• ‘রাতের ভোটের কারিগর’ তকমা পান সিইসি নূরুল হুদা
• ভোট বিতর্ক মুছে ফেলার সুযোগ কাজে লাগাতে হয়েছেন ব্যর্থ
বিজ্ঞাপন
• রাতের ভোটের অভিযোগ পেয়েও আমলে নেয়নি নূরুল হুদা কমিশন
• গ্রেফতারের আগে পরানো হয় জুতার মালা, ডিম নিক্ষেপ
• অন্য কমিশনারদের মধ্যেও দেখা দিয়েছে আতঙ্ক
আওয়ামী লীগের অধীনে গত তিনটি সংসদ নির্বাচনের দুটোতে অংশ নেয়নি বিএনপিসহ বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল। তবে সুষ্ঠু নির্বাচনের আশ্বাসে ২০১৮ সালের নির্বাচনে ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে বিএনপিসহ আরও কিছু দল ভোটে গিয়েছিল। ওই সময় নির্বাচন কমিশনের নেতৃত্বে ছিলেন সদ্য গ্রেফতার হওয়া এ কে এম নূরুল হুদা। যিনি পরিচিত হয়েছেন ‘রাতের ভোটের কারিগর’ হিসেবে। কারণ ওই নির্বাচনে বেশিরভাগ আসনে রাতের বেলা ভোট হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। যা নিয়ে অভিযোগ আমলে নেয়নি হুদা কমিশন।
বিজ্ঞাপন
অন্যদিকে ২০১৪ সালের নির্বাচনের সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দীনের সময়ে বিএনপিসহ বেশিরভাগ দল ছাড়া নির্বাচন করে তিনি পেয়েছিলেন ‘একতরফা নির্বাচনের’ অন্যতম কারিগরের তকমা। সবশেষ ২০২৪ সালেও বিএনপিসহ বেশিরভাগ নিবন্ধিত দল ছাড়া ‘আমি-ডামি’ ভোটের কারিগর কাজী হাবিবুল আউয়ালকে হজম করতে হয়েছে তীব্র সমালোচনা। তবে বেশিরভাগ দল অংশ নেওয়ায় নূরুল হুদা কমিশনের সামনে ভালো নির্বাচনের দৃষ্টান্ত তৈরির সুযোগ থাকলেও তিনি পূরণে ব্যর্থ হয়েছেন। যে কারণে তার প্রতি রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের বেশি ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে।
রোববার (২২ জুন) রাতে তাকে উত্তরার বাসা থেকে স্থানীয় বিএনপি ও স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতাকর্মীরা মিলে হেনস্তা করে পুলিশের হাতে তুলে দেয়ার সময় ক্ষোভ প্রকাশের দৃশ্য ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
অবশ্য বিগত তিনটি নির্বাচন কমিশনের মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। স্রোতের বিপরীতে নির্বাচনি অনিয়মের বিরুদ্ধে সরব থেকে প্রশংসা কুড়ানো এই কমিশনার ২০২২ সালের আগস্টে মারা গেছেন।
এদিকে সাবেক এই সিইসিকে গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের অধীনে তিনটি ‘বিতর্কিত’ সংসদ নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশনে যারা দায়িত্বে ছিলেন তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হয়েছে। কারণ এতদিন চুপচাপ থাকলেও ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পতনের পর এই প্রথম বিতর্কিত নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত একজন প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে (সিইসি) গ্রেফতার করা হলো। রোববার রাতে ২০১৮ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচনের সময়ের সিইসি এ কে এম নূরুল হুদাকে বাসা থেকে এক দল ধরে শারীরিকভাবে হেনস্তা করে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে। এসময় তাকে জুতার মালাও গলায় দেওয়া হয়। একজনকে জুতা দিয়ে পেটাতেও দেখা গেছে। গায়ে ছুড়ে মারা হয়েছে ডিম।
এরআগে রোববার সকালে প্রহসনের নির্বাচন করার অভিযোগে সাবেক তিন প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ (সিইসি) ২৪ জনের নাম উল্লেখ করে মামলার আবেদন করে বিএনপি। সাবেক এই তিন সিইসি হলেন ২০১৪ সালের নির্বাচনের তৎকালীন সিইসি কাজী রকিব উদ্দিন আহমেদ, ২০১৮ সালের নির্বাচনে তৎকালীন সিইসি এ কে এম নুরুল হুদা ও ২০২৪ সালের নির্বাচনের তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় এই মামলার আবেদন জমা দেন বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য মো. সালাহ উদ্দিন খানের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধিদল।
