জাতীয় নির্বাচনের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। ড. মোহাম্মদ ইউনূসের এমন বক্তব্যের পরে রাজনৈতিক অঙ্গনে স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চায় না বিএনপি। দলটির অভিমত, এ ধরনের সরকারের অধীনে স্থানীয় নির্বাচন হওয়ার নজির নেই। বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির আলোকে জনআকাঙ্ক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে এখন সরকারের উচিত জাতীয় নির্বাচনের দিকে ফোকাস করা।
জন্ম সনদ, মৃত্যু সনদ ও ট্রেড লাইসেন্সসহ নানা কাজে মানুষ স্থানীয় সরকারের ওপর নির্ভরশীল। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর স্থানীয় সরকারের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের অনুপস্থিতি ও পরে অপসারণ করার কারণে কার্যত তা অচল হয়ে পড়েছে। সাময়িকভাবে অধ্যাদেশ জারি করে এই দায়িত্ব সরকারি আমলাদের দেওয়া হলেও কাটছে না তাদের দুর্ভোগ।
বিজ্ঞাপন
জাতীয় নির্বাচনের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পরিকল্পনার তীব্র বিরোধিতা করেছে বিএনপি ও এর সমমনা দলগুলো। দলগুলো বলছে, সরকার যদি স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মতো বিষয় তুলে ধরে জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত করার চেষ্টা করে, তাহলে তারা দ্রুত জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে কর্মসূচি দেবে। সম্প্রতি সমমনা একাধিক দল ও জোটের সঙ্গে বৈঠক করেছে বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটি। বৈঠকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। বৈঠকে অংশ নেওয়া নেতারা বলেছেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আসলে ‘মূল বিষয় থেকে দৃষ্টি সরানোর চেষ্টা’।
বিজ্ঞাপন
জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সুপারিশ কমিশনের
পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজনের সুপারিশ করেছে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন। জাতীয় নির্বাচনের পাশাপাশি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার প্রস্তাব করেছেন তারা। বুধবার (১৫ জানুয়ারি) প্রধান উপদেষ্টার কাছে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন পুরো নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের নয় পৃষ্ঠার সুপারিশ জমা দেয়।
গত বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় নির্বাচন আগে হবে নাকি স্থানীয় সরকার নির্বাচন এমন প্রশ্নে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেন, আমরা আসলে প্রশাসক দিয়ে জনগণের কাছে সেবা পৌঁছাতে পারব কিনা; এ বিষয়ে আমাদের সংশয় তৈরি হয়েছে। যদি সিটি করপোরেশনের দিকে তাকান কিংবা স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের দিকে তাকান অনেক সরকারি সেবা জনগণ পাচ্ছে না। আমরা দেখছি যে প্রশাসক দিয়ে কীভাবে সামলানো যায়। এটা প্রধান উপদেষ্টা একটা প্রস্তাবনা হিসেবে বলেছেন, যদি স্থানীয় সরকার নির্বাচন হয়, তাহলে নাগরিকদের সেবা প্রাপ্তির সুযোগ তৈরি হবে। আমি মনে করি, এ বিষয়ে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে আমরা অগ্রসর হতে পারব।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পক্ষে জাতীয় নাগরিক কমিটি। সংগঠনটি মনে করে, স্থানীয় সরকার নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু করার মতো পরিস্থিতি এখনই আছে। আগামী দুই-তিন মাসের মধ্যে সরকার তা শুরু করে যুগপৎভাবে স্থানীয় সরকার ও জাতীয় নির্বাচন (প্রক্রিয়া) চালাতে পারে। রাজধানীর বাংলামোটরে জাতীয় নাগরিক কমিটির কার্যালয়ে গত শনিবার (১১ জানুয়ারি) আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জাতীয় নাগরিক কমিটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য আলাউদ্দিন মোহাম্মদ এ কথা বলেন।
জন্মনিবন্ধন সনদ, মৃত্যু সনদের মতো মৌলিক সেবাগুলো বাধাগ্রস্ত হচ্ছে উল্লেখ করে আলাউদ্দিন মোহাম্মদ বলেন, স্থানীয় সরকার কাঠামো একেবারেই ভেঙে পড়েছে। এ অবস্থায় এটি একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচনের প্রস্তুতি আছে বলে তারা দেখেছেন। জাতীয় নাগরিক কমিটিও মনে করে জাতীয় নির্বাচনের আগেই নতুন নির্বাচন কমিশন তার সক্ষমতার পরিচয় দেবে। স্থানীয় পর্যায়ে জনপ্রতিনিধিদের জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে আলাদা বিবেচনা করেই একটি শক্তিশালী স্থানীয় সরকার গঠন করার জন্যই নির্বাচন দরকার।
‘আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন নয়’
এদিকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে গত সোমবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা হয়। দলটির নেতারা জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সংসদ নির্বাচন চায় না বলে অভিমত দেন। তারা বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে স্থানীয় নির্বাচন হওয়ার নজির নেই। সরকারের উচিত জনআকাঙ্ক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে জাতীয় নির্বাচনের দিকে ফোকাস করা। সরকারকে কোনো চাপ কিংবা কোনো পক্ষ বা কারও স্বার্থকে প্রাধান্য না দিয়ে জনস্বার্থে দেশকে নির্বাচনমুখী করে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।
গত মঙ্গলবার গুলশানে সংবাদ সম্মেলন করে বিএনপি। সংবাদ সম্মেলনে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে স্থানীয় সংসদ নির্বাচনের কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কারণ এখন তো ফোকাসটা পুরো দেশের, জাতির হচ্ছে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ওপরে। সংকটটা ওই জায়গাতেই।
বিএনপি চেয়াপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারকে মানুষ বিশ্বাস করছে। তাই মানুষের বিশ্বাসের মর্যাদা দেওয়াই হচ্ছে এই সরকারের প্রধান কাজ। তাদের কাজ হচ্ছে প্রাথমিক সংস্কার করবে তারপর দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে। মানুষের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই স্থানীয় সরকারের সিদ্ধান্ত নেবে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সিদ্ধান্ত এই সরকারের নেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, আমরা পরিষ্কার করে বলেছি যে, আমাদের দলের স্ট্যান্ড হলো এই সরকার যে ওয়াদা করে আসছে জনগণের কাছে। অর্থাৎ জনগণের অধিকার, ভোটের অধিকার দেবে। এই ভোটের অধিকার দেওয়ার পরে প্রধান কাজ হচ্ছে জনগণ তাদের নিজস্ব সরকার প্রতিষ্ঠা করবে। সেই সরকার ঠিক করবে এরপরে কি হবে? তাই এই সরকারের দায়িত্ব স্থানীয় সরকার নির্বাচন না, এই সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে তাদের রিপ্লেসমেন্ট।
এমই/এফএ

