিমানা হিসেবে ২০০ টাকা কেটে নেওয়া হয়েছে।
শুধু তিনি একা নয়, প্রতিদিন এমন ভোগান্তিতে পড়েন মেট্রোরেলের অনেক যাত্রী। তাদের দাবি, তারা সঠিকভাবে কার্ড পাঞ্চ করলেও যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে অনেক সময় টাকা কেটে নিতে পারে না, কিন্তু যাত্রী গেট পার হন। পরবর্তীতে দুইশত টাকা জরিমানাও যাত্রীদের দিতে হয়। যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে এমন জরিমানা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন অনেকে।
বিজ্ঞাপন
যানজটের শহরের একমাত্র আরামদায়ক গণপরিবহনের এমন ত্রুটির ব্যাপারে অনেকে অভিযোগ রয়েছে। শুধু পাঞ্চিং সমস্যা নয়, দীর্ঘমেয়াদী টিকিট সংকট, টিকিট ভেন্ডিং মেশিন অকার্যকর থাকা এবং পাঞ্চিং মেশিনের ধীরগতির কারণে অনেকের ভোগান্তি পোহাতে হয়। তবে দ্রুতই নতুন ইউনিভার্সেল টিকিটিং সিস্টেম (ইউটিএস) আসছে। এছাড়া একক যাত্রার কার্ডের জন্যও লাইনে দীর্ঘ সময় দাঁড়াতে হবে না। এতে কার্ড ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ভাড়া পরিশোধ করতে পারবেন যাত্রীরা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে এমআরটি বা র্যাপিড পাসে যাতায়াত করলে ১০ শতাংশ ছাড় পাওয়া যায়। মেট্রোরেলের ৫৫ শতাংশ যাত্রী র্যাপিড বা এমআরটি কার্ডে যাতায়াত করেন। বাকি ৪৫ শতাংশ ব্যবহার করেন একক যাত্রার কার্ড। দীর্ঘদিন ধরেই এমআরটি ও র্যাপিড কার্ডের সংকট চলছে। এছাড়া বর্তমান ব্যবস্থায় স্থায়ী কার্ডে টাকা শেষ হয়ে গেলে গ্রাহককে সাধারণত স্টেশনে গিয়ে রিচার্জ করতে হয়। সে ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময় লাইনে দাঁড়াতে হয়। নতুন ব্যবস্থায় ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ডে টাকা থাকলে অনায়াসে যাতায়াত করা যাবে।
মেট্রোর টিকিট যেভাবে হবে আরও সহজ
বিজ্ঞাপন
মেট্রোরেলের যাত্রীদের ভাড়া পরিশোধ আরও সহজ ও বিস্তৃত করার উদ্যোগ নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। নতুন ব্যবস্থায় ব্যাংকের ডেবিট-ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার (পাঞ্চ) ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ভাড়া দেওয়া যাবে। নতুন এ ব্যবস্থার নাম ইউনিভার্সেল টিকিটিং সিস্টেম (ইউটিএস)।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এটি চালু করতে অন্তত ছয় মাস লাগবে। অবশ্য বর্তমানে চালু থাকা র্যাপিড ও এমআরটি পাস এবং একক যাত্রার কার্ডও কার্যকর থাকবে। নতুন ব্যবস্থায় ভাড়া আদায়ের জন্য মেট্রোরেল স্টেশনগুলোয় নতুন কিছু যন্ত্র বসানো হবে। সেগুলোতে ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড পাঞ্চ করে ভাড়া দেওয়া যাবে।

স্বয়ংক্রিয় পাঞ্চিং মেশিনের দুর্বলতা
বর্তমানে মেট্রোর টিকিটের মাধ্যমে সবাই স্বয়ংক্রিয় পাঞ্চিং মেশিন দিয়ে স্টেশনে প্রবেশ করেন। কিন্তু ট্রেন থেকে নামার পর বের হওয়ার সময় স্বয়ংক্রিয় গেটে ভিড় লেগেই থাকে। অনেক সময় যাত্রীদের জন্য স্বয়ংক্রিয় গেট খুললেও টাকা কেটে নিতে পারে না মেশিন। এর ফলে জরিমানা গুণতে হয় যাত্রীর। এছাড়া গেটে দ্রুত টিকিট পাঞ্চ ও বিভিন্ন ত্রুটির কারণে হুট করেই অকার্যকর হয়ে পড়ে। এতে যাত্রীদের স্টেশন থেকে বের হওয়ার ক্ষেত্রে অনেক সময় ভোগান্তিতে পড়তে হয়।
রনি ইসলাম নামের একজন মেট্রো যাত্রী বলেন, গতকাল আমি সঠিক ভাবে টিকিট পাঞ্চ করি কিন্তু মেশিন টাকা কাটতে পারেনি। পরে অন্য গেটে আবার পাঞ্চ করে বের হয়েছি। কিন্তু আগের গেট দিয়ে বের হলে পরের দিন আমার জরিমানা গুণতে হতো। তাই টিকিট পাঞ্চ মেশিন আরও অত্যাধুনিক হওয়া জরুরি।
রানা ইসলাম নামের একজন যাত্রী বলেন, নিয়মিত আমি এমআরটি পাস ব্যবহার করে মেট্রোতে চলাচল করি। কিন্তু মাঝে মাঝে স্বয়ংক্রিয় গেট অকার্যকর হয়ে যায়। অনেক সময় যাত্রীদের দ্রুত বের হওয়ার তাড়ায় টিকিট পাঞ্চ করতে একটু ত্রুটি হলে এটি বেশি হয়। কিন্তু ট্রেন থেকে নামার পর গেটে প্রচুর চাপ থাকে ফলে এমন ত্রুটি দেখা দিলে সবারই ভোগান্তিতে পড়তে হয়।

ভেন্ডিং মেশিনের সমস্যা
ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) উত্তরা থেকে মতিঝিল রুটের ১৬টি মেট্রো স্টেশনে প্রায় প্রতিটি স্টেশনেই বিভিন্ন সময় একাধিক ভেন্ডিং মেশিনে ত্রুটি দেখা যায়। এতে যাত্রীদের চাপে টিকিট কাটার লাইন যেমন দীর্ঘ হয়; তেমনি ভোগান্তিও পোহায় তারা।
আল আমিন নামের একজন যাত্রী বলেন, মেট্রোরেলের অন্যতম ব্যস্ত স্টেশন হলো কারওয়ান বাজার। কিন্তু এখানকার মোট ৬টি ভেন্ডিং মেশিনের মধ্যে বেশিরভাগ সময় ১-২টি মেশিন কাজ করে না। ফলে অন্য মেশিনের ওপর চাপ পড়ে এবং টিকিট কাটার লাইন দীর্ঘ হয়।
উত্তরা থেকে নিয়মিত মতিঝিলে অফিস করেন আলতাফ হোসেন। তিনি বলেন, মিরপুর-১০ স্টেশনের যাত্রীর চাপ সব সময়ই থাকে। তবে এখানে টিকিট কাটার সময় দেখা যায় ভেন্ডিং মেশিন কোনো একটা অকার্যকর হয়ে আছে। আবার অনেক সময় টাকার নোট নিয়ে আর টিকিট বের হচ্ছে না।

এমআরটি ও র্যাপিড কার্ডের সংকট
চলতি বছরের শুরু থেকে বিক্রি করার মতো র্যাপিড ও এমআরটি কার্ডের সংকট দেখা গেছে। বিভিন্ন সময় এসব কার্ড বিক্রির ঘোষণা দিলেও খুব অল্প সময়ে সেসব শেষ হতে দেখা যায়। এতে টিকিট করতে যাওয়া যাত্রীরা খালি হাতে ফিরে যান।
দৈনিক এক থেকে দেড় হাজার স্থায়ী কার্ডের চাহিদা রয়েছে বলে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে। এমআরটি বা র্যাপিড পাসে যাতায়াত করলে টিকিটের মূল্যে ১০ শতাংশ ছাড় পাওয়া যায়। এ জন্য স্থায়ী কার্ডের চাহিদা বেশি। এছাড়া স্থায়ী কার্ডে ভ্রমণে ঝক্কিও কম।
ডিটিসিএ সূত্র জানায়, গত জানুয়ারি মাসে প্রাইম পাওয়ার সলিউশন নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে আড়াই লাখ র্যাপিড পাস সরবরাহের দায়িত্ব দেয় ডিটিসিএ। তারা ইন্দোনেশিয়া থেকে কার্ড আমদানি করে ডিটিসিএকে দেয়। আগামী মাসের মধ্যে তাদের সব কার্ড সরবরাহের কথা। তবে এখন পর্যন্ত মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ ১ লাখ ১৮ হাজার র্যাপিড পাস পেয়েছে। তাও কয়েক কিস্তিতে অল্প অল্প করে কার্ড দেওয়া হয়েছে। ফলে তিন-চার মাস ধরে চাহিদামতো র্যাপিড পাস পাচ্ছেন না যাত্রীরা।
ইউসুফ আলী নামের একজন যাত্রী বলেন, গত এক মাস ধরে মিরপুরের বিভিন্ন স্টেশনে ঘুরেছি একটা স্থায়ী কার্ডের জন্য কিন্তু সেটি কিনতে পারিনি। এতে একক টিকেট কাটার জন্য আমাকে বড় একটা সময় ব্যয় করতে হয়।
এ বিষয়ে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) পরিচালক এ কে এম খায়রুল আলম বলেন, ভেন্ডিং মেশিন হলো যান্ত্রিক একটি ব্যাপার। নানা কারণে বিভিন্ন সময় ত্রুটি দেখা দিতে পারে। তবে সেটি দ্রুত সমাধানের জন্য আমাদের লোকবল আছে এবং তারা নিয়মিত কাজ করে। এছাড়া মেট্রোরেলের টিকিট সহজ করতেও আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
এএসএল/এমএইচটি

