প্রায় এক যুগ আগের কথা। সৌদি আরবে থাকা বেশ কয়েকজন প্রবাসী মিলে গড়ে তোলেন একটি কোম্পানি। সেই কোম্পানির নামে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় জমিও কেনা হয়। সেই জমিতে ফ্ল্যাট তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয় কোম্পানির এমডি নুরুল আমিনকে। ফ্ল্যাট তৈরির কাজ আরও আগেই শেষ হয়েছে। এমডি নিজের ফ্ল্যাট বুঝে নিলেও ১২ বছরেও ভুক্তভোগী প্রবাসী ২০ প্রবাসীকে ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেননি তিনি।
শুধু ফ্ল্যাট বুঝিয়ে না দেওয়া পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকেননি নুরুল আমিন। বিষয়টি নিয়ে কেউ তার সঙ্গে কথা বলতে গেলে দেন হুমকি। কেউ সমাধান করতে গেলে তার নামে দেন মিথ্যা মামলা। এভাবে বছরের পর বছর দমিয়ে রেখেছেন প্রবাসীদের। এমনকি প্রবাসীদের টাকায় বানানো ফ্ল্যাট একাধিক ব্যক্তির কাছে বিক্রিও করে দেন। সম্প্রতি ভুক্তভোগীরা এই প্রতারণার বিষয়ে জানতে পেরে হতাশ হয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে ফ্ল্যাট বুঝে পেতে অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার দ্বারস্থ হন তারা। প্রতারিত প্রবাসীরা শর্তমতে নিজেদের পাওনা ফ্ল্যাট বুঝে পেতে চান। সেই সঙ্গে প্রতারক এমডি নুরুল আমিনের কঠিন শাস্তিও দাবি করেন তারা।
বিজ্ঞাপন
ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, তারা প্রায় ৩৫ জনের মতো ব্যক্তি মিলে এক যুগ আগে বেস্ট সিকিউরিটিজ অ্যান্ড প্রোপ্রার্টিজ ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড (বিপিডিএল) নামে একটি কোম্পানি গড়ে তোলেন। সেই কোম্পানির টাকায় সবার বসবাসের জন্য আবাসিক ভবন নির্মাণের স্বপ্ন দেখেন। এক পর্যায়ে যাত্রাবাড়ী এলাকায় জমিও পেয়ে যান। কোম্পানির এমডি নুরুল আমিনকে বিশ্বাস করে যাবতীয় দায়িত্ব দেন তারা। এরপর ভবন নির্মাণের জন্য অপটিমাম প্রপার্টিজ নামে একটি ডেভেলপার কোম্পানিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। সেই ডেভেলপার কোম্পানি ভবন নির্মাণের পর চুক্তি অনুযায়ী জমির মালিকদের পক্ষের লোক হিসেবে এমডিকে প্রায় অর্ধেক ফ্ল্যাট বুঝিয়েও দেয়। কিন্তু এমডি সেই ফ্ল্যাটগুলো কোম্পানির অংশীদারদের বুঝিয়ে দেননি। প্রবাসীরা ফ্ল্যাট বুঝে না পেয়ে একাধিকবার তার সঙ্গে বসতে চেয়েছেন। কিন্তু তিনি বসেননি। উল্টো তাদের ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন। বাধ্য হয়ে তাদের একজন সম্প্রতি যাত্রাবাড়ী থানায় সাধারণ ডায়েরিও করেছেন।
একই ফ্ল্যাট একাধিকজনের কাছে বিক্রি!
প্রবাসীরা তাদের গড়া কোম্পানির এমডি নুরুল ইসলামকে বিশ্বাস করে যাবতীয় দায়িত্ব দিলেও তিনি তাদের ভাগের ফ্ল্যাট একাধিক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করে দেন। ফ্ল্যাটের কাজ শেষ হয়নি, ডেভেলপার কোম্পানি ফ্ল্যাট তৈরিতে দেরি করছে- এসব গল্প বলে বলে এতদিন পার করেছেন। তবে সম্প্রতি তার প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পারেন শেয়ার হোল্ডাররা।
বিজ্ঞাপন
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এমডি নুরুল আমিন ২০১৭ সালে তৎকালীন আশুলিয়া থানার এসআই মনিরের কাছে একটি ফ্ল্যাট বিক্রি করেন। যার বিনিময়ে এসআই মনির তাকে ২৪ লাখ টাকা দেন। টাকা পরিশোধ করলেও সেই পুলিশ কর্মকর্তা নিজের ফ্ল্যাট বুঝে পাচ্ছিলেন না দীর্ঘদিন। অবশেষে ফ্ল্যাট মালিক অ্যাসোসিয়েশনের মধ্যস্থতায় তিনি ফ্ল্যাট বুঝে পান। এছাড়া আরেক সরকারি কর্মকর্তার কাছে ২০১৮ সালে দুটি ফ্ল্যাটের পাওয়ার হস্তান্তর করেন। যার বিনিময়ে সেই কর্মকর্তা তাকে ৫১ লাখ টাকা দেন। কিন্তু ওই ফ্ল্যাটে রাকিব নামে এক ব্যক্তিকে দিয়ে ভুয়া সাইনবোর্ড লাগিয়ে দেন।
ভুক্তভোগী প্রবাসীদের অভিযোগ, এমডি নুরুল আমিন তাদের টাকায় জমি কেনার সময় এবং পরে রাস্তার জমি কেনার নামে অধিক মূল্য দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়েছেন। এছাড়া তারা কোম্পানির পরিচালক হলেও কোনো বিষয়ে তাদের সঙ্গে পরামর্শ করা হতো না। এমনকি মিটিংয়ে তাদের ডাকা হয়নি।
মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি!
