রোববার, ২০ এপ্রিল, ২০২৫, ঢাকা

মানিকগঞ্জের এই আঙিনায় বেড়ে উঠেছিলেন কবিপত্নী প্রমীলা নজরুল

মো. সেলিম মিয়া
প্রকাশিত: ১৬ আগস্ট ২০২২, ০৪:১২ পিএম

শেয়ার করুন:

মানিকগঞ্জের এই আঙিনায় বেড়ে উঠেছিলেন কবিপত্নী প্রমীলা নজরুল
ছবি: ঢাকা মেইল

নাম ছিল আশালতা সেনগুপ্ত (প্রমীলা)। ডাক নাম— দোলনা। পরিবারের লোকজন আদর করে আরও সংক্ষেপে ডাকতেন দুলী বলে। এই দুলী-ই পরবর্তীতে প্রমীলা নজরুল ইসলাম বা প্রমীলা নজরুল নামে সবার কাছে সুপরিচিত হয়ে ওঠেন।  

হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। বলছিলাম— জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের পত্নী (স্ত্রী) প্রমীলা নজরুলের কথা। প্রমীলা নজরুলের জন্মভিটা মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার তেওতা গ্রামে। ১৯০৮ সালের ১০ মে এই গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। এই গ্রামেরই ধুলবালি মাখা পথে হেঁটে বড় হয়েছেন তিনি। যমুনা নদীর পাড় দিয়ে বয়ে চলা এই গ্রামের আলো, বাতাসে বড় হয়ে ওঠা প্রমীলাকে পরিবারের লোকজন এবং গুরুজনেরা ভালোবেসে ডাকতেন দুলী নামে।


বিজ্ঞাপন


শোনা যায়, দুলী ছিলেন ভারী সুন্দরী। চাঁপার কলির মতো ছিল তার গায়ের রং। মধূর স্বভাবের জন্য তিনি ছিলেন, সকলের কাছে আদরের। প্রমীলাকে নিয়েই তার বাবা-মায়ের সংসার পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।

প্রমীলার বাড়ির পাশেই কিরণশঙ্করের তেওতা জমিদার বাড়ি। এই জমিদার বাড়িতে আসতেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। জমিদার বাড়ির পুকুরে গোসল করতেন কবি। পুকুরের পাড়ে গিয়ে খেলা করতেন প্রমীলা। সেখানে প্রমীলাকে দেখে, তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে কবি তার প্রেমে পড়ে যান। তবে গ্রামের মানুষ তখন এই সম্পর্ক মেনে নিতে চায়নি। 

কথিত রয়েছে, এ প্রাসাদেই নজরুল প্রমীলা দেবীর প্রেমে পড়ে লিখেছিলেন— ‘তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয়/সে কি মোর অপরাধ’...

প্রমীলা যখন ৫ম শ্রেণীতে পড়ালেখা করতেন, তখন তার বাবা বসন্ত কুমার সেনগুপ্ত মারা যান। দুলীকে নিয়ে তার মা গিরিবালা দেবীর জীবন সংগ্রাম শুরু হয়। দুলীর কাকা ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্ত তাদেরেকে কুমিল্লা নিয়ে যান। সেখানে তিনি কোর্ট অব ওয়ার্ডসের ইন্সপেক্টর ছিলেন। গোমতী নদীর তীরে কান্দির পাড়ে তার বাড়ি ছিল।
প্রমীলার সঙ্গে বিয়ের পরে কবিকে নিয়ে প্রমীলা অনেকবার এই তেওতা গ্রামে এসে ছিলেন বলেও জানা যায়। কবি তেওতা গ্রাম ও মানিকগঞ্জ নিয়ে অনেক কবিতা লিখেছেন। 


বিজ্ঞাপন


সম্প্রতি সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেল, জাতীয় কবির শ্বশুর বাড়ি ও প্রমীলা নজরুলের নিজ বাড়ি এখন অন্যের দখলে। মানিকগঞ্জবাসী কবি ও তার পত্নীর স্মৃতি বিজড়িত বাড়িটি উদ্ধারে দাবিও জানালেন। সেখানে নজরুল-প্রমীলা পর্যটন কেন্দ্র, নজরুল-প্রমীলা গবেষণা কেন্দ্র, নজরুল-প্রমিলা স্মৃতি পাঠাগার, নজরুল-প্রমীলা জাদুঘর ও নজরুল-প্রমীলা বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবি জানান তারা। 

তেওতা জমিদার বাড়ির সামনে, পুকুর ঘাটের পশে নির্মিত হয়েছে কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও প্রমীলা নজরুল মঞ্চ। জানা গেছে, মঞ্চটি বছর দুয়েক আগে নির্মাণ করেন জেলা পরিষদ ও উপজেলা পরিষদ। কবি ও তার পত্নীর ম্যুরাল বাসনো হয়েছ প্রায় ৭ মাস আগে। এখন এই মঞ্চে ঐ এলাকার সামাজিক ও সাংকৃতিক অনুষ্ঠান হয়।
 মানিকগঞ্জ জেলা শহর থেকে মোটরসাইকেলে ৩০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে শিবালয় উপজেলায়। সেখানে থেকে ১৫ মিনিট লাগে তেওতা গ্রামে যেতে। বেলা তখন প্রায় সাড়ে দশটা। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়লে তখন আকাশ কালো মেঘে ঢাকা। প্রায় ধংস হয়ে পড়া তেওতা জমিদার বাড়িটি আরও ভূতুড়ে মনে হচ্ছিল। এই জমিদার বাড়ির পূর্বপাশেই জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের পত্নী (স্ত্রী) প্রমীলা নজরুলের বাবার বাড়ি। তবুও স্থানীয় একজনকে জিঙ্গাসা করতেই বাড়িটি দেখিয়ে দিলেন তিনি। এটাও বলে দিলেন, ওই বাড়িতে কাউকে পাওয়া যাবে না। সেখানে কেউ থাকেন না এখন।

দুই মিনিটেই পৌঁছে গেলাম, ওই ভদ্রলোকের দেখিয়ে দেওয়া বাড়িটিতে। তেওতা গ্রামের ভেতর দিয়ে এলজিইডি বিভাগের নির্মিত আরিচা-জাফরগঞ্জ সড়কের পাশেই একটা চারচালা টিনের ঘরটি দেখা গেল, বাইরের দিকে সবকটি দরজা জানালা বন্ধ। বাড়ির উঠোনে ঢুকেও কারো দেখা মিলল না। ভেতরের দিকে ঘরের জানালা সবকটি খোলা, তবে দরজায় ছোট্ট একটা তালা ঝুলছে। 

পুরো বাড়ি আগাছায় ভরা। আম, কাঠাল, নারকেল, সুপারি গাছে পুরো বাড়িটি ঘেরা। উঠানের মাঝে একটি পেয়ার গাছ। বাড়ির দক্ষিণে একটি পকুর। পরিস্কার পানিতে বেশ কিছু হাঁস জলডুবি খেলছে।
এদিকে ঘরের জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখা গেল, ঘরে কোনো আসাবাপত্র নেই। পুরো ঘরে ঝুলছে মাকড়সার জাল। উঠনের আরেক প্রান্তেও একটি চারচালা টিনের ঘর। সেটির অবস্থাও প্রায় একই রকম। এটির সবকটি দরজা-জানালা বন্ধ। ইটের বারান্দা ভাঙাচোরা। টিনের চালে জং ধরেছে। 

তেওতা একাডেমির অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অজয় কুমার চক্রবর্তী বলেন, কাজী নজরুল ইসলামের স্ত্রী প্রমীলা নজরুলের ডাক নাম ছিল দুলী। তিনি তেওতা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। এখানকার ধুলামাটিতে তিনি বড় হয়েছেন। প্রমীলা ৫ম শ্রেণীতে লেখা পড়াকালীন, তার বাবার অকালে মারা যান। তখন প্রমীলার কাকা প্রমীলা ও তার মাকে কুমিল্লায় নিয়ে যান।

বৈশাখী টেলিভিশনের মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি মো. মারুফ হোসেন বলেন, তেওতা জমিদার বাড়ির পূর্বপাশে প্রমীলার জন্মভিটা। আমরা মুরুব্বিদের কাছে তাই শুনেছি। দালিলিক প্রমাণ হিসেবে সি এস রেকর্ডে প্রমীলার বাপ-দাদার নাম এখনও আছে।

নজরুল প্রমীলার সাংস্কৃতিক গোষ্ঠির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম বলেন, কবি নজরুল তেওতা জমিদার বাড়ির পুকুরে সাঁতার কেটে গোসল করতেন। তখন প্রমীলাকে দেখতে পান। তাকে দেখে মুগ্ধ হন। স্থানীয়রা তখন অনেকেই এটি মেনে নেননি। সে কারণে কবি তেওতা থেকে এসে মানিকগঞ্জ শহরে তেজেন মিত্রের বাড়িতে দুই মাস অপেক্ষা করেন। পরে মানিকগঞ্জ থেকে কবি কুমিল্লা যান।
তেওতা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. মোশারফ হোসেন বলেন, প্রমীলা নজরুলের জন্মভিটা মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার তেওতা গ্রামে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও প্রমীলা নজরুলের স্মৃতি বিজড়িত এই গ্রামের বাসিন্দারা তাদের নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয়, নজরুল আর্কাইভ ও নজরুল-প্রমীলা গন্থাগারের দাবি জানিয়েছেন। 

শিবালয় উপজেলার নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. জাহিদুর রহমান বলেন, তেওতা গ্রামে প্রমীলা নজরুলের জন্মভিটা রয়েছে। নজরুল প্রমীলার সাংস্কৃতিক গোষ্ঠির দায়িত্বশীলদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি। এখানে তারা একটা নজরুল ইনস্টিটিউট এবং একটি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ করতে চান।

তিনি বলেন, সরকারিভাবে কোনো নির্দেশনা থাকলে সেটা আমরা দেখব। জেলা প্রশাসন এখানকার ভূমির বিষয়ে জানতে চেয়েছিলেন। আমাদের কাছে যে রিপোর্ট আছে তা ইতিমধ্যে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।

প্রতিনিধি/এএ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর