বুধবার, ২৫ জুন, ২০২৫, ঢাকা

ইশরাকের মেয়র পদ নিয়ে আইনি লড়াই শেষে বল এখন ইসির কোর্টে

মো. মেহেদী হাসান হাসিব
প্রকাশিত: ০২ জুন ২০২৫, ১১:২২ এএম

শেয়ার করুন:

ইশরাকের মেয়র পদ নিয়ে আইনি লড়াই শেষে বল এখন ইসির কোর্টে

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) নির্বাচনে ট্রাইব্যুনালের রায়ে বিএনপির নেতা ইশরাক হোসেনকে মেয়র ঘোষণার পর থেকেই তার শপথ গ্রহণকে কেন্দ্র করে নানা জটিলতা তৈরি হয়েছে। রায় ঘোষণা, নির্বাচন কমিশনের (ইসি) গেজেট প্রকাশ, ইশরাককে শপথ নেওয়া থেকে বিরত থাকতে আইনি নোটিশ, আন্দোলন এবং হাইকোর্টে রিটসহ বিভিন্ন ঘটনার জন্ম দিয়েছে এ বিষয়টি। সর্বশেষ, মেয়র ঘোষণার গেজেট স্থগিত চেয়ে করা লিভ টু আপিল পর্যবেক্ষণসহ নিষ্পত্তি করে দিয়েছেন আপিল বিভাগ। একই সঙ্গে আপিল বিভাগ ইসিকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বলেছেন। ফলে ইশরাকের শপথ গ্রহণ হবে কি না, তা এখন সম্পূর্ণভাবে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে।

গত বৃহস্পতিবার (২৯ মে, ২০২৫) আপিল বিভাগ ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ঘোষণার গেজেট স্থগিত চেয়ে করা লিভ টু আপিল পর্যবেক্ষণসহ নিষ্পত্তি করে দেন। সাপ্তাহিক ছুটি শেষে গত রোববার (১ জুন) সন্ধ্যায় ইসির হাতে রায়ের কপি আসে। এরপর ইসির সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ বলেন, ইশরাক হোসেনের বিষয়ে আদালতের আদেশের কপি আমরা হাতে পেয়েছি। এখন কমিশনের কাছে উপস্থাপন করব। এরপর কমিশন এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।


বিজ্ঞাপন


সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগ ও আইনি বিতর্ক

বিএনপির কেন্দ্রীয় আইন বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল অভিযোগ করেছেন যে, ইশরাক হোসেনকে শপথ গ্রহণ করতে না দিয়ে সংবিধান ভঙ্গ করা হয়েছে। তিনি বলেন, স্থানীয় সরকারের দায়িত্বরত সচিব বা যে উপদেষ্টারা আছেন, তারা সংবিধান ভঙ্গ করেছেন। আর্টিকেল ১১৮ এর অনুচ্ছেদ ৪ এ সুস্পষ্টভাবে বলা আছে যে, নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেবে এবং নির্বাচন কমিশন ২৭ এপ্রিল গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর্টিকেল ১২৬ এ বলা হয়েছে, নির্বাহীরা নির্বাচন কমিশনকে সকল কাজে সহযোগিতা করবে। এক্ষেত্রে আমরা দেখলাম এখানে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কাজ করছে। আর এ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কাজ করছে বিধায় শপথ গ্রহণ করতে দেওয়া হয়নি।

তিনি আরও বলেন, ইশরাক হোসেনের শপথ গ্রহণকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য নির্বাহীর পক্ষ থেকে কাউকে প্ররোচিত করা হয়েছে এবং যথারীতি হাইকোর্ট ডিভিশনে একটি রিট পিটিশন দায়ের করা হয়েছে। এ রিট পিটিশন নিষ্পত্তি হওয়ার পর আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম যে, সংবিধান অনুযায়ী স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান আয়োজন করবে। এরপর সর্বোচ্চ আদালত আপিল বিভাগ থেকে নির্বাচন কমিশনকে সিদ্ধান্ত নিতে বলা হয়েছে।

কায়সার কামাল মনে করেন, গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গত ২৭ এপ্রিলই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। এখন নতুন করে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার কিছু নেই। বরং নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য এ স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় কাজ করছে।


বিজ্ঞাপন


শূন্য মেয়াদে দায়িত্ব নেবেন কি ইশরাক?

তাপস মেয়র হওয়ার পর প্রথম সভা করেন ২০২০ সালের ২ জুন। আইন অনুযায়ী, তখন থেকে পাঁচ বছর হিসেবে করলে তার মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার কথা ছিল ২০২৫ সালের ১ জুন। ইসি কর্মকর্তারা তাপসের সময় থেকেই মেয়াদ হিসাব করার পক্ষে মত দিচ্ছেন। তাদের যুক্তি, ইশরাকের নামে নতুন করে গেজেট হয়নি, আগের গেজেটেই কেবল তার নাম প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এখন আপিল বিভাগ ইশরাক হোসেনের শপথের বিষয়টি নির্বাচন কমিশনের ওপর ছেড়ে দিয়েছে। যদি ইসি এ সময় শপথ পড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়ও, তাহলে প্রশ্ন উঠেছে: ইশরাক হোসেন কি মেয়াদহীন মেয়রের শপথ নেবেন?

আন্দোলনের মুখে ডিএসসিসি’র কার্যক্রম বন্ধ

বিএনপি নেতা ইশরাককে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ঘোষণার দাবিতে টানা আন্দোলন চলছে। এ আন্দোলনের ফলে গত ১৮ দিন ধরে ডিএসসিসির কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এতে নগরবাসী সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করে ইশরাক হোসেন বলেছেন, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।

দুই উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি

মেয়রের দায়িত্ব প্রদানে টালবাহানার অভিযোগ এনে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া এবং তথ্য উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করেছেন ইশরাক। এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া তখন বলেছিলেন, এখানে আইনি জটিলতা আছে এবং আদালতে বিচারাধীন বিষয় আছে। যে জটিলতাগুলো রয়েছে, সে বিষয়ে আমরা আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত চেয়েছি। আইন মন্ত্রণালয় যেহেতু এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ, আইন মন্ত্রণালয়ের মতামতের ভিত্তিতে আমরা সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারব।

নির্বাচনের ফলাফল ও ট্রাইব্যুনালের রায়

পাঁচ বছর আগে অনুষ্ঠিত ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে তাপস পেয়েছিলেন প্রায় ৪.২৫ লাখ ভোট, আর তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির প্রার্থী ইশরাক পেয়েছিলেন ২.৩৬ লাখ ভোট। নির্বাচনে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ফলাফল বাতিলের দাবিতে ২০২০ সালের ৩ মার্চ মামলা করেন ইশরাক। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ফলে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সিটি করপোরেশনের মেয়রদের অপসারণ করা হয়। এরপর ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন অতিরিক্ত সচিব শাহজাহান মিয়া।

পরে গত ২৭ মার্চ, ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ ও নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. নুরুল ইসলাম ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২০২০ সালের নির্বাচনে ফজলে নূর তাপসকে বিজয়ী ঘোষণার ফল বাতিল করে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে মেয়র ঘোষণা করেন।

4

ইসির গেজেট প্রকাশ ও আইনি নোটিশ

আদালত ১০ দিনের মধ্যে গেজেট প্রকাশের নির্দেশ দিলে, রায়ের কপি হাতে পাওয়ার পর নির্বাচন কমিশন আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত চেয়েছিল। নির্ধারিত সময়ে মতামত না পাওয়ায়, আদালতকে প্রতিপালন করতে গত ২৭ এপ্রিল আগের গেজেটে তাপসের স্থলে ইশরাকের নাম প্রতিস্থাপন করে সংশোধিত গেজেট প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন।

তবে গেজেট প্রকাশের দিনই রফিকুল ইসলাম ও মামুনুর রশিদ নামে দুই ব্যক্তি ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ঘোষণা করে দেওয়া রায় ও ডিক্রির বিরুদ্ধে আপিল করতে আইনি নোটিশ দেন। নোটিশে গেজেট প্রকাশ এবং ইশরাককে শপথ নেওয়া থেকে বিরত থাকতে বলা হয়।

ওই সময় তাদের আইনজীবী বলেছিলেন, যথাযথ প্রক্রিয়া না মেনে দ্রুত রায়টি দেওয়া হয়েছে। আমরা মনে করেছিলাম, ইসি এই আদেশকে চ্যালেঞ্জ করবে। চ্যালেঞ্জ করল না। আবার খবরে দেখলাম, আইন উপদেষ্টা বলছিলেন, আইন মন্ত্রণালয়ের যে মতামত চাওয়া হয়েছিল, সেজন্য অপেক্ষা না করে এই নোটিফিকেশন জারি করে দেওয়া হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল এমন কোনো আদেশ দিতে পারেন না যে আদেশের কোনো কার্যকারিতা নেই। এখানে টার্ম শেষ হয়ে গেছে। অধ্যাদেশের মাধ্যমে মেয়র পদশূন্য করে দেওয়া হয়েছে।

পরে মামুনুর রশিদ হাইকোর্টে রিট করেন। রিটে ২৭ মার্চের রায় এবং ২৭ এপ্রিলের গেজেট কেন বেআইনি হবে না এবং ইশরাক হোসেনের শপথ পরিচালনা থেকে বিরত রাখার নির্দেশনা কেন দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারির আবেদন জানানো হয়। এ রুল বিচারাধীন থাকা অবস্থায় রায় ও গেজেটের কার্যক্রম স্থগিত চাওয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে আপিল বিভাগ পর্যন্ত মামলা গড়ালে সর্বোচ্চ আদালত ইসির ওপর সিদ্ধান্ত ছেড়ে দেন।

এমএইচএইচ/এএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর