বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৪, ঢাকা

সৌদি যাওয়ার স্বপ্নে নিঃস্ব ১৮ যুবক

মোস্তফা ইমরুল কায়েস
প্রকাশিত: ১৬ মে ২০২৪, ০৬:৩৯ পিএম

শেয়ার করুন:

সৌদি যাওয়ার স্বপ্নে প্রতারকের খপ্পরে ১৮ যুবক

# জমি বন্ধক রেখে, সুদে টাকা এনেছেন অধিকাংশ ভুক্তভোগী
# স্বর্ণালঙ্কার গচ্ছিল রেখে টাকা নিয়েছে কেউ
# প্রতারক আবু সাঈদ সৌদিতে ও সাহাবুদ্দিন লাপাত্তা
# এজেন্সি মালিক হাসিবুল দায় নিচ্ছেন না
# দিশেহারা হয়ে পড়েছে ভুক্তভোগীরা

সৌদি আরবে যাওয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলার ১৮ যুবকের কাছ থেকে ৬৩ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে একটি চক্র ও এজেন্সি মালিক। ফলে তারা এখন পথে বসতে শুরু করেছে। কেউ জমি ও স্বর্ণালঙ্কার বন্ধক রেখে, কেউ চড়া সুদে, আবার কেউ ধানের সময় প্রতি লাখে বাড়তি ধান দেবেন এই শর্তে টাকা নিয়েছিলেন। আশা ছিল সৌদি আরব যাওয়ার। কিন্তু সেই টাকা নিয়ে গা ঢাকা দিয়েছে প্রতারক চক্র। চক্রটি যে এজেন্সির মাধ্যমে তাদের সৌদি পাঠানোর কথা ছিল, তারা কোনো দায় নিচ্ছে না। উল্টো ভুক্তভোগীদের নানাভাবে ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে।


বিজ্ঞাপন


ভুক্তভোগীদের কারও বাড়ি চট্টগ্রাম, কারও বাড়ি চাঁদপুর, কুমিল্লা, ফেনী ও নোয়াখালী জেলায়। গত সাত দিন অতিবাহিত হলেও বিষয়টির কোনো সুরাহা হয়নি। ফলে বিদেশ যাওয়ার জন্য দেওয়া টাকা তারা ফেরত পাবেন কিনা সেই চিন্তায় এখন অনেকে দিশেহারা। জানা গেছে, প্রতারক চক্রটি ১৮ যুবককে সৌদিতে পাঠানোর নাম করে ৬৩ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
  
গত তিন দিন থেকে ভুক্তভোগী, প্রতারক চক্রের হোতা এজেন্সি ও সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।   

জানা গেছে, সম্প্রতি ঢাকার নয়াপল্টনে ভিক্টরী হোটেলের চারতলায় থাকা উত্তরবঙ্গ ওভারসিজ লি. নামে একটি  অফিসে এসেছিলেন সেই ১৮ যুবক। গত ৯ মে সকাল সাড়ে আটটার ফ্লাইটে তাদের সবার সৌদি যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তারা সেদিন সেই এজেন্সির অফিসে গিয়ে জানতে পারেন তাদের কোনো ভিসা, টিকিট হয়নি। এমনকি তারা এজেন্সির হয়ে তাদের কাছ যে সব টাকা পয়সা নেওয়া হয়েছিল তা নাকি মালিক পাননি। ফলে তাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। এসময় তারা ডকুমেন্টস দেখাতে শুরু করলে পরে মালিক তাদের বেঁধে রাখার ভয়-ভীতি দেখায়। নিরুপায় হয়ে তারা পরে ফিরে যান নিজ নিজ জেলায়। তবে যাওয়ার আগে তারা জানতে পারে, সেই এজেন্সির হয়ে কাজ করা দালাল আবু সাঈদ, শাহাবুদ্দিন, ফজলু কাজী এই টাকা নিয়েছেন। তার কিছু টাকা দিয়েছেন এজেন্সি মালিককে। তবে এসবের নেপথ্যে এজেন্সি মালিকের হাত রয়েছে বলে তাদের সন্দেহ।

কথিত এজেন্সি মালিক পাসপোর্ট, ভিসা ও টিকিট না দিয়ে উল্টো বেঁধে রাখার ভয় দেখান ভুক্তভোগীদের। পরে তাদেরকে আশ্বাস দেন ফ্লাইট হবে। কিন্তু পরদিনও হয়নি। এরপর তারা গ্রামে ফিরে যান।

জমি ও স্বর্ণালঙ্কার বন্ধক রেখে টাকা নিয়েছেন কেউ কেউ:


বিজ্ঞাপন


ফটিকছড়ির ভুজপুর উপজেলার এরশাদ। সৌদির যাওয়ার স্বপ্নে নিজের ছয় শতক জমি বন্ধ রেখে প্রতিবেশীদের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা নেন। আরও নানা ধার-দেনা করে প্রায় কয়েক লাখ টাকা সংগ্রহ করেন। এরপর সেই টাকা তুলে দেন উত্তরবঙ্গ ওভারসিস লি. নামে একটি এজেন্সির হয়ে তাদেরকে সৌদিতে নেওয়ার প্রলোভন দেখানো শাহাবুদ্দিনের কাছে। এরশাদ ভেবেছিলেন সেখানে গিয়ে সেই বন্ধকী জমি তিনি বের করবেন। এজন্য সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে মাত্র ছয় মাস। কিন্তু সেই আশায় এখন গুড়েবালি। এরশাদ তার টাকা ফেরত পাবেন কিনা সন্দেহ। কারণ যাদের তিনি টাকা দিয়েছেন তাদের আর খুঁজে পাচ্ছেন না। একজন থাকেন সৌদিতে আরেকজন লাপাত্তা।  

নোয়াখালীর কবিরহাট উপজেলার পারভেজ ও রাকিব। তারা দুই সৌদিতে যাবেন বলে নিজেদের জমি ও বোনের কিছু স্বর্ণালঙ্কার বন্ধক রেখে সাত লাখ টাকা নেন। এরপর সেই টাকা তুলে দেন আবু সাঈদ, শাহাবুদ্দিন ও উত্তরবঙ্গ ওভারসিজের মালিক হাসিবুল ইসলাম বাবুর দেওয়া ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। কিন্তু সেই টাকা পেয়েও এখন তারা বিষয়টি অস্বীকার করছে।

ভুক্তভোগীরা বলছেন, এই প্রতারক চক্রের সাথে উত্তরবঙ্গ ওভারসিজের মালিক হাসিবুল ইসলাম বাবুও জড়িত। তার কথা মতোই শাহাবুদ্দিন, আবু সাঈদ ও ফজলু কাজী টাকাগুলো তাদের কাছ থেকে নেয়। তারা ৬৩ লাখ টাকার মধ্যে ভিসা, মেডিকেল বাবাদ অর্ধেকের বেশি টাকা বাবুর অ্যাকাউন্টে পাঠিয়েছেন। যা ব্যাংক ও বিকাশে লেনদেন হয়েছে।

চড়া সুদে টাকা নিয়ে এখন বিপাকে মোরশেদ:

ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার মোরশেদ আলম এক সময় কাতারে ছিলেন। দেশে ফিরে বেকার ছিলেন। ফলে সুদে ওপর নিয়ে তিন লাখ টাকা দিয়েছেন। কিন্তু এই টাকা নিতে তাকে প্রতি লাখে ধান দিতে হবে শর্তে নিয়েছেন। পরিবারের কথা ভেবেই তিনি সুদে টাকা নিয়ে শাহাবুদ্দিন ও সাঈদকে দেন। তিনি জানান, সব মিলে তিন লাখ টাকা দেন তিনি। তার কাছ থেকে প্রথমে মেডিকেল করতে গেলে ৩০ হাজার টাকা নেওয়া হয়। টাকাগুলো শাহাবুদ্দিন ও সাঈদ ব্যাংক অ্যাকাউন্টে নিয়েছে। তিনি বলেন, ভাবলাম কেন বেকার থাকি বিদেশ থেকে খেটে আসি। কিন্তু এখন তো বিদেশ যাওয়া হবে না মনে হয়। যারা আমাদের টাকা নিয়েছে, তাদেরকে পাচ্ছি না। 

ভুক্তভোগীরা জানিয়েছে, তাদেরকে ঢাকার যমুনা ফিউচার পার্কে ফিঙ্গারিং করার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এছাড়াও বিভিন্ন জনকে বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট দেওয়া হয়েছিল। তারা প্রত্যেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা করে দিয়েছেন। 

নোয়াখালীর জহিরও এই প্রতারিত হওয়াদের একজন। তিনি বলেন, ‘এখন তারা নিতাছে না। ওরা টাকা নিয়া আর টিকিট দেয়নি। ১০ মে নিবার কথা আছিল নেয় নাই। তিনি আরিফ নামে এক ব্যক্তির মাধ্যমে সেই টাকা দিয়েছিলেন।’

ফেনীর ইয়াসিন আরাফাত জানান, তিনি ব্র্যাক থেকে লোন নিয়ে কিছু টাকা নেন। বাকী টাকা অন্যদের কাছ থেকে ধার-দেনা করে ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা পাঠান হাসিবুলের অ্যাকাউন্টে। এছাড়াও তার মেডিকেল ও বিএমইটি কার্ড তৈরিতেও টাকা নেওয়া হয়।

তিনি বলেন, আমরা দুজন একজন সাথে শুধু মেডিকেল করা বাবদই ৬০ হাজার টাকা দিয়েছি। এছাড়াও আমাদের কাছ থেকে বিএমইটি কার্ড করে দেওয়ার নামে আঙ্গুলের ছাপ নেওয়ার সময় প্রত্যেকের কাছ থেকে প্রায় দুই হাজার করে টাকা নেওয়া হয়েছে। তখন বলা হয়েছিল, এটা তাদের বিশেষ সার্ভিস।  

ভুক্তভোগীরা বলছেন, এই প্রতারক চক্রের সাথে উত্তরবঙ্গ ওভারসিজের মালিক হাসিবুল ইসলাম বাবুও জড়িত। তার কথা মতোই শাহাবুদ্দিন, আবু সাঈদ ও ফজলু কাজী টাকাগুলো তাদের কাছ থেকে নেয়। তারা ৬৩ লাখ টাকার মধ্যে ভিসা, মেডিকেল বাবাদ অর্ধেকের বেশি টাকা বাবুর অ্যাকাউন্টে পাঠিয়েছেন। যা ব্যাংক ও বিকাশে লেনদেন হয়েছে।  

খোঁজ নিয়ে যা যা জানা গেছে:

ভুক্তভোগীরা জানান, তারা গত ৯ মে ঢাকায় এসে নয়াপল্টনের ভিক্টরী হোটেলে থাকা উত্তরবঙ্গ ওভারসিস লি. এর অফিসে যান। কিন্তু তাদেরকে কথিত এজেন্সি মালিক পাসপোর্ট, ভিসা ও টিকিট না দিয়ে উল্টো বেঁধে রাখার ভয় দেখান। পরে তাদেরকে আশ্বাস দেন ফ্লাইট হবে। কিন্তু পরদিনও হয়নি। এরপর তারা গ্রামে ফিরে যান। যে উত্তরবঙ্গ ওভারসিজ লি. ও ফাতেমা ইন্টারন্যাশনাল নামে দুই এজেন্সির মাধ্যমে তাদের সৌদিতে যাওয়ার কথা ছিল। এই এজেন্সির মালিক হাসিবুল ইসলাম বাবু নামে এক ব্যক্তি। যার গ্রামের বাড়ি গাইবান্ধা জেলায়। 

