- ক্ষমতার পালাবদলে বিএনপির দখলে ক্লাবগুলো
- এখনো অনুমোদন মেলেনি ক্রীড়া অধিদফতরের
- বিএনপি-আওয়ামী লীগ ভাগাভাগির পরিকল্পনা
- নিজেদের টাকায় সংস্কার করছেন দখলকারীরা
রাজধানীর মতিঝিল ক্লাবপাড়া আবারো সচল হতে শুরু করেছে। ২০১৯ সালের শুরুর দিকে ক্যাসিনোকাণ্ডে ওই এলাকার ছয়টি ক্লাব একযোগে সিলগালা করে দেয় প্রশাসন। তখন থেকে বন্ধই ছিল ক্লাবগুলো। তবে গত ৫ আগস্ট ক্ষমতার পালাবদলের পর ক্লাবগুলো আবার সরব হয়ে উঠতে শুরু করেছে। এসব ক্লাব দখলে নিচ্ছেন স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মীরা। সঙ্গে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে আওয়ামী লীগের সংযোগও রয়েছে।
বিজ্ঞাপন
প্রায় ছয় বছর পর মতিঝিলের বন্ধ ক্লাবগুলো খুললেও এখনো পুরোপুরি চালু হয়নি। খোলা ক্লাবগুলোতে এখনো কোনো টুর্নামেন্ট বা খেলার আসর বসেনি। তবে চলছে আড্ডাবাজি ও নানা কার্যক্রম। এর আড়ালে রমরমা জুয়ার আসর চলছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ৭ আগস্ট মতিঝিলের ক্লাবপাড়ার ছয়টি ক্লাব দখলে নেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। তারা তালা ভেঙে ভেতরে ঢোকেন। ক্লাবগুলো এখন তাদেরই দখলে। তারা নিজেদের মতো কমিটিও গঠন করেছেন। যদিও সেসব কমিটি এখনো অনুমোদন দেয়নি ক্রীড়া অধিদফতর। তারপরও পুরোদমে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। নিজের টাকায় সংস্কারের অংশ হিসেবে নষ্ট ছাদ লাগানো, রঙ করা, দরজা-জানালা মেরামত, এসি লাগানোর কাজ সারতে শুরু করেছেন। এদের মধ্যে চারটিতে এখন রাত-দিন এসির মধ্যে জুয়ার আসর চলছে। তাতে অংশ নিচ্ছেন মতিঝিল ছাড়াও বিভিন্ন এলাকার লোকজন।
সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের সভাপতি করা হয়েছে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা আব্দুস সালামকে। আর সেক্রেটারি করা হয়েছে মাহবুবুর রহমান শাহীনকে। এছাড়া দিলকুশা ক্লাব দখলে নিয়েছেন সোহেল নামে এক বিএনপি নেতা। বাকি চার ক্লাবের কমিটিতে কারা আছেন জানা যায়নি। সেখানে উপস্থিত কেউ সেটা জানাতে পারেননি।
দিলকুশা, আরামবাগ, ভিক্টোরিয়া, মোহামেডান ও ফকিরাপুল স্পোর্টিং ক্লাবে এখন দিন-রাত বসছে জুয়ার আসর। ক্লাবগুলোর নির্দিষ্ট কিছু কক্ষে এসি লাগানো হয়েছে। সেই এসিতে বসে আরামে নিজেদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন জুয়ারিরা। কার্ড (জুয়া) ছাড়া কোনো খেলাধুলার দৃশ্য চোখে পড়েনি।
বিজ্ঞাপন
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় আরামবাগ ক্লাবে গিয়ে দেখা যায়, গেটে দুইজন বসে আছেন। ভেতরে ঢুকতে গেলে তাদের বাধার মুখে পড়তে হয়। কোনো রকম সেই বাধা কাটিয়ে ভেতরে ঢুকে দেখা গেল, প্রায় ২০ জনের মতো মানুষ গোল হয়ে কী যেন দেখছেন। কাছে গিয়ে দেখা গেল, একজন মেঝেতে বসে কার্ড খেলছেন এবং চালান দিচ্ছেন। বুঝতে বাকি রইল না এখানে জুয়ার এখন চলছে। একই অবস্থা চলছিল অন্য রুমগুলোতেও।
পরে সেখান থেকে বের হয়ে দিলকুশা ক্লাবে ঢুকে দেখা গেল, একটি কক্ষে সংস্কারের কাজ চলছে। পাশে আরও দুটি রুমে চলছে জুয়া খেলা। একটি রুমে থাকা কয়েকজনের কাছে জানতে চাওয়া হলো ক্লাব সংশ্লিষ্টরা কোন দিকে বসেন। এরপর তারা দেখিয়ে দিলেন। সেই রুমে গিয়ে পাওয়া গেল পাঁচজনকে। সামনে চেয়ার টেবিল পেতে বসে আছেন তারা। রুমটি বেশ পরিপাটি। তাদের মাথার ওপর ঝুলছে বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাসের ছবি। এসময় তাদের কাছে জানতে চাওয়া হলো ক্লাব নিয়ে কথা বলবেন এমন কেউ আছেন কি না? তারা সাফ জানিয়ে দিলেন, সভাপতি হাবিবুর রহমান এবং সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান সোহেল দুজনই বিদেশে অবস্থান করছেন। এরপর তাদের একজন সাধারণ সম্পাদক সোহেলের বিদেশের নাম্বার দেন। কিন্তু সোহেলকে সেই নম্বরে কল করে পাওয়া যায়নি।
সেখান থেকে ভিক্টোরিয়া ক্লাবে ঢুকে দেখা গেল, ক্লাবের প্রবেশমুখের বাঁ পাশের বারান্দায় নামাজ পড়ার ব্যবস্থা। একটু এগিয়ে যেতেই চোখে পড়ল রুমের সারি। রুমগুলো সম্প্রতি সংস্কার করা হয়েছে। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের রুম বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছে। একটি বড় রুমে দেখা গেল, বেশ কিছু মানুষ গোল হয়ে চেয়ারে বসে গল্প করছেন। সেক্রেটারির রুমে তাকে পাওয়া না গেলেওসেখানে চেয়ার টেবিল নিয়ে কিছু মানুষকে জুয়া খেলতে দেখা গেল। তবে তারা কেউ কথা বলতে রাজি হননি।
সেখান থেকে পূর্ব দিকে এগোতে গেলে বাধা দিলেন এক নিরাপত্তা কর্মী। জানালেন পূর্ব দিকের কক্ষগুলো এখনো সংস্কার করা হয়নি। কাজ চলমান।
এবার মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে গিয়ে দেখা গেল, গেটে ষাটোর্ধ এক ব্যক্তি বসে আছেন। প্রবেশ করতেই পরিচয় জানতে চাইলেন। তার বসে থাকা স্থানের পেছনে বিশাল হলরুম। সেখানে একসময় চলতো ক্যাসিনো। ২০১৯ সাল থেকে এটি সিলগালা ছিল। সম্প্রতি খুলে দেওয়া হয়েছে। ভেতরে এক বৃদ্ধ নিরাপত্তা কর্মীর দেখা মিলল। তবে নিজের নাম-পরিচয় বলতে চাননি। তার সাথে কথা বলে উত্তর দিকে এগিয়ে গিয়ে দেখা গেল, ক্লাবের খেলোয়াড়দের বহনকারী একটি গাড়ি দীর্ঘদিন ধরে পড়ে আছে। পাশে সারিবদ্ধ রুম। প্রতিটি রুমে লোকজনে ভরা। কানে ভেসে আসছিল কার্ড খেলা নিয়ে তাদের কথোপকথন।
বিএনপি-আওয়ামী লীগের ভাগ-ভাটোয়ারা!
ক্লাবগুলোর ভেতরে থাকা লোকজন ছাড়াও আশপাশের লোকজন জানিয়েছেন, গত ৭ আগস্ট থেকে শুরু হয় ক্লাবগুলো দখল। নিজের মতো করে ক্লাবগুলো দখল করেন মতিঝিল বিএনপির নেতারা। ৫ আগস্টে ক্ষমতার পালাবদলের দুই দিন পরই তাদের নজর পড়ে ক্লাবগুলোতে।
এলাকাবাসী জানান, ক্লাবগুলো গত ১৫ বছর দখলে ছিল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের। তাদের সেই দখলে ভাটা পড়ে ক্যাসিনোকাণ্ডের ঘটনায়। গত প্রায় ছয় বছর ছয়টি ক্লাব সিলগালা ছিল। কিন্তু সেগুলো সম্প্রতি তালা ভেঙে দখলে নেন মতিঝিল বিএনপি নেতারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ক্লাবগুলো এখন আয়শূন্য। আগে এসব ক্লাবে হাউজি চালিয়ে আয় হতো। কিন্তু ক্যাসিনো চালানোর অপরাধে জেলা প্রশাসন সেই সুযোগ আর রাখেনি। এখন ক্লাবগুলো খোলার পরই লাখ লাখ টাকা খরচ করা হচ্ছে এসবের পেছনে। এ নিয়ে প্রশ্নও উঠেছে, ক্লাবের আয় না থাকলেও তারা কিসের আশায় এত টাকা বিনিয়োগ করছেন!
জানা গেছে, এখনো ভিক্টরিয়া ক্লাবটি আওয়ামী লীগ নেতাদের দখলে রয়েছে। তাদের সাথে আছেন বিএনপি নেতারাও। তারা ভাগ-বাটোয়ার ভিত্তিতে ক্লাবগুলো চালানোর পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন। এজন্য প্রতিটি ক্লাবে নতুন কমিটির নামের তালিকা করে ক্রীড়া অধিদফতর, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) ছাড়াও মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছেন বিএনপি নেতারা। তবে মন্ত্রণালয় থেকে এখনো কোনো জবাব আসেনি। এলেই পুরোদমে নেতারা কার্যক্রম শুরু করবেন।
যা বলছে প্রশাসন
এ বিষয়ে ডিএমপর মতিঝিল বিভাগের ডিসি শাহরিয়ার হাসান বলেন, ক্লাবগুলো খুলেছে জানি না। খোঁজ নিয়ে এ বিষয়ে জানাতে পারব। একই কথা জানান মতিঝিল থানার ওসি মহিউল ইসলাম। তবে তিনি বিষয়টির ব্যাপারে আজই খোঁজ নেবেন বলে জানান।
পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, ক্লাবগুলো খোলার পর মতিঝিল থানা পুলিশের কাছে খবর আসে। পরে তারা যোগাযোগও করেন। এ নিয়ে স্থানীয় বিএনপি ও যুবদলের নেতাদের সাথে মনোমালিন্য হয়। পুলিশের ভাষ্য, ক্লাবগুলো সিলগালা ছিল। আদালতের আদেশ না নিয়ে তাদের তালা ভাঙা আইনগতভাবে ঠিক হয়নি।
অন্যদিকে ক্লাব সংশ্লিষ্টদের দাবি, তারা ক্লাবগুলোর ভগ্নদশা দেখে সংস্কার করতেই তালা খুলেছেন। যদিও এ বিষয়ে তারা থানার কোনো অনুমতি নেননি। এমনকি থানাকে বিষয়টি সম্পর্কে জানাননিও।
এমআইকে/জেবি