রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক ছাত্রদল নেতা খুন হওয়ার পর নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী চালায় একাধিক অভিযান। গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় সেখানে থাকা অবৈধ সব দোকানপাট। এরপরও রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এই উদ্যানটিতে বন্ধ হচ্ছে না মাদকের আসর। সন্ধ্যা নামলেই উদ্যানের বিভিন্ন প্রান্তে জমে উঠছে মাদকসেবীদের আড্ডা।
অবৈধ দোকানের জঞ্জাল পরিষ্কার করায় উদ্যান প্রাঙ্গণে অনেকটাই স্বস্তি ফিরেছে। এখানে একটু সময় কাটাতে আসা নগরবাসী এতে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তবে মাদকের আসর এখনো বন্ধ না হওয়ায় তা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন তারা।
বিজ্ঞাপন
সরেজমিনে দেখা যায়, উদ্যানের ভেতরে ব্যাঙ্গের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা দোকানপাটগুলো এখন নেই। মানুষ নির্বিঘ্নে যাতায়াত করতে পারছেন। উদ্যানজুড়ে সুন্দর একটি পরিবেশও সৃষ্টি হয়েছে। যেখানে পরিবার-পরিজন নিয়ে আড্ডা দিচ্ছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। তবে মাদক সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা গেলে উদ্যানের সৌন্দর্য ও পরিবেশ আরও বাড়বে বলেই মনে করছেন আগত দর্শনার্থীরা।
দুই সন্তানসহ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঘুরতে এসেছিলেন তাসফিয়া বেগম। তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, সপ্তাহে একদিন অন্তত সন্তানদের নিয়ে একটু ঘুরতে বের হই। এই উদ্যানের একটা পাশ নিরাপদ। সেখানেই ঘুরতাম। আগে দোকানপাটের জঞ্জাল ও মাদকসেবীদের উৎপাতের কারণে সন্তান নিয়ে পুরো প্রাঙ্গণ ঘোরা যেতো না। এখনকার পরিবেশটা সুন্দর লাগছে। মাদকসেবীদের উৎপাতও আজ কম মনে হয়েছে। তবে পুরোপুরি বন্ধ করা গেলে পরিবার নিয়ে মানুষ স্বাচ্ছন্দ্যেই এখানে সময় কাটাতে পারবে।

বিজ্ঞাপন
স্কুল শিক্ষার্থী আরাফ ঢাকা মেইলকে বলেন, আমরা বিকেলে এখানে ক্রিকেট খেলি। সুন্দর পরিবেশ তৈরি হলে আমাদের আরও ভালো লাগবে।
ডেথ স্পটে পুলিশ, মুক্তমঞ্চে লাঠি হাতে কারা?
গত মঙ্গলবার দিবাগত রাতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ছাত্রদল নেতা শাহরিয়ার আলম সাম্য নিহত হন। এ ঘটনার পর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের নিরাপত্তা নিয়ে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। সমালোচনার মুখে উদ্যানের নিরাপত্তা জোরদারে বেশ কয়েকটি উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে উদ্যানে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। এই হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে এখনো চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে এখানে। ডেথ স্পট পাহারা দিচ্ছে পুলিশ। এর ঠিক পাশেই মুক্তমঞ্চ। সেখানে লাঠি হাতে কয়েকজন কিশোর সাধারণ দর্শনার্থীদের মুক্তমঞ্চে ঢুকতে বাধা দিচ্ছে। এ কারণে মুক্তমঞ্চ অনেকটাই জনশূন্যই ছিল। কিন্তু লাঠি হাতে এই কিশোররা কারা সে প্রশ্ন তুলছেন অনেকেই।
সাধারণ দর্শনার্থীরা বলছেন, মুক্তমঞ্চ তো সবার জন্যই উন্মুক্ত। এখানে তারা আগেও বসে আডডা দিয়েছেন। কিন্তু হুট করেই কিছু কিশোর লাঠি হাতে আমাদের ধাওয়া করছেন। এটা খুবই দৃষ্টিকটু ও বাজে অভিজ্ঞতা। পাশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অবস্থান করছে, এখানে আসা নিষেধ থাকলে, সেটিও জানাতে পারে। কিন্তু এমন আচরণ কেন? আর এরাই বা কারা?
আরব আলী নামের এক যুবক ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘পাশেই কিছুদিন আগে একটা হত্যাকাণ্ড হয়েছে বলে শুনেছি। সেখানে পুলিশ আছে। মুক্তমঞ্চ ফাঁকা। হাতেগোনা কয়েকজন আড্ডা দিচ্ছে। আমিও এসে একটু বসেছি। এসময় এক কিশোর লাঠি হাতে ধাওয়া দিয়ে সবাইকে বের করলো। এরা কারা সেটাই বুঝলাম না।’

এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কিশোর নিজেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র দাবি করে ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘এখানে আমাদের সিনিয়র বড় ভাইদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা অবস্থান করছি। যেন বহিরাগতরা এখানে মাদকের আড্ডা জমাতে না পারে।’
লাঠি হাতে এই কিশোররা কারা? এমন প্রশ্নে তিনি জানান, এরা এখানকারই।
এদিকে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পুরো এলাকা ঘুরে ডেথ স্পটের পাশে আটজন পুলিশ সদস্যের দেখা মেলে। শাহবাগ থানার এসআই মাজেদুল আলম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমরা এখানে নিরাপত্তার দায়িত্বে আছি। পাশাপাশি মাদকের বিষয়টিও দেখছি। আর মুক্তমঞ্চে লাঠি হাতে কারা আছে, এটা আমাদের জানা নেই।’
কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন কতটুকু?
গত বুধবার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মধ্যে একটি সভা হয়। সভায় রাত আটটার পর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধসহ সাতটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

সিদ্ধান্তগুলো হলো—১. টিএসসি-সংলগ্ন উদ্যানের ফটকটি স্থায়ীভাবে বন্ধ করা হবে। ২. সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অবৈধ দোকান উচ্ছেদ, মাদক ব্যবসা বন্ধ ও পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিতে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশন, ডিএমপি (ঢাকা মহানগর পুলিশ) ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সমন্বয়ে যৌথ অভিযান পরিচালিত হবে। ৩. নিয়মিত নজরদারি ও অভিযানের জন্য সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করবে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। ৪. উদ্যানে পর্যাপ্ত আলো ও ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা (সিসিটিভি) স্থাপন এবং সেগুলোর নিয়মিত মনিটরিং (পর্যবেক্ষণ) করা হবে। ৫. সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একটি ডেডিকেটেড (নিবেদিত) পুলিশ বক্স স্থাপন করা হবে। ৬. উদ্যানে রমনা পার্কের মতো সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা চালু করা হবে। ৭. রাত আটটার পর উদ্যানে জনসাধারণের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা হবে।
সরেজমিনে গিয়ে এসব সিদ্ধান্তের কিছু কিছু বিষয় বাস্তবায়ন হতে দেখলেও বেশির ভাগ সিদ্ধান্তই এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। দর্শনার্থীরা বলছেন, এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের হারানো ঐতিহ্য ও সৌন্দর্য দুটোই ফিরে আসবে।
এমআই/জেবি

