রাজধানী ঢাকাকে বলা হয় তিলোত্তমা নগরী। আর এই তিলোত্তমা নগরীর প্রাণ এখানকার জলাধারগুলো। কিন্তু দূষণের ছোবল এখন এতটাই বেড়েছে যে, হাতিরঝিলের মতো বিশাল জলাধারের ধারেও মশার প্রজনন হচ্ছে। বাসা-বাড়ির আনাচে-কানাচে ও ড্রেনের মশক নিধনে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন বছরে প্রায় ২০০ কোটি টাকা খরচ করে। এরপরও মশার প্রজনন রুখতে নাকানি-চুবানি খেতে দেখা যায় কর্তৃপক্ষকে। এতে এসব জলাধারকে কেন্দ্র করে মশার প্রজননস্থল ধ্বংসে এক রকম উদাসীন কর্তৃপক্ষ— এমনটাই বলছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) সূত্রে জানা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মশকনিধন কার্যক্রমের জন্য তারা ব্যয় করেছে প্রায় ৮৭ কোটি টাকা। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রস্তাবিত বাজেটে বাড়িয়ে ধরা হয়েছে ১১১ কোটি টাকা। তবে এত বিশাল বাজেটের মশক নিধনের মহড়াতেও নাগরিকদের মধ্যে স্বস্তির বার্তা নেই।
বিজ্ঞাপন
সরেজমিনে রাজধানীর কারওয়ান বাজার, বাংলামোটর, ফার্মগেট, শাহবাগ, মগবাজার, শ্যামলী, মিরপুর, বাড্ডা, ধানমন্ডি, রামপুরা, মতিঝিলসহ দুই সিটি করপোরেশনের গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলো ঘুরে দেখা যায়, বিশেষায়িত আবাসিক এলাকাগুলোতে মশার উপদ্রব কম। কিন্তু অন্য এলাকাগুলোতে সন্ধ্যার পর বসে থাকা দায় হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে মগবাজার, কারওয়ান বাজারের পাশের হাতিরঝিল এলাকাগুলোতে মশার উপদ্রব সবচেয়ে বেশি। কারণ হাতিরঝিলের দুর্গন্ধযুক্ত পচা পানিতেও মশার প্রজনন ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। এতে নাগরিকরা ক্ষোভ প্রকাশ করলেও সমাধানের প্রশ্নে কর্তৃপক্ষ তুলে ধরছেন সংকটের চিত্র!
নগরবাসীর অভিযোগ, কিউলেক্স মশার উপদ্রবে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন তারা। মশা নিধনে দৃশ্যমান যে কার্যক্রম তা এখন আর দেখা যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে ফগার মেশিনের ধোঁয়া দিতে দেখা গেলেও মশার উপদ্রব কমছে না। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মশার ওষুধের মান নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন নগরবাসী।
তারা বলছেন, সিটি করপোরেশনের লোকজন আদৌ ওষুধ স্প্রে করে নাকি শুধু ধোঁয়া দিয়েই দায় সারছে এটা বোধগম্য হচ্ছে না। কেননা মশার যে উৎপাত সেটা গত কয়েক মাসে বেড়েছে। এতে দিন-রাত বাসাবাড়িতে মশায় কামড়ায়। সারারাত মশারি ব্যবহার করার পরেও কয়েল জ্বালিয়ে রাখতে হচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
রাজধানীর বাংলামোটর এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ আকাশ ঢাকা মেইলকে বলেন, আগে তাও সপ্তাহে একদিন হলেও মশার ওষুধ ছিটাতে দেখতাম। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যে ওষুধ ছিটাতে দেখিনি। মশার উপদ্রব আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। সন্ধ্যার পর মশারি না টাঙিয়ে ঘরে বসে থাকা যায় না।
মগবাজার এলাকার বাসিন্দা মো. রাসেল ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, শুধু মশার অত্যাচারের কারণে সন্ধ্যার পর হাতিরঝিলের পাশে যেতে ভালো লাগে না। রুমেও আগে এত মশা ছিল। কিন্তু কয়েক মাস থেকে এই অত্যাচার কয়েক গুণ বেড়েছে। দুই সপ্তাহ আগে একবার ধোঁয়া দিতে দেখেছি। এরপর আর দেখিনি।
বাড্ডার আরেক বাসিন্দা নিশাত হোসেন বলেন, এই এলাকায় আগে এত মশার উপদ্রব ছিল না। মশারি ব্যবহার না করেই ঘুমানো যেত। কিন্তু এখন মশারি ছাড়া ঘুমানোর উপায় নেই।
তবে এসব অভিযোগ পাশ কাটিয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) দাবি, মশা নিধনে তারা প্রতিদিনই ওষুধ ছিটাচ্ছেন। আর দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) দাবি, তারা তিন দিন পরপর নিয়মিতই ওষুধ ছিটাচ্ছেন।
যদিও সিটি করপোরেশনের একাধিক সূত্র জানায়, ডেঙ্গুর মৌসুম শুধু হয়, এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ থেকে। এবার সবার ফোকাস এপ্রিলের দিকে। একারণে জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চে মশক নিধন কর্মসূচিতে ভাটা পড়েছে। একারণে কিউলেক্স মশার উপদ্রব বেড়েছে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (অতিরিক্ত সচিব) আবু সাঈদ মো. কামরুজ্জামান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘ঢাকা শহর অপরিকল্পিতভাবে দিন দিন যেভাবে স্ট্যান্ড করছে, সেভাবে তো আমাদের সিটি করপোরেশনের লোকবল বাড়ে না। এমন অনেক সমস্যায় আছে। তবে এটা ব্যাখ্যা না। ব্যাখ্যা হলো যে, আমরা চেষ্টা করছি। ডেঙ্গুর মৌসুমে আমরা স্পেশালি প্ল্যান করছি। আমার ধারণা, আগের চেয়ে কিছুটা হলেও পরিস্থিতি ভালো হয়েছে।’
দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. মো. জিল্লুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘বিশেষজ্ঞদের মতামত হলো, কিউলেক্স মশার নিধনে প্রতিদিন স্প্রে করলে মানুষের স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। একারণে আমরা তিন দিন পরপর ওষুধ ছিটাচ্ছি। যদিও দেখা যাচ্ছে, ওষুধ দেওয়ার পরের দিনেই আবার মশায় ভরে যাচ্ছে। একারণে আমাদের নিজেদেরও সচেতন থাকতে হবে। এছাড়া ডেঙ্গু দমনে আমরা প্রতিদিনই লার্ভিসাইড স্প্রে করছি।’ এসময় তিনিও জনবল সংকটের চিত্র তুলে ধরেন।
এমআই/জেবি