- প্রথম নারী ও শিশু শহীদ নাইমা
- বড় হয়ে চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন ছিল নাইমার
- ট্রমা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টায় নাইমার পরিবার
- মৃত্যুর আগে নাইমার রহস্যময় তিন স্বপ্ন
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে সেই আন্দোলন দমাতে সব চেষ্টাই করেছে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকার। তাদের নির্মমতা থেকে রক্ষা পায়নি ঘরে থাকা নারী-শিশুরাও। তাদেরই একজন রাজধানীর উত্তরার অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী নাইমা সুলতানা। নিজ বাসায় গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারায় নাইমা। সে জুলাই আন্দোলনের প্রথম নারী ও শিশু শহীদ।
বিজ্ঞাপন
তাকে মা বাসায় আটকে রেখেছিলেন শেখ হাসিনার লেলিয়ে দেওয়া বাহিনীর গুলির ভয়ে। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। ঘরেই ঘাতকের গুলিতে প্রাণ হারায় শিশু নাইমা। সেই স্মৃতি আওড়িয়েই শোকে কাতর মা আইনুন্নাহার বেগম বলছিলেন, ‘ঘরে রেখেও মেয়েটিকে বাঁচাতে পারলাম না। স্বৈরাচারী সরকার শিশুর নিরাপত্তাও দিলো না।’
ঢাকা মেইলের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় আইনুন্নাহার বেগম বলেন, শুধু পড়াশোনার কথা চিন্তা করে মেয়েকে নিয়ে গ্রাম থেকে শহরে এসেছিলাম। এখানে মেয়েকে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি করাই। পড়াশোনার পাশাপাশি আর্ট করতে খুবই পারদর্শী ছিল সে। পেশা হিসেবে ডাক্তার হতে চেয়েছিল নাইমা। একই সঙ্গে গ্রাফিক্স ডিজাইনার হওয়ার ঝোঁকও ছিল তার। নাইমা খুবই হাসিখুশি ও মা-বাবার বাধ্যগত ছিল। ভালো-মন্দের বোধ তার ছোটবেলা থেকেই বিকশিত হচ্ছিল। কোটা আন্দোলনকে সে শুরু থেকেই সমর্থন দিয়ে আসছিল। ২০২৪ সালে এসে সরাসরি সম্পৃক্ত হয়।
নাইমার মা বলেন, আমার কাছে সে বারবার অনুমতি চাইত রাজপথে নামবার জন্য। কিন্তু আমি আন্দোলনকারীদের সমর্থক হয়েও তাকে আন্দোলনে যেতে দেইনি। হাসিনার বাহিনীর গুলির ভয়ে। সে তারপরও ঘরে বসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে প্রতিবাদ জানিয়েছে। উত্তরায় ৬ নম্বর সেক্টরে ডিমার্স নামে একটা কোচিং সেন্টার আছে। সেখানে আন্দোলনকারীদের জন্য শুকনা খাবারসহ প্রাথমিক চিকিৎসার ওষুধ ছিল। সেটিও ফেসবুকের মাধ্যমে বিভিন্ন গ্রুপে শেয়ার করত নাইমা।
বিজ্ঞাপন
মা আইনুন্নাহার বেগমের আক্ষেপ- ‘কী লাভ হলো, তাকে ঘরে আটকিয়ে। শেষ রক্ষা কি হলো! ওই স্বৈরাচার সরকার শিশুর নিরাপত্তাও দিলো না।’
নাইমার শহীদ হওয়ার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, উত্তরায় ১৯ জুলাই শুক্রবার যখন আন্দোলন শুরু হয়, বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে নাইমা বসে চিত্র অঙ্কন করছিল। এসময় উঠে সে বলছিল, মা ফ্রিজে চিকেন আছে? আমি বলি- হ্যাঁ আছে। সে বলে পিজ্জা বানাবো। সে ফ্রিজটা বন্ধ করে বারান্দার কাপড়গুলো আনতে গিয়েছিল। সে বারান্দায় গিয়ে দেখে শিক্ষার্থী ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ চলছে। ছাত্ররা আমাদের বাসার নিচে অবস্থান নিয়েছে। দুই তিন মিনিটও হয়নি নাইমার বারান্দায় দাঁড়ানোর। হঠাৎ নাইমা মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে। তার মাথায় ডান দিক থেকে গুলিটা করে।
আইনুন্নাহার বলেন, তখন ছাত্ররা দেখতে পায় নাইমাকে গুলি করেছে। তারা আমার বাসার দিকে আসে। আমি আমার মেয়েকে জড়িয়ে ধরে দেখতে পাই, তার মাথা দিয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। আমি তখনও বুঝিনি নাইমার মাথায় গুলি লেগেছে। পরক্ষণেই টের পাই তার মাথার মগজ আমার হাতে! আমি চিৎকার দিয়ে তাকে ডাকি। কিন্তু সে আর কথা বলতে পারে না।
আইনুন্নাহার বেগম বলেন, ‘পরে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সহযোগিতায় আমরা নাইমাকে মেডিকেলে নিয়ে যাই। আমার একটা আশা ছিল, এত খারাপ পরিস্থিতির মাঝেও আমার মেয়েটা আইসিইউ পেয়েছে। মেয়েটা বেঁচে যাবে। কিন্তু দেড় ঘণ্টা পরে ডাক্তার জানান নাইমা আর নেই!’
নাইমার মা আরও বলেন, ‘আদরের মেয়েটাকে হারিয়ে আমি মানসিকভাবে এখনো ট্রমাগ্রস্ত। এখন পর্যন্ত আমি রান্না করতে পারি না। বাসায় ইফতারিটাও বানাতে পারি না। রোজা থাকতে হবে বলে, দু মুঠো ভাত জোর করে পানি দিয়ে গিলে গিলে খাই। এখন আমি মগবাজারের একটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছি। আমার দুই বাচ্চাও ট্রমায় আছে। পুরো পরিবার এখনো চিকিৎসা নিচ্ছি। ছোট ছেলেটা এখনও ঘুমের ঘোরে বলে- মা গুলির আওয়াজ আসছে। কোথাও একটু শব্দ হলে ‘গুলি আসছে, গুলি আসছে’ বলে চিৎকার দিয়ে ওঠে। আমার ছেলেটার বয়স এখন সাড়ে ৮ বছর।
আশাহতের বার্তা আইনুন্নাহারের
মেয়ের আত্মত্যাগে সুন্দর বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখা মা আইনুন্নাহার বেগম অনেকটা আশাহত। সমন্বয়ক, সরকার ও উপদেষ্টাদের প্রতি তার যে প্রত্যাশা ছিল, তা বাস্তবায়ন দেখেছেন সামান্যই। একারণে মনের গহীনে জমেছে অভিমানও। সে কথাই বলছিলেন তিনি।
আইনুন্নাহার বলেন, ‘এ বছরের জানুয়ারিতে আমাকে ফোন দিয়ে বলেছিল, উপদেষ্টা নাহিদ আমার বাসায় আসবে। কিন্তু এখনও কেউ আসেনি। আমরা অপেক্ষায় আছি। সারজিস বলেছিল, আন্টি যাবো আমি, আপনাদের বাসায়। নাইমা কোথায় শহীদ হয়েছিল, সেটা দেখবো। এতটুকুই!’
নাইমার মা বলেন, ‘আমি তো বিচারের কিছুই দেখছি না এখন। যারা শুরু থেকে মামলা করেছে, তাদেরও জিজ্ঞাসা করি, তারাও বলে এখনও কিছুই হচ্ছে না। তবে আমি আশা করি, যেহেতু আমার মেয়ের বারান্দায় গুলি করার ভিডিও, ঘাতক পুলিশের ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, বিচার হয়তো পাবো। বিচার তাদের হবেই। তাদের এই আত্মত্যাগ দেশের মানুষের জন্য কল্যাণ বয়ে আনুক, এই প্রত্যাশাই করি। বর্তমান ও ভবিষ্যতে যে সরকারই আসুক, আমি বৈষম্যহীন সুন্দর একটি বাংলাদেশ চাই। আর যাতে কোনো মায়ের বুক খালি না হয়। আর যারা আমাদের বুকের সন্তানকে এভাবে হত্যা করেছে, তাদের কঠিন থেকে কঠিন শাস্তি চাই।
ট্রমা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টায় পরিবারটি
চোখের সামনে মেয়ের মর্মান্তিক মৃত্যু দেখে মানসিকভাবে এখনো বিপর্যস্ত মা আইনুন্নাহার বেগম। শুধু তিনি নন, তার পুরো পরিবারেরই একই অবস্থা।
আইনুন্নাহার বলেন, ‘আমার মেয়ে আমার চোখের সামনে। তার রক্ত-মগজ আমার হাতে। চোখের সামনে এটা হওয়ার পর কীভাবে মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে পারি! অবশ্যই এটা সরকারের কাছে গেছে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে কেউ মানসিকভাবে সাহায্য করেনি। জামায়াত আমাদের খোঁজখবর নিয়েছে। তাদের সহযোগিতায় ইবনে সিনায় আমি পাঁচ মাস ফ্রি চিকিৎসা পেয়েছি। এখন ছাত্রদলের একটি সংস্থা থেকে আরেকজন ডাক্তারের কাছে দেখাচ্ছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি দুই বেলা টেনশনের ওষুধ এবং ঘুমের ওষুধ খেতাম। এরপরেও আমার ঘুম হতো না। যে দুই ঘণ্টা ঘুমাই, সেখানেও মেয়ের সেই দিনের চিত্রই দেখি। আমি ঘুমের ঘোরে কান্না করি। আরও অস্বাভাবিক কিছু করি। এটা আমার সঙ্গে যারা ঘুমায় তারা বুঝতে পারে। আমি কিছু বুঝতে পারি না।’
আইনুন্নাহার বলেন, ‘আমার হাসবেন্ডের হার্টের সমস্যা। তাকে ল্যাবএইডে দেখাই। এখানে দেখাতে হলে দুই মাস আগে সিরিয়াল দেওয়া লাগে। এর আগে সিরিয়াল দিয়েছিলাম। দুই মাস অনেক লম্বা সময় তো। আমিও শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ। একারণে সিরিয়াল ভুলে গিয়েছিলাম। আবার সিরিয়াল দিয়েছি। দুই মাস পরে হয়তো ডাক্তারের দেখা পাবো। আমার স্বামীকে তিন মাস পরপর ডাক্তার চেকাপ করাতে হয়। করোনার পর থেকে তার হার্টের সমস্যা দেখা দেয়। মেয়ের মৃত্যুর পর সেটা বেড়ে গেছে।’
নাইমার মা বলেন, ‘বর্তমান সরকারের আমাদের খোঁজখবর নেওয়া উচিত। আমাদের কীভাবে দিন যায়, রাত যায় তা দেখা উচিত। আমার মেয়েতো বাসাতেই ছিল। তারপরও কেন নিরাপদে থাকলো না। আমাদের জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা এবং চীন মৈত্রী সম্মেলনে ৫০ হাজার টাকা দিয়ে সহায়তা দিয়েছে। কিন্তু ট্রমা থেকে বের হওয়ার জন্য সরকার কিছু করেনি।’
শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ট্রমা থেকে বের হওয়ার জন্য শুধু জামায়াত কাজ করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তারা এটা না করলে আমি ও আমার সন্তানরা এই ট্রমা থেকে বের হতে পারতাম না। উনারা প্রতিটি সপ্তাহে সপ্তাহে আমাকে ফোন করতো। খোঁজখবর নিতো। প্রোগ্রামগুলোতে বাচ্চাদেরসহ নিয়ে যেতো। মেয়ে হারানোর পরে একা কোথাও যেতে পারি না। আমাকে নিয়ে আসতে হয়। আমার অনেক দাওয়াত পড়ে। কিন্তু আমি যেতে পারি না। মানসিক অসুস্থতার কারণে। জামায়াত আমাকে সবদিক দিয়ে সহযোগিতা করেছে। পরামর্শ দিয়েছে। বুঝিয়েছে। এগুলো আল্লাহর পরিকল্পনা, এভাবেই হয়তো তার মৃত্যু লেখা ছিল। নাইমা এভাবে শহীদ হয়েছে। আর শহীদের মর্যাদা কে না চায়। নাইমার ভালো মৃত্যু হয়েছে। আপনি মা তার জন্য দোয়া করবেন। এভাবে আমার বাসায় কয়েকবার এসে বুঝিয়েছে। ফোনে নিয়মিত যোগাযোগ করে। তাদের প্রোগ্রামে গেলে মানসিক একটু শান্তিও পাই।’
মৃত্যুর আগে নাইমার রহস্যময় তিন স্বপ্ন
শহীদ নাইমা মৃত্যুর আগে তিনটি রহস্যময় স্বপ্ন দেখেছিলেন। যে স্বপ্নের কথা নিজ হাতে নিজের ডায়রিতে লিখেছেন। শেয়ার করে গেছেন মায়ের কাছেও। সে স্বপ্নের স্মৃতিই আওড়াচ্ছিলেন মা আইনুন্নাহার বেগম।
তিনি বলেন, মৃত্যুর দুই মাস আগে নাইমা একটা স্বপ্ন দেখেছিল। মৃত্যুর কয়েক দিন আগেও একই স্বপ্ন দেখেছিল। হাসতে হাসতে এসে মেয়েটা বলছে, মা আমি একটা স্বপ্ন দেখেছি। আমি বললাম কী স্বপ্ন মা। মেয়েটা বলছে, মা, আমি দাদুর সঙ্গে কাবা শরিফে গেছি। সেখানে কাবা শরিফের সামনে আমি আর দাদু নামাজ পড়ছি।
আরেকবার স্বপ্ন দেখে, লম্বা পাঞ্জাবি পরা অদ্ভুত এক লোক তার কাছে আসে। সেই লোক যে দিকে যায়, সেদিক আলোকিত হয়ে যায়। নাইমা বলে, আমি দেখি, তিনি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আবার আমার থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন।
আইনুন্নাহার বলেন, ও আরেকটা স্বপ্ন দেখেছে। ও মারা গেছে। মারা যাওয়ার পরে সামনে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। ও লাফ দিয়ে ওপারে গিয়ে দেখে সেটা জান্নাত। এটা দেখে সে খুশি। অনেক খুশি। এগুলো নাইমার ডাইরিতে তারিখ দিয়ে লেখা আছে। যে ডাইরিটা বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে প্রদর্শনী করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে ঢাকায় গুলিতে নিহত শিক্ষার্থী নাইমা সুলতানার (১৫) বাড়ি চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার আমুয়াকান্দা গ্রামে। তার বাবার ব্যবসা রয়েছে। মা গৃহীনি। তার বাবার নাম গোলাম মোস্তফা। দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে সে মেজ। তার বড় বোন তাসফিয়া সুলতানা ঢাকার মাইলস্টোন কলেজে একাদশ শ্রেণিতে পড়ে। ছোট ভাই আবদুর রহমান ঢাকার উত্তরা এলাকায় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে। আইনুন্নাহার বেগম তিন ছেলে-মেয়েকে নিয়ে ঢাকার উত্তরার ৫ নম্বর সড়কের একটি ভাড়া বাসায় থাকেন।
এমআই/জেবি