জানা গেছে, ফাতেমা ইন্টারন্যাশনাল এবং উত্তরবঙ্গ ওভারসিজ লিমিটেড নামে দুই প্রতিষ্ঠানের নামে টাকা নিয়েছে প্রতিষ্ঠান দুটির কর্ণধার হাসিবুল ইসলাম বাবু। তবে এই প্রতিষ্ঠান দুটি আরএল নম্বর নেই। তিনি টাকা নেওয়ার সময় ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে কখনো নিজের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে, আবার কখনো বন্ধুর অ্যাকাউন্টে, কখনো বিকাশে নিয়েছেন। তবে ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে ভিসা বাবদ টাকা ছাড়াও মেডিকেল ও বিএমইটি কার্ড পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে কয়েকগুণ বাড়তি টাকা নেওয়া হয়েছে।

হাসিবুল ইসলাম বাবুর দুই প্রতিষ্ঠানের কোনোটিরই আরএল নম্বর নেই। এরপরও আপনি কিভাবে লোক পাঠাচ্ছেন এমন প্রশ্ন করলে তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, আমি ভিসা বিক্রি করেছি মাত্র। এটা তো অবৈধ নয়। তবে তিনি বাড়তি মেডিকেল ফি এবং যমুনা ফিউচার পার্কে বিএমএটি এর কার্ড পাইয়ে দেওয়ার জন্য ফিঙ্গারিং বাবদ টাকা নেওয়ার কথা অস্বীকার করেন।

তার দাবি, তিনি সাতজনের কাছ থেকে ২০ হাজার করে মেডিকেল ফি বাবদ এক লাখ চল্লিশ হাজার টাকা পেয়েছেন। ফেনী জেলার ইয়াসিন আরাফাত ও ও তার আরেক প্রতিবেশী মেডিকেল ফি বাবদ ৩০ হাজার করে ৬০ হাজার টাকা দিয়েছেন। যা তার প্রতিষ্ঠানের রিসিটের মাধ্যমে নেওয়া হয়েছে। সেই রিসিটের কপি ঢাকা মেইলের কাছে এসেছে। তার মতে, তিনি মাত্র ১০ জনের কাছ থেকে ৬ লাখ ৮০ হাজার টাকা পেয়েছেন।

4

এজেন্সির মালিক যা পেয়েছেন:

ঢাকা মেইলের কাছে আসা তথ্যমতে, হাসিবুর ভুক্তভোগী ইমাম বাকেরের কাছ থেকে পেয়েছেন ৩ লাখ টাকা, সংকর দে এর কাছ থেকে পান ২০ হাজার টাকা ও বিভিন্ন সময় মিলে দুই লাখের বেশি, আমিরুল ইসলাম এর অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে ভুক্তভোগীরা পাঠিয়েছে ২ লাখ টাকা, হাসিবুরের দেওয়া আব্দুর রাজ্জাক নামে এক ব্যক্তির অ্যাকাউন্টে পাঠানো হয় এক লাখ টাকা, এছাড়া কবিরহাটের গোলাম গোলাম রসুলের অ্যাকাউন্ট থেকে ৮০ হাজার, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের নেক্সাস পে, দুটি বিকাশ অ্যাকাউন্ট নম্বরে মিলে ১ লাখ ৫৪ হাজার টাকা পাঠানো হয়। ফেনীর মোরশেদ আলম বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট থেকে বিভিন্ন সময়ে ১ লাখ ৮৬ হাজার টাকা, এরশাদ ২ লাখ টাকা, ফেনীর আরাফাত আড়াই লাখ টাকা, আনোয়ার হোসেন নামে এক ভুক্তভোগী দেড় লাখ টাকা, কামাল নামে এক ভুক্তভোগী ১ লক্ষ ৩৭ হাজার টাকা ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক এবং ডাচ বাংলা অ্যাকাউন্টে পাঠিয়েছেন। 

কথিত উত্তরবঙ্গ ওভারসিজ লি. এর মালিক যা জানালেন
 
উত্তরবঙ্গ ওভারসিজ লি. এর মালিক হাসিবুল ইসলাম বাবু ঢাকা মেইলকে জানান, তার প্রতিষ্ঠানে মোট ১১ জন কাজ করে। ভুক্তভোগীদের সাহাবুদ্দিন নামে একজন নিয়ে এসেছিল। তার সাথে কাজ করতো আবু সাইদ। ফজলু কাজীর সাথে আবু সাঈদের পরিচয় হয়। সেই সূত্রে ফজলু আবু সাঈদকে লোকজন ম্যানেজ করতে বলেন। প্রতি লোকের কাজ বাবদ বেতন হবে হাজার থেকে বারশ রিয়েল।

তিনি জানান, ঘটনার পর তিনি জানতে পারেন বাকী টাকা আবু সাঈদ আত্মসাৎ করেছে। পরে তিনি আবু সাঈদের হয়ে কাজ করা সাহাবুদ্দিন, তার কর্মী শাকিলসহ টঙ্গীতে থাকা সাঈদের আরেক স্ত্রীর বাসায় চলে যান। সেখানে গেলে সেই স্ত্রী সাঈদের সঙ্গে তার সাথে বিয়ে হয়নি বলে নানা নাটক সাজায়। এরপর তাদের টঙ্গী থানায় গিয়েছিল তারা। কিন্তু তারা ডকুমেন্ট দেখাতে না পারায় কোনো মামলা নেয়নি। এরপর তারা সেখান থেকে ঠাকুরগাঁও চলে যান সাঈদের গ্রামের বাড়িতে। সেখানে গিয়ে মেম্বার, চেয়ারম্যানকে বিষয়টি জানিয়ে চলে আসেন। 

হাসিবুল ইসলাম বাবু বলেন, সব টাকা আমার অ্যাকাউন্টে নিয়েছি কেউ কি প্রমাণ দিতে পারবে। সরকারি ফি ১০ হাজার। কিন্তু আমি তাদের ১০ জানের কাছ থেকে ৬ লাখ ৮০ টাকা পেয়েছি। সাতজনের মেডিকেল করা বাবদ ২০ হাজার করে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা নিয়েছি। এছাড়া আর কোনো বাড়তি টাকা নেওয়া হয়নি। ফ্লাইটের দিন তারা আসছে সকালে। আমি তাদের বলেছিলাম টাকা দিলে ফ্লাইট হবে, না দিলে হবে না। যে টাকাগুলো মারছে তার নাম আবু সাঈদ। আমরা আবু সাঈদের বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ে গিয়েছিলাম। এক সপ্তাহ সময় নিয়েছে তার পরিবার। আমার সাথে কথা ছিল সাহাবুদ্দিন টাকা দেবে আমি তাদের পাসপোর্ট বুঝিয়ে দেব। কিন্তু তারা আমার ভিসা বাবদ ৩ লাখ ২০ হাজার করে ২৫ লাখ টাকা দেয়নি। ফলে আমিও তাদের পাসপোর্ট দিতে পারিনি। 

তিনি দাবি করেন, প্রধান দালাল মূলত আবু সাঈদ। তার সহযোগী সাহাবুদ্দিন। আর ফজলু কাজী তার হয়ে লোকজন সংগ্রহের কাজ করেছে। মূলত সাহাবুদ্দিন ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে সব টাকা নিয়ে আবু সাঈদকে দেন। আবু সাঈদ তা সৌদিতে থাকা ফজলু কাজীকে দেন। সেখান থেকে পাওয়া ৬ লাখ ৮০ হাজার টাকা ফজলু কথিত এজেন্সির মালিক হাসিবুর রহমান বাবুকে দেন। তার মতে, এখানে কাজ করেছে চার ব্যক্তি। তিনি, তার দালাল ফজলু কাজী, আবু সাঈদ ও সাহাবুদ্দিন। তারা যেহেতু লোক সংগ্রহ করেছে কিন্তু তার ভিসা বাবদ ৩ লাখ ২০ হাজার করে দেওয়ার কথা থাকলেও তা তিনি পাননি। 

এ বিষয়ে সৌদিতে অবস্থানরত ফজলু কাজী ও আবু সাঈদের সাথে হোয়াটসআপ নম্বরে খুদে বার্তা পাঠিয়েও কোনো জবাব মেলেনি।

নয়জনের ডকুমেন্ট ঢাকা মেইলের কাছে এসেছে। সেই হিসেবে তারা প্রায় ২০ লাখ টাকা জমা দিয়েছেন বলে দাবি করেছেন। কিন্তু হাসিবুরের দাবি তিনি ছয় লাখ ৮০ হাজার টাকা পেয়েছেন। তার মধ্যে এক লাখ চল্লিশ হাজার টাকা মেডিকেল বাবদ সাতজনের। কিন্তু মেডিকেল ফি ১০ হাজার টাকা। সেই জায়গা তিনি আরো দশ হাজার করে বেশি নিয়েছেন ভুক্তভোগীদের কাছে।

ভুক্তভোগীরা যেভাবে যতো টাকা দিয়েছেন

নোয়াখালীর ইমাম গত ৩১ মার্চ (৭০১৭৭৪০১৪৫৫৫৮ থেকে ১৪১৫১০২৪৪৮৩১) এই অ্যাকাউন্টে ডাচ বাংলা ব্যাংকের শ্যামলী শাখায় এক লাখ টাকা দেন। একই দিন ইমাম ব্যাংকে আরও সাড়ে ১৩ হাজার টাকা জমা দেন। এছাড়াও এই ভুক্তভোগী গত ৩ এপ্রিল ৩৬ হাজার ৪৩০ টাকা পাঠান বাবুর অ্যাকাউন্টে। তার আগে ইমাম ১ লাখ টাকা ডাচ বাংলা ব্যাংকের অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে বাবুর অ্যাকাউন্টে পাঠান। এছাড়াও বাবুর অফিসে তাকে আরও ৫০ হাজার টাকা দেন তিনি। শুধুমাত্র ইমাম ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে দিয়েছেন ৩ লাখ টাকা। তাকে বাবু ও তার লোকেরা বারবার বলেছিল তিনি যেনো হাতে হাতে টাকাগুলো দেন। কিন্তু ইমাম তাদের কথায় রাজি হননি। তিনি বাবুর ডাচ বাংলা ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে এসব টাকা পাঠান বলে জানান। অন্যদিকে গত ৫ মে সংকর দে হাসিবুরের অ্যাকাউন্টে ২০ হাজার টাকা পাঠান তার ইসলামী ব্যাংকের হিসেবে।

এছাড়াও গত ৮ মে আমিরুল ইসলামের ইব্রাহিম এন্টারপ্রাইজের অ্যাকাউন্ট (২০৫০৩৩৯০১০০১১৪৯১৭ থেকে ৭২২৪০৫০৮০০০০৮৯৪৮) অ্যাকাউন্টে ৫০ হাজার টাকা পাঠানো হয়। আমিরুল একই দিন নাহিদ টেলিকম এন্ড ইলেকট্রনিকস এর অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে (২০৫০৭৭৭০১০০৪৫০২৪২ থেকে ৫৭২৪০৫০৫০০১৪৫৮৬) অ্যাকাউন্টে ইসলামী ব্যাংক এজেন্ট এর মাধ্যমে দেড় লাখ টাকা পাঠান। হাসিবুরের লোকজনের দেওয়া দুটি অ্যাকাউন্টে ২ লাখ টাকা পাঠানো হয়। 

গত ২০ মার্চ চট্টগ্রামের ভুজপুরের মহানগর ট্রাভেলসের অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে দেড় লাখ টাকা পাঠানো হয় ৫৬২৪০৩২০০০০১২৬৯৩ এই অ্যাকাউন্টে। এটি চলে যায় হাসিবুর বাবুর দেওয়া আব্দুর রাজ্জাকের অ্যাকাউন্টে। নোয়াখালীর কবিরহাটের ইব্রাহিম এন্টারপ্রাইজ এর নামে খোলা ইসলামী ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিং এর মাধ্যমে ৫৬২৪৫০৮০০০০০৯৮৭ অ্যাকাউন্টে ১ লাখ টাকা পাঠানো হয়। কবিরহাটের গোলাম রসুল নামে এক ব্যক্তির ইসলামী ব্যাংকের একাউন্ট ব্যবহার করে ৫৮২৪০৪৩০০০০০৭১৯৭ এই নম্বরে ৮০ হাজার টাকা পাঠানো হয়েছে।

গত ৪ এপ্রিল নেক্সাস পে ব্যবহার করে ১৪৮১৫১ ০২৪৪৮৩১ হিসেব নম্বরে এক লাখ টাকা পাঠানো হয়েছে। গত ২৬ মার্চ সাড়ে ২৪ হাজার টাকা পাঠানো হয় বিকাশ ০১৮৮৬২৭৩৭৭৮ নম্বরে। তার আগে ০১৮১৫৮৬২৭২৭ বিকাশ নম্বরে ৩০ হাজার টাকা পাঠানো হয়। 

ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের নেক্সাস পে গত ৩০ এপ্রিল ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের নাজমা বেগমের অ্যাকাউন্ট থেকে ১ লাখ ৩৮ হাজার টাকা পাঠানো হয় ব্যাংকটির মঠবাড়িয়া শাখার ২০৫০৭৭৭০২৩০৮২৫৬১৪ এই অ্যাকাউন্টে। ভুক্তভোগী মোরশেদ আলম কত ৫ মে ইসলামী ব্যাংকের ফেনীর দাগনভূঞা শাখা থেকে ৫০ হাজার টাকা পাঠান ব্যাংকটির আরেক হিসেব নম্বরে যার শেষ নম্বর ৮৩০১২। মোরশেদ আলম একাই পাঠিয়েছেন ১ লাখ ৮৬ হাজার টাকা, ফটিকছড়ি জেলার এরশাদ হোসেন তার বাড়ির ছয় শতক জমি বন্ধক রেখে প্রতিবেশীর কাছে এক লাখ টাকা নিয়েছেন। স্বপ্ন ছিল সৌদি গিয়ে সেই টাকা পরিশোধ করবেন। কিন্তু তিনি এখন বড় বিপাকে পড়ে গেলেন। তার আর সৌদি যাওয়া হবে কিনা জানেন না। 

চলতি বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি আনোয়ার হোসেন নামে ভুক্তভোগী তার ডাচ বাংলা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ৭০১৭৭৪০১০৮৪১৯ থেকে ৭০১৭৩২৬৫২২৪৫০ হিসেবে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা পাঠান। গত ২২ ফেব্রুয়ারি ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক এর নেক্সাস পে ব্যবহার করে ৯৯ হাজার টাকা পাঠানো হয় ২০৫০৭৭৭০১০০৪৫০২৪২ এই অ্যাকাউন্টে। ভুক্তভোগী কামাল উদ্দিন গত ২৯ এপ্রিল ডাচ বাংলা ব্যাংকের ফেনীর দাগনভূঞা শাখায় মহানগর ট্রাভেলস এর নামে খোলা অ্যাকাউন্ট থেকে ৩৮ হাজার টাকা পাঠান।

নয়জনের ডকুমেন্ট ঢাকা মেইলের কাছে এসেছে। সেই হিসেবে তারা প্রায় ২০ লাখ টাকা জমা দিয়েছেন বলে দাবি করেছেন। কিন্তু হাসিবুরের দাবি তিনি ছয় লাখ ৮০ হাজার টাকা পেয়েছেন। তার মধ্যে এক লাখ চল্লিশ হাজার টাকা মেডিকেল বাবদ সাতজনের। কিন্তু মেডিকেল ফি ১০ হাজার টাকা। সেই জায়গা তিনি আরো দশ হাজার করে বেশি নিয়েছেন ভুক্তভোগীদের কাছে। 

মেডিকেল করা এক ভুক্তভোগীর ডকুমেন্টে দেখা যাচ্ছে, ভাটারার মাদানি এভিনিউ থাকা মোহামিড মেডিকেল সেন্টারে মেডিকেল বাবদ খরচ হয়েছে ৮ হাজার ৫০০ টাকা। কিন্তু সেখানে নেওয়া হয়েছে ২০ হাজার টাকা। তবে সেটি কাগজে। এ টাকা নিয়েছে হাসিবুরের প্রতিষ্ঠান। এর বাহিরেও আরও দশ হাজার টাকা করে নিয়েছে বলে ভুক্তভোগীদের দাবি। 

প্রধান প্রতারক আবু সাঈদের ফোন বন্ধ, গ্রামের মেম্বার যা জানালেন:

প্রতারক আবু সাঈদের আসল নাম মোজাহারুল ইসলাম সাঈদ। কিন্তু ঢাকায় তাকে সবাই আবু সাঈদ নামে চিনে। তার বাবার নাম জাবির হোসেন। ঠাকুরগাঁও সদরে তার গ্রামের বাড়ি। সদর শালন্দর ইউনিয়নের ৭ নং ওয়ার্ডের সাবেক মেম্বার মিজানুর রহমান ঢাকা মেইলকে ফোনে বলেন, আমি বিষয়টি জেনেছি। ঢাকা থেকে শাহাবুদ্দিনসহ আরও কয়েকজন এসেছিল। মূলত শাহাবুদ্দিনও একজন প্রতারক তার কথাবার্তায় মনে হয়েছে। কারণ এই শাহাবুদ্দিন আবু সাঈদের ব্যাপারে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম তথ্য দিয়েছে ভুক্তভোগীদের। আমি বিষয়টি জানার পরে তার স্ত্রীর সাথে কথা বলেছি। কিন্তু তার স্ত্রী বাপের বাড়ি চলে গেছে ছয় থেকে সাত দিন হলো। তার বৃদ্ধ মা স্থানীয় একটি শিশুদের স্কুলে আয়ার চাকরি করে। বাবা মুক্তিযোদ্ধা ছিল কিন্তু অনেক আগে মারা গেছে। আমি যতটুকু জানি আবু সাঈদ ১০-১২ বছর বয়স থেকে ঢাকায় থাকতো। মাঝে শুনলাম সে সৌদি চলে গেছে। সব মিলে সে প্রতি ২০ থেকে ২৫ বছর বাড়ির বাহিরে। তারা দুই ভাই এক বোন। 

আবু সাঈদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ উঠলেও তার গ্রামের বাড়ির অবস্থা খুব ভালো নয় বলে জানান তিনি। তবে বিষয়টি এলাকার জন্য অসম্মানজনক। এজন্য তিনি তার পরিবারকে অনুরোধ করবেন যেন আবু সাঈদ ভুক্তভোগীদের টাকাগুলো ফেরত দেয়। তবে আবু সাঈদের সাথে ফোনে অথবা ইন্টারনেটে তিনি এখনো কথা বলতে পারেননি বলে জানান এই প্রতিবেদককে। 

এ বিষয়ে প্রবাসী মন্ত্রণালয়ের সচিব রুহুল আমিন ও বিএমইটির মহাপরিচালক সালেহ আহমদ মোজাফফরের মোবাইলে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও তাদেরকে ফোনে পাওয়া সম্ভব হয়নি।  

এমআইকে/এএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর