শুক্রবার, ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, ঢাকা

‘আন্দোলনের নগরীতে’ ছয় মাসে ১৩৬ আন্দোলন!

বোরহান উদ্দিন
প্রকাশিত: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১০:৩৩ এএম

শেয়ার করুন:

‘আন্দোলনের নগরীতে’ ছয় মাসে ১৩৬ আন্দোলন!
সরকার নমনীয় হওয়ায় বাড়ছে আন্দোলনের মাত্রা। ছবি: ঢাকা মেইল

আনসার থেকে পুলিশ বাহিনী, অটোরিকশা চালক থেকে রেলশ্রমিক। কখনো আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বনাম সাত কলেজ, প্রশাসনের কর্মকর্তাদের পাশাপাশি বিডিআর জোয়ানরা মাঠ কাঁপাচ্ছেন। আবার তিতুমীরের শিক্ষার্থীদের কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হওয়ার আকুতি নিয়ে অনশন, অবরোধ। কখনো আবার জাতীয়করণের দাবিতে শিক্ষকদের কর্মসূচি। বাদ যায়নি শেখ হাসিনার পতনের দাবিতে জীবন বাজি রেখে আহত নানা শ্রেণি-পেশার মানুষও। সবার দুঃখ, কষ্ট আর ক্ষোভের চাপে অনেকটা তপ্ত হয়ে উঠেছে রাজধানী ঢাকার রাজপথ। কোটি মানুষের বসবাসের এই নগরীতে কেউ জানেন না কখন, কোথায় রাস্তা দখল করে বসে পড়বেন আন্দোলনকারীরা। ফলে প্রতিদিনই কোনো না কোনো বিক্ষুব্ধ মানুষের কর্মসূচিতে ভোগান্তি পোহাতে হয় আমজনতাকে।

এসব কর্মসূচি যারা পালন করেন তারা অনেকে চিন্তাও করেন না তাদের দাবি কতটা যৌক্তিক। শুধু তাই নয়, কর্মব্যস্ত নগরীর রাস্তা বন্ধ করে দাবির পসরা সাজিয়ে বসা মানুষদের যেন ভোগান্তির কথা চিন্তা করার সময় নেই! যে কারণে কেউ না কেউ আন্দোলনের ঝাঁপি খুলে বসে পড়ছেন ঢাকার রাস্তায়। কিছু কিছু কর্মসূচির উত্তাপ দেশজুড়েও ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে রাজধানীর বাইরে মানুষেরও ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হচ্ছে। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা তো আছেই।


বিজ্ঞাপন


শেখ হাসিনার সরকারের চার মেয়াদে নিজেরা বৈষম্য, নিপীড়িত  ও বঞ্চনার শিকার হয়েছেন এমন দাবি নিয়ে মাঠে নামছেন এসব মানুষ। এসব করতে গিয়ে সরকারি চাকরিবিধিও লঙ্ঘন করছেন অনেকে।

Titumir
তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের দাবিতে আন্দোলন। ছবি: সংগৃহীত

শেখ হাসিনার সরকার যেকোনো আন্দোলন কঠোরহস্তে দমন করলেও নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার নমনীয় হওয়ার কারণে তাদের গত ছয় মাসে কম হলেও ১৩৬টি আন্দোলন মোকাবিলা করতে হয়েছে।


বিজ্ঞাপন


আরও পড়ুন

দাবির ভারে ন্যুব্জ ঢাকা, শঙ্কা নিরাপত্তা নিয়ে

যদিও দায়িত্ব নেওয়ার পর বেপরোয়া আন্দোলনকারীদের ঠেকাতে গত আগস্টে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ও জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সচিবালয় ও প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনার আশপাশে এই ধরনের কর্মসূচি নিষিদ্ধ করে গণবিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই নির্দেশনা দেওয়ার পরও একাধিকবার তা লঙ্ঘন করেছেন আন্দোলনকারীরা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকেও এদের বিষয়ে কঠোর অবস্থান নিতে দেখা যায়নি।

7coolage
সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। ছবি: সংগৃহীত

এদিকে ব্যস্ত এই নগরীতে দাবি আদায়ের জন্য এমন ভোগান্তি সৃষ্টি করার  সুযোগ দেওয়ায় প্রশ্ন তুলছেন কেউ কেউ। অন্যদিকে নগর পরিকল্পনাবিদ, সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, আন্দোলনকারীদের দাবি যৌক্তিক না অযৌক্তিক তা সবার আগে দেখতে হবে। পাশাপাশি সাধারণ মানুষের ভোগান্তির কথাও চিন্তা করতে হবে। আলোচনায় ফল না এলে প্রয়োজনে সরকারকে হার্ডলাইনে যেতে হবে।

আরও পড়ুন

আন্দোলনকারী কর্মকর্তাদের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কঠোর বার্তা

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘এই সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর আন্দোলন করলেই কিছু দাবি পূরণ করে ফেলার কারণে মূলত সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু অন্তবর্তীকালীন সরকার দাবি দাওয়া পূরণের সরকার নয়- এই ম্যাসেজ দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এই সুযোগে আন্দোলনের নামে নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী গ্রুপও মাঠে নেমে এসেছে। সরকারের উচিত ছিল শুরুতেই তাদের অবস্থান শক্তভাবে জানিয়ে দেওয়া।’

Ibtedai
ইবতেদায়ি মাদরাসা শিক্ষকদের ওপর পুলিশের লাঠিচার্জ। ছবি: সংগৃহীত

আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘সরকারকে এখন স্পষ্ট করতে হবে দাবি যৌক্তিক হলে নিয়ম মেনে চেষ্টা করতে হবে। আর অযৌক্তিক হলে তা কোনোভাবেই মানা যাবে না। প্রয়োজনে রাষ্ট্রীয় আইন প্রয়োগ করতে হবে। আর জনগণকেও বুঝতে হবে, মানুষের ভোগান্তির কথা চিন্তা করতে হবে। অন্তবর্তী সরকারের কাজ দাবি পূরণ নয়, এটা আন্দোলনকারীদের সবার আগে বুঝতে হবে।’

আনসার বিদ্রোহ থেকে তিতুমীরের বিশ্ববিদ্যালয়ের আকুতি

সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর শুরুর দিকে গত আগস্টে আনসার বাহিনীর সদস্যরা চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে দিনভর সচিবালয় ঘেরাও করে রাখে। রাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন বাহিনীর সদস্যরা। যা নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। তবে ওই ঘটনার পর বিদ্রোহে জড়িত আনসারদের বিরুদ্ধে বাহিনীর পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। বিপুলসংখ্যক আনসার সদস্য চাকরি হারিয়েছেন।

আরও পড়ুন 

‘রন্ধ্রে রন্ধ্রে সুশীলতা দিনশেষে আমাদের কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে’

Joonnath
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের সচিবালয় ঘেরাও। ছবি: সংগৃহীত

ওই মাসেই চাকরিচ্যুত পুলিশ সদস্যরা আন্দোলন শুরু করেন ঢাকায়। প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনেও অবস্থান কর্মসূচি পালন করে তারা। পরে পুলিশ সদর দফতরের আশ্বাসে গত বছরের আগস্টের ১৮ তারিখে তারা আন্দোলন স্থগিতও করেছিলেন। সম্প্রতি তারা আবারও আন্দোলন করছেন। দাবি করছেন, পুলিশ সদর দফতর তাদের মিথ্যা আশ্বাস দিয়েছিল। তাই আবারও দাবি আদায়ের জন্য মাঠে নেমেছেন।

আগস্ট মাসে নানা যুক্তি তুলে ধরে এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা বাতিলের দাবিতে সচিবালয়ে ঢুকে পড়েছিলেন হাজারো শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ওই সময় চলা এইচএসসি ও সমমানের বেশ কিছু পরীক্ষা বাতিল করে ‘অটো পাসের’ দাবি মেনে নেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। যা নিয়ে তীব্র সমালোচনার মুখেও পড়তে হয়েছে।

আরও পড়ুন

তিতুমীরের আন্দোলনে যেসব বিষয়ে সমঝোতা হলো

এরমধ্যে ছোটখাটো আন্দোলন-কর্মসূচি ঢাকার রাজপথে চলতে থাকে। কখনো ইন্টার্ন চিকিৎসকদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলন, কখনো আবার বিএনপি-জামায়াতপন্থী চিকিৎসকদের আন্দোলনের হুঙ্কারও শুনেছে নগরবাসী।

Julay
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহতদের আন্দোলন। ছবি: সংগৃহীত

চলতি বছরে এসে বেশি ভোগান্তির সৃষ্টি হয়েছে সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত বাতিলের দাবিতে আন্দোলন। এ নিয়ে পুরো মুখোমুখি অবস্থানে চলে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সাতকলেজের শিক্ষার্থীরা। অবশ্য ইতোমধ্যে দুই পক্ষ আলোচনায় বসে অধিভুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় কিছুটা শান্ত হয় পরিস্থিতি।

তবে সাত কলেজের আন্দোলনের সমাধান শেষে মানুষ যখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে যাচ্ছিলেন তখনই  বিশ্ববিদ্যালয়ের আবদার নিয়ে কঠোর আন্দোলনে নামেন তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা। শুরুতে কিছুটা নরম কর্মসূচি দিলেও সবশেষ তারা রেল-সড়ক অবরোধের কর্মসূচি পালন করেন। করছেন আমরণ অনশনও। এতে করে নগরবাসীকে চরম ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হয়েছে। কিন্তু একটা কলেজকে হঠাৎ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করার যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত তা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে এই আন্দোলনে যারা আছেন তাদের অধিকাংশ শিক্ষার্থী নন।

আরও পড়ুন

রাজধানীজুড়ে বিশৃঙ্খলার নেপথ্যে কারা?

যদিও দিনের পর দিন মানুষকে ভোগান্তি দিয়ে সরকারের আশ্বাসে সোমবার (৩ ফেব্রুয়ারি) আন্দোলন প্রত্যাহার করেছেন শিক্ষার্থীরা। জানা গেছে, আগামী সাত দিনের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় রূপান্তরের ইস্যুতে পদক্ষেপ নেওয়া হবে- এমন আশ্বাসে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন প্রত্যাহার করেছেন।

Anser
আনসার সদস্যদের আন্দোলন। ছবি: সংগৃহীত

এদিকে মাঝে রেল শ্রমিকরা বিভিন্ন দাবি নিয়ে রেল চলাচল বন্ধের মতো কঠোর কর্মসূচি পালন করেছেন। যদিও চাকরিতে থেকে এমন কর্মসূচি পালন কতটা বিধিসম্মত তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

অন্যদিকে শুধু তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা নন, শনিবার থেকে রাজধানীর শ্যামলী এলাকায় মিরপুর সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহতরা। তাদের দাবি- ভালো চিকিৎসা, স্থায়ী পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ।

আরও পড়ুন

ঢাকায় ১২ লাখ অটোরিকশা: বন্ধ করা কতটা সম্ভব?

দিনভর ভোগান্তির পর সুচিকিৎসা, পুনর্বাসন ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবি নিয়ে রোববার রাতে তারা প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দেখা করতে যমুনার সামনে যেতে চাইলে শাহবাগ আটকে দেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। পরে আহতরা সেখানেই অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকেন। পরে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে মধ্যরাতে রাজধানীর মিন্টো রোডে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে পৌঁছান জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিরা। তারা সেখানে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

RR
চাকরিচ্যুত পুলিশ সদস্যদের আন্দোলন। ছবি: সংগৃহীত

শহরজুড়ে দাবি-দাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল‍্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ শিক্ষাবিদ ড. তৌহিদুল হক ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘জনগণের ভোগান্তি সৃষ্টি করে যার যে দাবি আছে সেগুলো আদায় করছেন। কিন্তু তাদের দাবিটা সঠিক কি না, সেটি আগে বুঝতে হবে। সাধারণ মানুষের ভোগান্তির কথাও চিন্তা করতে হবে। সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করেই আন্দোলন বা অবরোধ করা উচিত।’

বিইউ/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর