মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ঢাকা

অন্যকে বাঁচাতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ আরিফের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত

মোস্তফা ইমরুল কায়েস
প্রকাশিত: ৩১ আগস্ট ২০২৪, ০৯:৩৩ এএম

শেয়ার করুন:

অন্যকে বাঁচাতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ আরিফের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত
হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছেন আরিফ। ছবি: ঢাকা মেইল

আরিফুল ইসলাম (২৪)। গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলায়। তিনি মিরপুর-১০ এলাকায় ফেরি করে বিভিন্ন বইপত্র, আতর, তসবিহ বিক্রি করতেন। এই আয়েই ঘুরত সাত সদস্যের সংসারের চাকা। তিনি ঢাকায় মেসে থেকে গ্রামে পরিবারকে সাপোর্ট দিতেন। কিন্তু সেই আরিফ এখন শয্যাশায়ী। পুরোপুরি সুস্থ হতে পাঁচ বছর লাগতে পারে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক। এতে আগামী দিনগুলোতে শুধুই অন্ধকার দেখছেন এই যুবক।  

কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে গত ১৮ জুলাই থেকে মাঠে ছিলেন আরিফ। নিজে ছাত্র না হলেও ন্যায্য অধিকারের পক্ষে সক্রিয় হন। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগের দিন ৪ আগস্ট তিনি গুলিবিদ্ধ হন। তার দুই পায়ে চারটি গুলি লাগে। সেদিন থেকে তার ঠিকানা পঙ্গু হাসপাতালের বিছানা।


বিজ্ঞাপন


তিন মাসের সন্তান, তিন ছোট ভাই, মা ও স্ত্রীকে নিয়ে এখন অনিশ্চিত গন্তব্য আরিফের। হয়ত দুই-একদিনের মধ্যে হাসপাতাল থেকে রিলিজ পাবেন, কিন্তু গ্রামে ফিরে কীভাবে সংসার চলবে তা তিনি জানেন না। ফলে দুশ্চিন্তায় কাতর হয়ে পড়েছেন তিনি।

বৃহস্পতিবার (২৯ আগস্ট) রাতে পঙ্গু হাসপাতালের বেডে শুয়ে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলছিলেন আরিফ। তিনি জানান, গত ৪ আগস্ট তিনি মিরপুর-১০ এলাকায় আন্দোলন চলাকালে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ছিলেন। আন্দোলনকারীদের দমাতে পুলিশের পাশাপাশি ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও  আওয়ামী লীগের অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরাও ছিল। তাদের সাথে কোনোভাবে আন্দোলনকারীরা কূলিয়ে উঠতে পারছিল না। কারণ তারা ধারালো অস্ত্র নিয়ে তাদের ধাওয়া করছিল আর পিস্তল শর্টগান নিয়ে গুলি করছিল। বিকেলে সেনাবাহিনী মিরপুর-১০ নিয়ন্ত্রণে নিলে পরিস্থিতি শান্ত হয়। পরে ছাত্রদের সাথে তিনি আবারও মাঠে নামেন।

কিন্তু বিকেল হতেই পরিস্থিতি ঘোলাতে হতে শুরু করে। তখন অস্ত্রধারী ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের সাথে যোগ দেয় পুলিশ। শুরু হয় গোলাগুলি। বিকেল সাড়ে ৫টার পর মিরপুর-১০ এ থাকা ফায়ার সার্ভিসের উল্টো পাশে সড়কে শুরু হয় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। এসময় ১০ বছরের এক গুলিবিদ্ধ শিশুকে উদ্ধার করতে গিয়ে তিনি গুলিবিদ্ধ হন।


বিজ্ঞাপন


আরও পড়ুন

হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন গুলিবিদ্ধ সাগর, দুশ্চিন্তা পরিবার নিয়ে

সাড়ে তিনশ গুলি গায়ে নিয়ে কাতরাচ্ছেন মুফতি ফিরোজ

আরিফ সেই সময়কার ঘটনা তুলে ধরে ঢাকা মেইলকে বলেছিলেন, ‘আমি ১০ বছরের বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে কেবল উঠছি, ওই সময় আমার এক পায়ে গুলি করা হয়। আবার আরেকটু উঠতেই আরেক পায়ে গুলি করা হয়। এটা করা হইছে ফায়ার সার্ভিসের ভবনের ওপর থেকে। পুলিশ রাবার বুলেট ছাড়ছিল, কিন্তু বিভিন্ন ভবনের ওপর থাইক্যা উড়াধুরা গুলি করতাছিল ওরা (ছাত্রলীগ ও যুবলীগের অস্ত্রধারীরা)। পরে বাচ্চাটা বাইচা ছিল কি না আর কইতে পারি না। সেদিন বাচ্চাটাকে আমি বাঁচাইতে গিয়া গুলি খাইছি। পিছু হটলে আমারে গুলি করতে পারত না। পিছে গেলে একটা গুলিও খাইতাম না।’

Arif1

তিনি জানান, মিরপুর-১০ থেকে স্টেডিয়ামে যেতে সড়কে ওই সময় তার সামনে ছিল পুলিশ। পেছনে ও বামে ছিল আন্দোলনকারীরা। কিন্তু ফায়ারের ভবনের দিকে ডানের সড়কে কোনো লোকজন ছিল না। সেই সময় ভবনটির ওপর থেকে গুলি করা হয়েছে। যা তার দুই পায়ে খাঁড়াভাবে লাগে। ফলে গুলিগুলো পুলিশ করেনি, অন্য কেউ করেছিল বলে দাবি তার। 

সে দিনের ঘটনা বলতে গিয়ে এক পর্যায়ে কেঁদে ফেলেন আরিফ। তিনি বলেন, ‘কারও যদি মনুষ্যত্ব থাকে কেউ এভাবে গুলি চালাইতে পারে না। এরা মানুষ না। সেদিন একজন আরেকজনরে বাঁচাইতে গিয়া গুলি খাইছে, মইরা গেছে অনেকে।’

আরিফ জানান, তার পায়ে লেগে থাকা চারটি গুলি অপারেশন করে বের করা হয়েছে। চিকিৎসক জানিয়েছেন, সেগুলো একে-ফোরটি-সেভেন রাইফেল দিয়ে করা হয়েছিল, যা পুলিশ ব্যবহার করে না। ফলে তিনি নিশ্চিত ওই সময় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সন্ত্রাসীরাই তাকে গুলি করেছে।

আরও পড়ুন

মাথায় গুলি, ক্ষণে ক্ষণে স্মৃতি হারিয়ে ফেলেন জাকির

মাথায় হাতুড়ির আঘাতে অচল গাড়িচালক রফিকের জীবন

আরিফ বলেন, ‘তারা এমনভাবে গুলি করেছে, আমার পায়ের হাড় ভেঙে সেগুলো ওপাশ দিয়ে বের হয়ে গেছে।’

আরিফের তিন মাসের একটি সন্তান রয়েছে। এছাড়াও তার তিন ছোট ভাই, মা ও স্ত্রীকে নিয়ে সংসার। তার আয়ে সংসারটি চলত। কিন্তু এখন চোখে-মুখে শুধুই অন্ধকার। ইতোমধ্যে তিনি মেস ছেড়েছেন। তার ব্যবসার মালপত্রও গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এখন সামনে কীভাবে চলবেন তা তিনি জানেন না।

দুই পায়ে লাগা চারটি গুলির আঘাতে আরিফের রগ ছিঁড়ে ‍গেছে। ফলে সেগুলো জোড়া না লাগা পর্যন্ত হাড়ের অপারেশনও সম্ভব না। এখন তার দুই পা পুরোপুরি অবশ। তার পুরোপুরি সুস্থ হতে পাঁচ বছর লাগতে পারে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক।

এমআইকে/জেবি

 

 

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর