জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বহু স্মৃতিতে উজ্জ্বল চট্টগ্রাম। এখানকার অনেক স্থানে বসেই লিখেছিলেন তার অনেক জনপ্রিয় কবিতা। এসব স্থান বর্তমানে কেবলই স্মৃতি। দুর্লভ এই স্মৃতিগুলো সংরক্ষণে কোনো উদ্যোগ নেই।
এমনকি নগরীর নজরুল স্কয়ারটিও কিশোর গ্যাং ও মাদকসেবীদের নিরাপদ আখড়ায় পরিণত হয়েছে। হচ্ছে না নজরুল চর্চাও। ফলে যথাযথ চর্চা এবং সুযোগের অভাবে এই অঞ্চলের নতুন প্রজন্ম নজরুল ও তারঁ সৃষ্টিকর্ম নিয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ড করতে পারছেন না।
বিজ্ঞাপন
নজরুল বিষয়ক বিভিন্ন গবেষণাপত্র পর্যালোচনা এবং নজরুল গবেষকদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, কবি নজরুল চট্টগ্রামে এসেছিলেন চারবার। ১৯২৬ সালের জুলাই মাসে প্রথম চট্টগ্রামে আসেন তিনি। কলকাতা থেকে এসে কবি জেলা প্রশাসকের ডাকবাংলোতে ওঠেন।
চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্র সংসদের নেতা কবির বন্ধু হাবিবুল্লাহর বাহারের দাওয়াত এবং কলেজের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। কবির সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন চট্টগ্রাম কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ কামাল উদ্দিন। ওই সময় আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদে এক সভায়ও যোগ দেন কবি নজরুল। অনুষ্ঠানে তাঁকে কবি সম্রাট উপাধি দেওয়া হয়। পাঠ করা হয় ঘোষণাপত্র। ঘোষণায় কবি নজরুল ইসলামকে বাংলার মুসলমান সমাজের রতœস্বরূপ উল্লেখ করা হয়।
অনুষ্ঠানের আয়োজক হাবিবুল্লাহ বাহার ও তার বোন শামসুন নাহার মাহামুদ পরে কবিকে নগরীর রেয়াজুদ্দিন বাজারের তামাকুমুন্ডিস্থ তাঁদের বাসায় নিয়ে যান। এরপর সীতাকুন্ডে ও জেএম সেন স্কুলে তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। ওইসময় কবি মুসলিম হল, সীতাকুন্ড পাহাড় ও কর্ণফুলী তীরসহ বিভিন্ন এলাকায় বেড়াতে গিয়েছিলেন।
নজরুলের 'সিন্ধু', 'বাংলার আজিজ' 'কর্ণফুলী' কাব্যে এবং 'সিন্ধু হিন্দোল' কাব্যগ্রন্থের উৎসর্গপত্রে এই চট্টগ্রাম সফরের কথা উল্লেখ রয়েছে। প্রথমবার চট্টগ্রাম এসে খুব খুশি হয়েছিলেন কবি নজরুল। বেগম শামসুন নাহারের কাছে তিনি চিঠি লিখেছিলেন- ফুল যদি কোথাও ফুটে, আলো যদি কোথাও হাসে, সেখানে আমার গান গাওয়ার শোভা পায়, গান গাই। সেই আলো, সেই ফুল পেয়েছিলাম এবার চট্টলায়, তাই গেয়েছি গান। কবিকে খুশি করতে হলে দিতে হয় অমূল্য ফুলের সওগাত।
বিজ্ঞাপন
১৯২৯ সালে জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে ২য় বার চট্টগ্রামে এসেছিলেন কবি। চট্টগ্রাম এডুকেশন সোসাইটি প্রতিষ্ঠা অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত সভাপতি হিসেবে কবি ভাষণ দেন। তাঁর ভাষণটি ছিল শিক্ষা ও অর্থনৈতিক দিক থেকে অনগ্রসর মুসলিম সমাজকে উদ্দেশ্য করে। এছাড়া কাট্টলী চৌধুরী পরিবারে তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হয় মুসলিম লীগ নেতা মাহমুদুন্নবী চৌধুরী ও মৌলভী তমিজুর রহমানের উদ্যোগে। কাট্টলীর সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে কবিকে তরুণ মুসলিম নেতা হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়।
বুলবুল সমিতির সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে কবি নজরুলকে বাংলার শেলি উপাধি দেওয়া হয়। পরে চট্টগ্রামবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে কবি বলেছিলেন, কোনোদিন তোমাদের ঋণ পরিশোধ করতে পারব এ ঔদ্ধত্য আমার নেই, সম্বলও নেই। আমি যাযাবর কবি-আমায় ঝুলি ভরে যে পাথেয় দিলে তোমরা, তাই যেন আমার ভাবী পথের সহায় হয়। বিনিময়ে আমি রেখে গেলাম তোমাদের সিন্ধুতে তোমাদের কর্ণফুলীতে আমার দুই বিন্দু অশ্রু। তোমাদের হাতের দানকে চোখের জলে ভিজিয়ে গেলাম।

ওইসময় কবি পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত, ফতেয়াবাদের আলম পরিবারে, সন্দ্বীপে মোজাফফর আহমদের বাড়ি ও শহরের তামাকুমন্ডি লেনের হাবিবুল্লাহ বাহারের বাসভবন আজীজ মঞ্জিলে বেড়াতে গেছেন। শহরের নন্দনকানন ডিসি হিলে বসে কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন কবিতা- বাতায়ন পাশে গুবাক তরুর সারি এবং 'সম্মানের গান'।
বিদায়, হে মোর বাতায়ন-পাশে নিশীথ জাগার সাথী!
ওগো বন্ধুরা, পান্ডুর হয়ে এল বিদায়ের রাতি!
আজ হতে হল বন্ধ আমার জানালার ঝিলিমিলি,
আজ হতে হল বন্ধ মোদের আলাপন নিরিবিলি।
পরে তিনি সন্দ্বীপ নিয়ে লিখেছিলেন গীতিনাট্য 'মধুমালা'।
কবি নজরুল ৩য় বার চট্টগ্রাম আসেন ১৯৩৩ সালে। রাউজানে জলিল নগরে ডেউয়া হাজীপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে তরুণ কনফারেন্স ও শিক্ষা সম্মিলনীতে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগদান করেন তিনি। এ সময় গরু-ছাগল জবাই করে মেজবান খাওয়ানো হয়। টিকিট কেটে কবিকে দর্শন করেছিলেন উৎসুক জনতা।
রাউজান জলিলনগর বাসস্ট্যান্ড হতে আধা কিলোমিটার দক্ষিণ দিকে হাজী বাড়ি। এই হাজী বাড়িতে ১৯৩৩ সালের ৫ ও ৬ মে এই দুইদিন সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনের জন্য হাজীবাড়ির উত্তর পাশে ধানি জমির মাঠে রায়মুকুট দীঘির পূর্বপাড়ে বিশাল প্যান্ডেল করা হয় বাঁশের খুঁটি, ছনের ছাউনি দিয়ে। প্যান্ডেল তৈরিতে সময় লেগেছিল একমাস। রাউজানবাসী কবি নজরুলকে কাজী দা নামে ডাকতেন। ৫ মে সকালে নৌকায় করে হালদা নদী পার হয়ে রাউজানে এলে ঘোড়ার গাড়িতে চড়িয়ে কবিকে হাজী বাড়ি নিয়ে আসা হয়। কবি সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন হারমোনিয়াম ও বাঁশি। পরনে ছিল সাদা পাঞ্জাবি, ধুতি, সাদা গান্ধী টুপি ও জুতা।
প্রথম দিন আলোচনা শেষে বিকাল ৪টার পর কবি তাঁর কবিতা আবৃত্তি করেন। এরপর গেয়েছেন ইসলামিক গান। দ্বিতীয় দিন প্রধান অতিথি হিসেবে ভাষণ দেওয়ার পর কবি হারমোনিয়াম বাজিয়ে গেয়েছিলেন-বাজল কিরে ভোরের সানাই/নিদমহলের আঁধার পুরে। শুনছি আজান গগনতলে/অতীত রাতের মিনার চুড়ে। ৭ মে গহিরাবাসী গহিরা স্কুলে তাঁকে তাৎক্ষণিক সংবর্ধনা দেয়। সেখানে কান্ডারী হুঁশিয়ারসহ বেশ কয়েকটি গান গেয়ে শোনান কবি। সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে হাজী বাড়ির সামনে স্থাপিত হয়েছে নজরুল স্মৃতিফলক।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, কবিকে এক নজর দেখা কিংবা তার কণ্ঠে গান শোনার জন্য রীতিমত মেলা বসে যায় ওই এলাকায়। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ পায়ে হেঁটে, নৌকায়, গরুর গাড়িতে করে আসতে থাকে সম্মেলনস্থলে। ডেউয়া হাজী বাড়ির পাশে রায় মুকুট দীঘির উত্তর পাড়ে জনসাধারণের জন্য তৈরি করা হয় বিশাল প্যান্ডেল। হাজার হাজার মানুষের পদভারে মুখরিত হয়ে ওঠে এই জনপদ। মুশকিল হয়ে পড়ে ভিড় সামলানো। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে টিকিট কেটে কবি দর্শনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন উদ্যোক্তারা। টিকিটের দাম নির্ধারণ করা হয় ১ টাকা, ৫ টাকা, ১০০ টাকা, ৫০০ টাকা।
১৯৭৩ সালে ৪র্থ বারের মতো ৭৫ বছর বয়সে একদিনের জন্য কবি এসেছিলেন চট্টগ্রামে। তখন তিনি ছিলেন অসুস্থ, হারিয়েছেন বাক ও স্মৃতিশক্তি। পরদিন তাঁকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়।
চট্টগ্রামের নজরুল গবেষক ড. মুহাম্মদ কামাল উদ্দিন ঢাকা মেইলকে বলেন, নজরুল স্মৃতিতে ভরা চট্টগ্রাম। চট্টগ্রামে নজরুল স্মৃতিকেন্দ্র হওয়ার কথা ছিল। এটা হলে চট্টগ্রামের মানুষের জন্য আনন্দের বিষয় হতো। এর ফলে নতুন প্রজন্ম কবি নজরুলকে জানতে পারতো।
নজরুলের স্মৃতি সংরক্ষণে যথাযথ উদ্যোগ নেই
চেতনা ও আন্দোলন-সংগ্রামে আছেন নজরুল। বাস্তবতায় নজরুলের স্মৃতি সংরক্ষণে কোন উদ্যোগ নেই চট্টগ্রামে। ব্যাপকভাবে হচ্ছে না নজরুল চর্চাও। নজরুলের বৈচিত্রের কারণে যে আধুনিক সঙ্গীত এসছে তার চর্চা তেমন হচ্ছে না। এমনটায় দাবি, নজরুলপ্রেমীদের।
অভিযোগ উঠেছে, নজরুলের চর্চা বাড়ানোর জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে 'নজরুল গবেষণা কেন্দ্র' চালু করা হলেও এই কেন্দ্রের উল্লেখযোগ্য কোন কার্যক্রম নেই। এই অঞ্চলের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও নজরুলের সৃষ্টিকর্ম নিয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ না হওয়ায় নতুন প্রজন্ম নজরুলকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করতে পারছেন না। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোও নজরুল চর্চায় পর্যাপ্ত ভূমিকা রাখছেন না।

নজরুল চর্চা প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙলা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও নজরুল গবেষক ড. মাহবুবুল হক ঢাকা মেইল বলেন, চট্টগ্রামে তো নজরুল নিয়ে আলাদা কোন ইনস্টিটিউশন বা সংস্থা নেই। তবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নজরুল গবেষণা কেন্দ্র আছে। এই গবেষণা কেন্দ্র থেকে বৃত্তি দেয়া, গবেষণা প্রবন্ধ বা পত্রিকা বের করা উচিত। যেগুলো ঠিকভাবে হচ্ছে না। নজরুলের গানের ক্ষেত্রে দেখেছি তা গাওয়া হয়, শিল্পীও আছেন। কিন্তু নজরুল নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে ঘাটতি আছে। যারা করছেন তারা বিচ্ছিন্নভাবে করছেন এবং বিচ্ছিন্নভাবে দুই-একটি প্রবন্ধ লিখছেন। কিন্তু বড় ধরনের কাজ হচ্ছে না।
তিনি বলেন, নজরুল চট্টগ্রামে চারবার এসেছিলেন, এই চারবার কবি কোথায় কোথায় গেছেন, কাদের সাথে গেছেন, কী কী কাজ করেছেন, ওই সময়টাতে কি কি সাহিত্য রচনা করেছেন সেগুলোর ওপর আলাদা কাজ হতে পারে। ওই সময়ে তখনকার পুরোনো দিনের পত্রপত্রিকায় তাঁর কোনো লেখা ছাপানো হয়েছে কী না সেটাও দেখার বিষয়। কারণ সেই সময়ে তো এখানে অনেক পত্রপত্রিকা ছিল, যেগুলো সংরক্ষিত হয় নাই। যদি গবেষণা করা হয়, সেগুলো সংগ্রহের ব্যবস্থা করা হয় তাহলে হতো কোন পুরোনো পত্রিকায় উপাদান পাওয়া যেতে পারে।'
তিনি আরও বলেন, ২০১৭ সালের ২৫ মে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন এক অনন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। সেটি হচ্ছে নজরুলের জন্ম জয়ন্তীতে চট্টগ্রাম মহানগর ও জেলার সব মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে কবি নজরুল ইসলামকে নিয়ে ১০ মিনিট আলোচনা করা। কিন্তু তারও কোনো প্রতিফলন নেই।
এই নজরুল গবেষক বলেন, আমার ব্যক্তিগত অভিমত, রাষ্ট্র এবং সামাজিক উদ্যোগের মধ্য দিয়ে চট্টগ্রামে নজরুলের যে স্মৃতি তা সংরক্ষণ সম্ভব। কোন ব্যাক্তির পক্ষে নজরুলের স্মৃতি সংরক্ষণ সম্ভব নয়। এই ক্ষেত্রে রাষ্টীয়ভাবে নজরুলের স্মৃতি সংরক্ষণে এগিয়ে আসতে হবে। একইসাথে নজরুলের সৃষ্টিকর্ম সম্পর্কে নতুন প্রজন্মকে অবহিত করতে বিভিন্ন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে বাড়াতে হবে নজরুল চর্চা।
অপ্রীতিকর আড্ডা নজরুল স্কয়ারেও
চট্টগ্রাম ডিসি হিলের নজরুল স্কয়ারের দেয়ালে বাতায়ন পাশে গুবাক তরুর সারি কবিতার ১২ লাইন লেখা। ভেতরে যেতেই দেখা যায় উঠতি বয়সি কিশোর-কিশোরী ও তরুণ-তরুণীদের অপ্রীতিকর আড্ডা। কথা বলতে চাইলেই ক্ষিপ্ত হয়ে তেড়ে আসে তাদের কয়েকজন।
জানতে চাইলে সেখানে দায়িত্বরত নিরাপত্তা কর্মীরা জানান, স্কুল-কলেজের পোশাক পরে নজরুল স্কয়ারে প্রতিদিন দেদার ধূমপান করে কিশোররা। প্রতিদিন তারা নানা ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটায় সেখানে। অনেক সময় মারধর করে মোবাইল-মানিব্যাগ রেখে দেয়। কিন্তু তাদের পক্ষে কিছুই করার থাকে না। কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় স্থানটি এখন মাদকসেবিদের আখড়ায় পরিণত হয়েছে।
আইকে/জেবি