সদ্য গ্রেফতার সাবেক সিইসিকে বিএনপির দায়ের করা মামলায় গ্রেফতার দেখানোর কথা জানিয়েছে পুলিশ।

অন্যদিকে আওয়ামী লীগ আমলে হওয়া ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের দশম, একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে সিইসি, ইসি ও সচিবদের ভূমিকা তদন্তে কমিটি গঠনে অন্তবর্তীকালীন সরকারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। গত ১৬ জুন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের এক বৈঠকে আলোচনা শেষে সরকারপ্রধানের দপ্তরের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে হওয়া বিতর্কিত তিন জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনে জড়িত সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার, নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সচিবদের ভূমিকা তদন্তে অবিলম্বে একটি কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
জানা গেছে, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর থেকে গত তিন নির্বাচনে কমিশনের দায়িত্বে থাকা সিইসিসহ কমিশনাররা অনেকটা নিঃসঙ্গ দিন কাটাচ্ছেন। পরিবারের সদস্যদের সময় দিচ্ছেন। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। অনেকটা আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটিয়েছেন। এদের মধ্যে সাবেক নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম বিদেশে।
অবশ্য এরআগে তিন নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হলেও এতদিন কেউ গ্রেফতার হয়নি। মাঠ পর্যায়ে থেকে বিতর্কিত নির্বাচনে সহযোগিতা করা কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও জানা যায়নি। তবে নূরুল হুদার গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে তিন আমলের নির্বাচন কমিশনে থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে নতুন করে আতঙ্ক দেখা দিবে এমনটাই ধারণা করা হচ্ছে।
গ্রেফতার হওয়া সাবেক সচিব নূরুল হুদা ২০১৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সিইসি হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন দেশের দ্বাদশ সিইসি। তার নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের কমিশনের অধীনে ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনসহ স্থানীয় পর্যায়ের সব ভোট হয়। এ ইসির মেয়াদ শেষ হয় ২০২২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি।

কোথায় আছেন অন্য সিইসি ও কমিশনাররা
জানা গেছে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ‘একতরফা বিনা ভোটের’ নির্বাচন আয়োজনের অন্যতম কারিগর কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ বারিধারায় তার নিজ বাসভবনে রয়েছেন। স্ট্রোক করায় তিনি গুরুতর অসুস্থ। ভোট ছাড়াই ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগীদের বিজয়ী ঘোষণা করে বিতর্কিত নির্বাচনের নজির গড়ে কাজী রকিবউদ্দীন কমিশন।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ বেশির ভাগ দল অংশ নেয়নি। আওয়ামী লীগ, তাদের সহযোগীসহ মাত্র ১২টি দল অংশ নিয়ে সরকার গঠন করে।
আর গ্রেফতার হওয়া নূরুল হুদা উত্তরায় নিজ বাসায় ছিলেন। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সময় দিয়ে আর বই লিখে সময় কাটাতেন।
হুদা কমিশনের সময়ে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ওই নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলেও ভোটের আগের রাতেই আওয়ামী লীগের পক্ষে ব্যালটে সিল মারা হয়। ফলাফলও হয় একতরফা। নির্বাচনে ২৯৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট পায় ২৮৮টি আসন। অপরদিকে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট পায় মাত্র আটটি আসন। তখনকার কেএম নূরুল হুদা কমিশন বিষয়টি জানার পরও ব্যবস্থান নেয়নি।

অভিযোগ আছে, একাদশ সংসদ নির্বাচনের সময়
উপজেলা চেয়ারম্যানদের পদত্যাগপত্র গৃহীত হয়নি- এমন হাস্যকর অভিযোগে বিএনপি জোটের ২৪ প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল করে হুদা কমিশন। এর ফলে ৩০০ আসনের ১৭টিতে ধানের শীষের প্রার্থী ছিল না শেষ পর্যন্ত। বাকি ২৮৩ প্রার্থীর অন্তত ২২ জন নির্বাচনী প্রচারের সময় গ্রেপ্তার হন। কয়েকজন আগে থেকেই কারাগারে ছিলেন।
অন্তত ২৩ জন প্রার্থী ভোটের প্রচারে গুলি, কোপ, মারধরের শিকার হন। হাতেগোনা কয়েকজন বাদে বাকি প্রার্থীরা ভোটের প্রচারেই নামতে পারেননি। পুলিশ বাড়িতে অবরোধ করে রাখে।
এ সংক্রান্ত শত শত অভিযোগের পরও হুদা কমিশন ছিল নির্বিকার। ২৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যা থেকে খবর আসতে শুরু করে, ভোট শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেয়নি কমিশন। ৩০ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ফলাফলে দেখা যায় আওয়ামী লীগ জোট ২৮৮ আসন জিতেছে। আর বিএনপি জোট ৭ আসন জিতেছে।
অবশ্য ভোট শেষে প্রতিক্রিয়ায় সিইসি হুদা বলেছিলেন, নির্বাচন অবাধ সুষ্ঠু হয়েছে।
অন্যদিকে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ‘আমি-ডামি’ ভোটের কারিগর কাজী হাবিবুল আউয়াল রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় নিভৃতে দিন কাটাচ্ছেন। তিনি বাসা থেকে খুব একটা বের হন না। তাদের সন্তানরা অবস্থান করছেন বিদেশে।
সূত্র জানিয়েছে, ৫ আগস্টের পর সাবেক সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল তার সরকারি পাসপোর্ট ফেরত দিয়েছেন। সাবেক নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম দায়িত্বে থাকাবস্থায় প্রশিক্ষণে বক্তৃতা দিয়ে নেওয়া আড়াই লাখের বেশি টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিয়েছেন। তার ওই টাকার ওপর অডিট আপত্তি ছিল।

তবে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. আহসান হাবিব খান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় রয়েছেন। থাকছেন উত্তরায় বাসায়। দায়িত্ব ছাড়ার আগ মুহূর্তে তার লাল পাসপোর্টে সার্ক স্টিকার লাগালেও দেশের বাইরে যাননি এ সাবেক নির্বাচন কমিশনার।
জানা গেছে, সাবেক নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ মোবারক ঢাকার বাসা ছেড়ে চট্টগ্রামে রয়েছেন। ক্যানসার আক্রান্ত এ সাবেক নির্বাচন কমিশনার গুরুতর অসুস্থ।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. জাবেদ আলী মিরপুর ডিওএইচএসে তার নিজ বাড়িতে থাকেন। সেনাবাহিনীতে চাকরির সুবাদে তিনি সেখানে প্লট পেয়েছেন। আর সাবেক নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ আজিমপুর সরকারি কোয়ার্টারেই রয়েছেন। তিনি ভালো ও সুস্থ আছেন বলে জানা গেছে।
আরেক নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম রাজধানীর কলাবাগান লেকসার্কাসে নিজ বাসায় নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করছেন। তার স্ত্রী মারা গেছেন। এক সন্তান বিদেশে। আরেক সন্তান শ্বশুরবাড়িতে। আরেক কমিশনার কবিতা খানম ৫ আগস্টের আগেই আমেরিকা চলে যান। তিনি আর দেশে ফিরে আসেননি। আরেক কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারের শাহাদাত হোসেন চৌধুরী মিরপুর ডিওএইচএসের বাসায় থাকেন।
বিইউ/এএস