এমডি নুরুল আমিনের কাছে সাইফুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি ২০১৯ সালে একটি ফ্ল্যাট কেনেন। কিন্তু পাঁচ বছর পর এসে সেই ফ্ল্যাটে রাকিবুল ইসলাম নামে একজনের সাইনবোর্ড লাগিয়ে দেন এমডি। উল্টো ফ্ল্যাট ক্রয়কারী সাইফুল ইসলামকে হয়রানি করতে দুটি মিথ্যা মামলাও দেন নুরুল আমিন। যার একটিতে খালাস পেলেও সম্প্রতি আরেকটি হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে তাকে।
ভু্ক্তভোগী সাইফুল ইসলাম বলেন, আমাকে শুধু মিথ্যা মামলা দেয়নি, আমার ফ্ল্যাটের পাওয়ার অন্যকে দিয়ে উল্টো ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন তিনি। মূলত তিনি এসব করছেন তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলোর যাতে তদন্ত না হয়। প্রবাসীরা যাতে তাদের ফ্ল্যাট বুঝে না নিয়ে ভয়ে পিছু হটেন।
ভুক্তভোগী প্রবাসী জহিরুল ইসলাম বলেন, আমরা একদিনও জানতে পারিনি ফ্ল্যাট তৈরি হয়েছে। এমডি নুরুল আমিনকে কল করলেও তিনি আমার কল ধরতেন না। এখন দেশে এসে দেখছি জমিতে বহুতল ভবন উঠেছে। তিনি আমাদের ফ্ল্যাট একাধিক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। আমরা কোম্পানির পরিচালক হয়েও কিছু জানতে পারিনি। বাধ্য হয়ে ডেভেলপার কোম্পানির দ্বারস্থ হয়েছি। তাদের অনুরোধ করেছি, বাকি ফ্ল্যাটগুলো যাতে তাকে হস্তান্তর না করা হয়।
আরও পড়ুন
৫০ হাজারে নকল সার্টিফিকেট বিক্রি করতেন জাফর ও তার বন্ধু
প্রশ্নফাঁসের 'টাকায়' দানবীর, মানবতার ফেরিওয়ালার ভূমিকায় ছেলে!
একই কথা জানিয়েছেন ভুক্তভোগী কোম্পানির পরিচালক মোস্তফা হোসাইন, ইব্রাহীম মুন্সি, মনিরুজ্জামান তালুকদার, হাফসা আক্তার, খাদিজা লতিফ ও হোসনে আরা বেগমসহ আরও অনেকে।
প্রবাসীদের ভবন তৈরি করে দেওয়া ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান অপটিমাম প্রপার্টিজের চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, তারা (প্রবাসীরা) আমার কাছে আবেদন করেছেন যাতে বাকি ফ্ল্যাটগুলো এমডিকে না বুঝিয়ে দিই। এমডি তাদের ফ্ল্যাট একাধিকজনের কাছে বিক্রিও করেছেন বলে অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টি নিয়ে এমডিকে বলা হলে তিনি একটা কথাই বলেন- বিষয়টি তাদের একান্ত। এসব বলে তিনি তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলো এড়িয়ে যান।
এসব অভিযোগ নিয়ে কথা বলার জন্য বেস্ট সিকিউরিটিজ অ্যান্ড প্রোপ্রার্টিজ ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের (বিপিডিএল) এমডি নুরুল আমিনের ফোনে একাধিক বার কল করে এবং ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েও কোনো জবাবও মেলেনি।
বিপিডিএল এর পরিচালক জহিরুল ইসলাম জানান, নুরুল আমিন তাদের কোম্পানির কোনো পরিচালকেরই ফোনই রিসিভ করেন না। তারা শত চেষ্টা করেও নুরুল আমিনের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারছেন না।
এমআইকে/জেবি