রোববার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

চার্জশিটে মূল আসামিদের নাম নেই, নির্দোষ ব্যক্তিরা অভিযুক্ত!

মোস্তফা ইমরুল কায়েস
প্রকাশিত: ২৯ মে ২০২৫, ১২:৫০ পিএম

শেয়ার করুন:

চার্জশিটে মূল আসামিদের নাম নেই, নির্দোষ ব্যক্তিরা অভিযুক্ত!
হেলাল শেখ ও ভুক্তভোগী তৈয়বুর রহমান

# স্কুলে পাঠদান অবস্থায় থাকলেও চার্জশিটে প্রধান আসামি
# মারামারি থামানো ও উপজেলা কৃষি অফিসে সার নিতে যাওয়া ব্যক্তি হলেন ৫ ও ১৭ নম্বর আসামি
# টাকার বিনিময়ে নাম বাদ দেওয়ার অভিযোগ
# বাদীকে জিম্মি করে নারাজি থেকে বিরত রাখার অভিযোগ

নড়াইলের লোহাগাড়া উপজেলার পাঁচড়িয়া গ্রামে মাছ ধরাকে কেন্দ্র করে গত বছরের ২৫ নভেম্বর সংঘটিত এক মারামারির ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার চার্জশিটে গুরুতর অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগকারী জাকির হোসেন, যিনি আহত তৈয়বুর রহমানের ভাই, সম্প্রতি পুলিশ সদর দপ্তরে এসআই ও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামানের বিরুদ্ধে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে মূল আসামিদের নাম বাদ দিয়ে নির্দোষ ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করার অভিযোগ করেছেন।


বিজ্ঞাপন


মূল অভিযোগ:

ভুক্তভোগী তৈয়বুর রহমানকে কুপিয়ে গুরুতর আহতকারী হেলাল শেখ ও কামাল শেখ-সহ হুকুমদাতা শান্তি শেখ এবং আরও চারজন—মোট সাতজন মূল আসামির নাম চার্জশিটে নেই।

মারামারি থামাতে গিয়ে আহত আহকাম শরীফ (৫০) হয়েছেন মামলার ৫ নম্বর আসামি। এছাড়া, উপজেলা কৃষি অফিসে সার আনতে যাওয়া নাজির শেখ (৫০) এবং স্কুলে পাঠদানে ব্যস্ত থাকা শিক্ষক মিজানুর শরীফ (৩০) কে যথাক্রমে ১৭ ও ১ নম্বর আসামি করা হয়েছে।

অভিযোগকারী জাকির হোসেনের দাবি, মূল আসামিদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ গ্রহণ করে তদন্তকারী কর্মকর্তা তাদের নাম চার্জশিট থেকে বাদ দিয়েছেন। একটি অডিও রেকর্ডেও আসামি হেলাল শেখের পক্ষ থেকে ঘুষ লেনদেনের স্বীকারোক্তি পাওয়া গেছে।


বিজ্ঞাপন


অভিযোগ উঠেছে যে, তদন্তকারী কর্মকর্তা মামলার বাদীর সঙ্গে কোনো পরামর্শ ছাড়াই চার্জশিট দাখিল করেছেন। এমনকি বাদী যখন আদালতে নারাজি দিতে যান, তখন তদন্তকারী কর্মকর্তা তাকে জিম্মি করে মূল আসামি শান্ত শেখের হাতে তুলে দেন, যিনি বাদীকে নারাজি দেওয়া থেকে বিরত রাখেন।

ঘটনার বিস্তারিত:

গত বছরের ২৫ নভেম্বর লোহাগাড়ার পাঁচড়িয়া গ্রামে মাছ ধরা নিয়ে মারামারি শুরু হয়। অভিযোগকারী জাকির হোসেনের ভাই তৈয়বুর রহমানকে শান্তি শেখের হুকুমে হেলাল শেখ ও কামাল শেখ কুপিয়ে মারাত্মকভাবে জখম করেন। এতে তৈয়বুরের ডান পা কোমরের নিচ থেকে কেটে ফেলতে হয়। জাকিরের অন্য ভাই বাবর আলীও গুরুতর আহত হন। এই ঘটনায় মামলা দায়েরের চার মাস পর, এসআই আসাদুজ্জামান আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন।

চার্জশিটে অসঙ্গতি ও বাদীর ক্ষোভ:

আদালতে দাখিলকৃত চার্জশিট পর্যালোচনা করে দেখা যায়, হেলাল শেখ ও রাকিব শেখ-সহ সাতজন মূল আসামির নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। অথচ তদন্তকারী কর্মকর্তা চার্জশিটে উল্লেখ করেছেন যে, এই আসামিরা স্বেচ্ছায় আদালতে আত্মসমর্পণ করেছেন, যা সম্পূর্ণ মিথ্যা। অভিযোগকারী জাকির হোসেনের দাবি, হেলাল শেখ (২ নম্বর আসামি) এবং রাকিব শেখ (৩৩ নম্বর আসামি) কখনোই আদালতে হাজিরা দেননি বা জামিন নেননি।

জাকির হোসেন আরও অভিযোগ করেছেন যে, তদন্তকারী কর্মকর্তা আসামিদের সঙ্গে যোগসাজশ করে গত ৩০ মার্চ অত্যন্ত গোপনে চার্জশিট দাখিল করেন, যা তারা প্রায় দুই সপ্তাহ পর জানতে পারেন। চার্জশিটে নির্দোষ ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করা এবং মিথ্যা তথ্য প্রদানের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তদন্তকারী কর্মকর্তা রুঢ়ভাবে জানান যে, তিনি যা ভালো মনে করেছেন, তাই করেছেন এবং এ বিষয়ে কারো কাছে জবাবদিহি করবেন না।

21
তৈয়বুরের ডান পা কোমরের নিচ থেকে কেটে ফেলতে হয়

ঘুষ লেনদেনের প্রমাণ এবং আসামিদের স্বীকারোক্তি:

অনুসন্ধানে জানা গেছে, মামলার ১ থেকে ৩ নম্বর এবং ৩৩ নম্বর আসামিসহ মোট সাতজনকে চার্জশিট থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে শান্ত শেখ (হুকুমের আসামি), হেলাল শেখ (কোপানো আসামি), কামাল শেখ (কোপানো আসামি) এবং রাকিব শেখ (কোপানো আসামি) একই পরিবারের সদস্য। অভিযোগ উঠেছে, আমেরিকায় যাওয়ার প্রস্তুতি থাকায় এই আসামিরা পুলিশ ভেরিফিকেশনের সুবিধার্থে তদন্তকারী কর্মকর্তাকে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়েছেন।

ঢাকা মেইলের হাতে আসা একটি অডিও রেকর্ডে আসামি হেলাল শেখকে স্পষ্টতই বলতে শোনা যায় যে, তারা তদন্তকারী কর্মকর্তাকে টাকা দিয়ে নিজেদের নাম চার্জশিট থেকে বাদ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘ওই জায়গা থিকা আলাদা করে নাম কাটাইতে গেলে টাকা দিবা লাগবে। না হলি তো কাটবে না।’ যখন তাকে জিজ্ঞাসা করা হয় যে তারা টাকা দিয়েছেন কিনা, তখন তিনি বলেন, ‘আমরা না দিলে কি আমাগে না কি করে কাটলো!’

নিরপরাধ ব্যক্তিদের অভিযোগ:

অন্যদিকে, এই মামলায় নিরপরাধ ব্যক্তিরাও আসামি হয়েছেন। নজির শেখ, যিনি ঘটনার দিন উপজেলা কৃষি অফিসে ধানবীজ সংগ্রহে গিয়েছিলেন, তাকে ১৭ নম্বর আসামি করা হয়েছে। স্কুল শিক্ষক মিজানুর শরীফ, যিনি ঘটনার সময় স্কুলে পাঠদানে ব্যস্ত ছিলেন, তাকে করা হয়েছে ১ নম্বর আসামি।

নজির শেখ বলেন, ‘আমি সেদিন উপজেলা কৃষি অফিসে গিয়েছিলাম। পরে শুনি আমিও নাকি মামলার আসামি।’

শিক্ষক মিজানুর শরীফও বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ‘আমাকে কেন আসামি করা হলো আমি নিজেও জানি না। তবে ঘটনার দিন আমি স্কুলে ডিউটিতে ছিলাম।’

মারামারি থামানো ব্যক্তিও আসামি!

এ ঘটনায় গ্রামের কূটচালে পড়ে আহত ব্যক্তিসহ অভিযোগকারীদের সহায়তাকারীকে আসামি করা হয়। পরে তারা তাদের ভুল বুঝতে পারেন। কিন্তু চার্জশিটে পাঁচ নম্বর আসামি আহকাম শরীফ ঘটনার দিন নিজের জীবন বিপন্ন করে তাদেরকে রক্ষা করেছেন। তিনি উপস্থিত না থাকলে হতাহতের সংখ্যা আরও অনেক বেশি হতো বলেও পুলিশ সদর দপ্তরে দেওয়া অভিযোগপত্রে তুলে ধরা হয়েছে।

শুধু তাই নয়, এ ঘটনায় আহত ব্যক্তি জানিয়েছেন, তিনি আদালতে হলফনামা দিয়েছেন এবং তাদের জবানবন্দীতে তারা আহকাম শরীফ সম্পর্কে কোথায় কোনো অভিযোগ অভিযোগ করেননি বলে জানান। আহত ব্যক্তি মামলার আসামি হওয়ায় পুরো গ্রামবাসী অবাক হয়েছেন এবং আহত ব্যক্তির পরিবারকে নানাভাবে হেয়প্রতিপন্ন করছেন বলে দাবি অভিযোগকারী জাকিরের।

এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরে অভিযোগকারী ও মামলার বাদী জাকির হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, আহকাম শরীফ এবং তার ভাই লাভা শরীফ আমার আহত ভাইকে চার মাস সহযোগিতা করেছে। ঢাকায় রাত তিনটায় যখন আমার ভাইকে পঙ্গু (জাতীয় অর্থোপেডিকস ও পূর্নবাসন) হাসপাতাল থেকে বের করে দিয়েছে, আহকাম শরীফের ছোট ভাই তার নিজস্ব গাড়িতে অন্য হাসপাতালে নিয়ে গেছেন ও তাকে চার মাস চিকিৎসা করিয়েছেন। আমি এই নির্দোষ মানুষগুলোকে কিভাবে অপরাধী হিসেবে মানবো বলেন! মূলত গ্রাম্য পলিটিক্সের কারণে নিরপরাধ মানুষগুলোকে আসামি করা হয়েছিল।

তিনি বলেন, আমরা গরীব বলে হেলাল শেখের কাছে মোটা অংকের টাকা নিয়ে মামলার আইও এই চার্জশিট দিয়েছে। শুধু তাই নয়, আমরা যাতে নারাজি দিতে না পারি এজন্য আমাদেরকে নানান ভাবে হয়রানি করেছে হেলাল শেখ। এমনকি নারাজি দেওয়ার দিন তারা এসে আমাদের হাত-পা পর্যন্ত ধরেছে। আমরা যাতে নারাজি না দেই। এ ঘটনায় হেলাল শেখ  ও তার লোকজন সরাসরি আমার ভাইকে হামলা করে পঙ্গু করেছে। আমি এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে  সবার বিচার চাই। যাদেরকে ভুয়া আসামি করা হয়েছে তাদেরকে আমি চার্জশিট থেকে নাম বাদ দেওয়ার জন্য আবেদন করছি। সেই সাথে যারা আমার ভাইয়ের ওপর হামলা করে তাকে পঙ্গু করেছে তাদের বিচার চাই।

তদন্তকারী কর্মকর্তার প্রতিক্রিয়া

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও লোহাগাড়া থানার এসআই মো. আসাদুজ্জামান তার বিরুদ্ধে ওঠা সকল অভিযোগ সম্পর্কে শুনে ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমি এই মুহূর্তে থানায় ব্যস্ত আছি। আপনি সরাসরি থানায় না আসলে কোনো কথা বলব না।’ এরপর তিনি ফোন কেটে দেন এবং পরবর্তীতে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

এমআইকে/এএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর