রাজধানীবাসীর এক ভয়াবহ যন্ত্রণার নাম মশা। প্রতি বছরই কমবেশি এই যন্ত্রণায় ভুগতে হয় নগরবাসীকে। তবে এবার মশার উপদ্রব অন্যবারের তুলনায় একটু বেশিই বলে মনে করছেন ভুক্তভোগীরা। চলতি রমজান মাসে যেন মশার উৎপাত আরও বেড়ে গেছে। বিকেল হতেই শুরু হয় মশার জ্বালা। এতে স্বস্তিতে ইফতারও করতে পারছেন না নগরবাসী। বাসাবাড়ি, দোকানপাট, স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত সর্বত্রই মশার উপদ্রব। মশা নিয়ন্ত্রণে দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রমও নজরে আসেনি নগরবাসীর।
মঙ্গলবার (৪ মার্চ) ধানমন্ডির ট্যানারি মোড়ে গৃহিণী সুমাইয়া আক্তারের সঙ্গে কথা হয় মশা নিয়ে। তিনি ঢাকা মেইলকে বলছিলেন, ‘ঢাকা শহরে দশ বছর ধরে বসবাস করছি। এবারের মতো এত মশা আর দেখিনি। আমরা পাঁচ তলায় থাকি। বিকেল হওয়া মাত্র দরজা-জানালা বন্ধ করতে হয়। একটু ফাঁকা থাকলে পুরো ঘর মশায় ভরে যায়। ঠিক মতো কাজ করা যায় না। ইফতার তৈরির সময় রান্না ঘরের জানালা সামান্য পরিমাণ খুললেও মশার উৎপাতে থাকা যায় না। মশার কারণে স্বস্তিতে ইফতারও করতে পারছি না।’
বিজ্ঞাপন
ঝিগাতলার সারোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমি ছাত্র। এক বন্ধুকে নিয়ে একটি রুমে থাকি। দিনের বেলা মশা একটু কম থাকলেও বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মশায় ভরে যায় পুরো রুম। কয়েল বা মশা তাড়ানো স্প্রে দিয়েও কাজ হয় না। সিটি করপোরেশন থেকে মশা নিয়ন্ত্রণে দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রমও আমাদের নজরে আসে না। শুনেছি এ বছর নাকি মশা নিয়ন্ত্রণে অর্ধশত কোটি টাকার বেশি খরচ হয়েছ। তাহলে মশা নিয়ন্ত্রণ কেন হচ্ছে না, এটা আমার খুবই জানতে ইচ্ছে করে।’
আগারগাঁওয়ে শিউলী নামে এক গৃহিণী বলেন, ‘আমরা থাকি সাততলায়। সেখানেও কী পরিমাণ মশা সেটা নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। আমি নিজেই অবাক হচ্ছি, এত উঁচুতে এত মশা এলো কীভাবে!’
নির্বাচন ভবনের সামনে অবস্থিত আগারগাঁও বস্তি। সেখানকার চা দোকানি রফিক অস্বস্তি নিয়েই বলেন, ‘এখানে বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে বসবাস করাই দায়। একদিকে গরম অন্যদিকে টিনের চাল, তার ওপর মশার জ্বালা। আমরা গরিব মানুষ, কই যাবো ভাই, আপনে বলেন।’
বিজ্ঞাপন
সরেজমিনে বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সিটি করপোরেশন থেকে ঠিকমতো মশা নিয়ন্ত্রণে ওষুধ দেওয়া হয় না। গত দুই মাসে তারা মশা নিয়ন্ত্রণের কোনো কার্যক্রম লক্ষ্য করেনি। ড্রেন পরিষ্কার করা হয় না। আশপাশে কিছু পরিত্যক্ত জঙ্গল রয়েছে, সেখানেও মশা নিধন করতে কোনো প্রকার ওষুধ দেওয়া হয় না।’
এলাকাবাসী বলছেন, সামনে বর্ষা মৌসুমে মশার উৎপাত আরও বাড়বে। এতে এবারও ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। এজন্য আগেভাগেই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে তারা সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
জানা যায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ঢাকা উত্তর সিটিতে প্রস্তাবিত বাজেটে মশা নিধনের ব্যয় বাড়িয়ে ধরা হয়েছে ১১১ কোটি টাকা। মশার নিধনে প্রায় সমান অর্থ ব্যয় করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনও। মশার পেছনে দুই সিটি করপোরেশনের এত বিশাল ব্যয় সত্ত্বেও সুফল পাচ্ছে না নগরবাসী।
আগে শহরের মশক নিধন কার্যক্রম স্থানীয় জনপ্রতিনিধি দেখভাল করতেন। গত ৫ আগস্টের পর সেই দায়িত্ব এসেছে একজন কর্মকর্তার ওপর। দুর্বল মনিটরিংয়ের সুযোগে অনেকটা গা-ছাড়া ভাব দেখা গেছে মাঠপর্যায়ের কর্মীদের মধ্যেও।
জানা যায়, সিটি করপোরেশন এলাকায় জনপ্রতিনিধি মশকনিধন কার্যক্রমের তদারকি ছাড়াও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজটি মনিটরিং করতেন। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর কাউন্সিলরদের প্রায় সবাই আত্মগোপনে চলে গেছেন। বর্তমানে কয়েকটি ওয়ার্ডের সার্বিক কার্যক্রম দেখভাল করেন প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা। এ কর্মকর্তার পক্ষে প্রশাসনিক কার্যক্রম শেষে মাঠপর্যায়ে গিয়ে মশকনিধন কার্যক্রম দেখভালের খুব একটা সুযোগ নেই। ফলে মশকনিধনে যে স্বল্পসংখ্যক কর্মী মাঠে কাজ করেন, তাদের মধ্যেও গা-ছাড়া ভাব চলে এসেছে।
ডেঙ্গুবিষয়ক কার্যক্রমের বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, তারা ডেঙ্গুবিষয়ক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে কৌশলগত পরিকল্পনা বা অপারেশনাল প্ল্যানের (ওপি) মাধ্যমে। তবে গত জুলাই থেকে ওপি চালু না থাকার কারণে কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা গেছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) ডা. ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘সার্ভে থেকে শুরু করে সব কাজ করা হয় ওপির টাকায়। বর্তমানে ওপি চালু না থাকার কারণে ডেঙ্গুবিষয়ক কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। সার্ভের কাজটি করছে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)। ওপি না থাকলে কীভাবে কার্যক্রম চলবে সে বিষয়ে আগামী ৩১ মার্চের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের কাছে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।’
এমএইচএইচ/জেবি

