রাজধানী শহর ঢাকা ছাড়িয়ে দেশের অন্যান্য নগর ও প্রান্তিক জনপদে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা যাতায়াতের জন্য দৈনন্দিন বাস্তবতায় এখন অন্যতম অনুষঙ্গ। নাগরিক জীবনের গতি ও সাধ্যের সমন্বয়ে এই বাহনটি একদিকে যেমন এনেছে স্বস্তি ও সাশ্রয়, তেমনি দিয়েছে সময় ও পরিশ্রমের মুক্তি। বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির যাতায়াতে এটি হয়ে উঠেছে এক নীরব বিপ্লবের বাহক।
কিন্তু এই স্বস্তির আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে একাধিক সংকট। আইন-নির্বাহে শূন্যতা, দুর্ঘটনা ঝুঁকি, নিরাপত্তার প্রশ্ন এবং জাতীয় বিদ্যুৎ ব্যবস্থায় চাপ সামলানোর চ্যালেঞ্জ। এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে- এই বাহন কতটা জনবান্ধব এবং কতটা ঝুঁকিপূর্ণ।
বিজ্ঞাপন
বিশাল পরিসরে ব্যবহার, বিপুল কর্মসংস্থান:
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য বলছে, রাজধানীসহ দেশের প্রত্যন্ত এলাকাতেও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার আধিপত্য পৌঁছে গেছে। রাজধানীতে প্রায় ৮ থেকে ১০ লাখ ব্যাটারিচালিত চলাচল করছে। দেশজুড়ে এই সংখ্যা প্রায় ৬০ লাখ। যেখানে ৮০ লাখ মানুষ এর মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করছে।
সস্তা ও স্বাচ্ছন্দ্যের যাত্রায় দুর্ঘটনার ঝুঁকি:
বিজ্ঞাপন
সংস্থাটির পর্যবেক্ষণ বলছে, পরিবহন ব্যবস্থায় এই পরিবর্তনের ফলে দুর্ঘটনার ঝুঁকিও বেড়েছে। প্রতিদিন দেশের প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৬-৭ জন, জেলা হাসপাতালে ১২-১৫ জন, বিভাগীয় হাসপাতালে ২০-২৫ জন এবং দেশের প্রায় ৪ হাজার বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে প্রতিদিন ৮-১০ জন আহত রোগী আসছে, যারা এই ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার দুর্ঘটনার শিকার। বছরে প্রায় ৩ লাখ মানুষ এই দুর্ঘটনার শিকার হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এছাড়া ব্যাটারির সিসাও জনস্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। চাপ বাড়ছে দেশের বিদ্যুতেও।
একদিকে বিশাল মানুষের জীবিকা ও যাত্রী সুবিধা অপরদিকে নানা ঝুঁকির চ্যালেঞ্জ। একারণে সরকারও এ বিষয়ে সিদ্ধান্তহীনতাই ভুগছে। আবার এ বিষয়ে দেশে সুনির্দিষ্ট আইন না থাকায় স্থানীয় প্রশাসন ও আইন শৃঙ্খলাবাহিনী নিজেদের মতো করে সাধারণ পরিবহন আইনের প্রয়োগ করছেন।
রাজশাহী সিটি করপোরেশন এই গাড়ির বৈধতা দিয়ে বিপুল পরিমাণ রাজস্বও সংগ্রহ করছে। বুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো. এহসানের সহযোগিতায় গাড়ির মডেলে কিছুটা পরিবর্তন এনে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)ও এটির বৈধতা দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। যা নিয়ে নানা মহলে আলোচনা-সমালোচনাও চলছে।

জনপ্রিয়তার পেছনে মূল কারণসমূহ:
বাংলাদেশের যাতায়াত ব্যবস্থায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা এক নিরব বিপ্লব এনেছে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। দিনদিন এ বাহনের জনপ্রিয়তা বাড়ছে মূলত এর বহুমাত্রিক সুফলের কারণে। নাগরিক জীবনকে যেমন করেছে সহজ, তেমনি সৃষ্টি করেছে নতুন অর্থনৈতিক সুযোগ।
সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী যাতায়াত:
জ্বালানিচালিত যানবাহনের তুলনায় ব্যাটারিচালিত অটো কম খরচে চলাচল করতে পারে। এতে যাত্রীদের যাতায়াত ব্যয় হ্রাস পেয়েছে। বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য। গ্রামের ভাঙা রাস্তা, অলিগলি কিংবা শহরের ব্যস্ত মহল্লায় এ বাহন পৌঁছে যাচ্ছে অনায়াসে। যেখানে অন্য কোনো পরিবহন সহজে যায় না।
ঢাকার মিরপুরের বাসিন্দা শামীম কবির ঢাকা মেইলকে বলেন, আমার রুম থেকে অফিসের যে রাস্তা। এটা সরু হওয়ার কারণে বাস চলাচল করে না। একারণে রিকশাতেই যেতে হয়। আর পায়ে চালিত রিকশা যে ভাড়া দাবি করে তার প্রায় অর্ধেকে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালকরা চলে যান। এটা অবশ্যই আমার জন্য সুবিধার।
আরেকজন রাজশাহী জেলার মোহনপুরের বাসিন্দা শামসুন্নাহার সুইটি ঢাকা মেইলকে বলেন, আমাদের এখানে অভ্যান্তরীণ মাত্র দু’তিনটা রুটে বাস চলাচল করে। বাকিটা অটোরিকশার দখলে। হাতে গোনা কিছু সিএনজি আছে। আর অটো রিকশায় খরচ অনেকটাই কম। যাতায়াতও স্বাচ্ছন্দ্যময়।
কর্মসংস্থানের সুযোগ:
দেশজুড়ে বিশাল মানুষ এখন অটোরিকশা পেশার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত। অনেকে উচ্চশিক্ষা শেষ করে বাধ্য হয়ে ব্যাটারিচালিত রিকশাকে বেছে নিচ্ছে। একদিকে দরিদ্র ও অশিক্ষিত যুবকদের জন্য এটি বিকল্প আয়ের পথ তৈরি করেছে। অন্যদিকে অটোরিকশা সংক্রান্ত ব্যবসা, মেরামত, ব্যাটারি বিক্রি, চার্জিং স্টেশন ইত্যাদির মাধ্যমে একটি ক্ষুদ্র অর্থনীতির চক্র গড়ে উঠেছে।

অটোরিকশা চালক পলাশ হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, আমি বিএ শেষ করে বেকার অবস্থায় ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। আশেপাশে চাকরির জন্য প্রচুর ঘুরেও চলার মতো চাকরি পাইনি। পরে বাধ্য হয়ে ঋণের টাকায় অটোরিকশা কিনেছি। এখন সংসারটা মোটামুটি ভালোই চলে যায়।
বৃদ্ধ, শিশু ও নারীর যাতায়াতে সহায়ক:
এই বাহনের অস্বাভাবিক গতি ঝুঁকিপূর্ণ হলেও বৃদ্ধ, শিশু ও নারীর চলাচলে এই বাহন অনেকটাই সহায়ক বলেই মনে করছেন যাত্রীরা।
গৃহবধূ লাকী খাতুন ঢাকা মেইলকে বলেন, স্বামীর চাকরির সুবাদে ঢাকায় থাকছি। প্রায়শই রাজধানীর পাবলিক পরিবহনে চলাফেরা করা লাগে। পাবলিক পরিবহন হিসেবে বাস ও মেট্রোরেল কোনোটাই নারীদের জন্য স্বাচ্ছন্দ্যের না। কখন কোন দিক দিয়ে ধাক্কা দেয় বোঝা দায়। একারণে আমার চার্জার অটোরিকশাকে ভালো লাগে। দ্রুত গতিতে যাওয়াও যায়।
স্থানীয় অর্থনীতিতে গতি:
ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা গ্রামীণ অর্থনীতেও গতি এনে দিয়েছে। দ্রুত সময় ও কম খরচে যাত্রী পরিবহনসহ মালামাল পরিবহনও করা হচ্ছে। এরমধ্য দিয়ে হাট-বাজার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কর্মস্থল সবকিছুতেই যাতায়াতের গতিশীলতা এসেছে। ফলে স্থানীয় অর্থনীতির চক্রও ঘুরছে অনেকটা বেশি গতিতে।
নিরাপত্তার ছেঁড়া চাদর:
যদিও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা অসংখ্য সুফল বয়ে এনেছে, তেমনি এর অনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাপনা সৃষ্টি করছে ভয়াবহ ঝুঁকি। চালকদের বড় একটি অংশ অপ্রশিক্ষিত, যা এই বাহনকে আরও বেশি অনিরাপদ করে তুলেছে। ব্যাটারিতে থাকা বিষাক্ত সিসা অনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাপনা বড় স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করেছে।
ডিএনসিসি প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ (অতিরিক্ত দায়িত্ব) এস,এম, শফিকুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, এটা যতটা সুবিধা দেয়, তার চেয়েও বেশি ক্ষতিকর। সুতরাং ঝুঁকিটাকে আমাদের আগে গুরুত্ব দিতে হবে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজ্জামেল চৌধুরী ঢাকা মেইলকে বলেন, সুবিধা ও ঝুঁকির একটা চ্যালেঞ্জিং বাস্তবতা তৈরি হয়েছে এই যানটিকে ঘিরে। তবে আমাদের সব সময় আগে ঝুঁকিটিকে বিবেচনা করতে হবে। কারণ ক্রমান্বয়ে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাসহ যাতায়াত ব্যবস্থার জন্য বিষফোঁড়ায় পরিণত হচ্ছে এই যান। সরকারকে এখানে কৌশলী ভূমিকায় আসতে হবে। এখানে কর্মরত কর্মীদের বিকল্প কর্মস্থান তৈরি করে স্মার্ট পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
এমআই/ইএ

