আহমেদ হাসান (১৮) কাজ করেন একটি দুগ্ধ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানে। গত বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) বিকেলে বাসা থেকে বের হয়েছিলেন। দুধ বিলির বকেয়া টাকা তুলে রাত সাড়ে নয়টায় বাসায় ফিরছিলেন। মোহাম্মদপুর তিন রাস্তার উত্তর দিকে ঢাল হয়ে কেবল উঠবেন। এ সময় দেখতে পান কিছু মানুষ ছোটাছুটি করে তার দিকে ধেয়ে আসছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার ডান হাতের রক্তে ভরে যায়। তখন তার মনে হচ্ছিল, পৃথিবীর সব ওজন সেই হাতের উপর পড়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যে হাত খুলে পড়বে। বাম হাতের কনুই ধরে উল্টো পাশে আবারো হাঁটা শুরু করেন। কিছুদূর গিয়ে একটি ফার্মেসিতে প্রাথমিক চিকিৎসা নেন। পরে তিনি চলে যান সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে গত নয় দিন থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন তিনি।
কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে আহত হন হাসান।
বিজ্ঞাপন
গতকাল শুক্রবার (২৬ জুলাই) বিকেলে ঢাকা মেইলের প্রতিবেদকের কথা হয় হাসানের সঙ্গে। তিনি ছাত্র কিংবা আন্দোলনকারী ছিলেন না। কিন্তু কেন তাকে গুলি করা হলো তা তিনি জানেন না।
শুধু আহমেদ হাসান নন, তার মতো আরও অনেকে ব্যক্তিগত কাজে বের হয়ে সেদিন গুলি খেয়েছেন। কেউ হারিয়েছেন পা, কেউ হাত, আবার কেউ জীবনটাই দিয়েছেন। তবে হাসান প্রাণে বেঁচে আছেন এটাই তার কাছে বড় কিছু। তার আক্ষেপ, কোনো অপরাধ না করেও তিনি আজ হাসপাতালে।
হাসানের হাতের ক্ষতটা এতটাই বড় যে, গুলি ঢুকে এ পাশ থেকে ওপাশে চলে গেছে। প্রথমে বুঝতে পারেননি তিনি। পরে বুঝতে পারলেও খুব দেরি হয়ে যায়। ততক্ষণে গলির ফার্মেসির দোকানদার তার হাতের অবস্থা বারোটা বাজিয়ে দেন বলে অভিযোগ হাসানের।
বিজ্ঞাপন
তিনি ঢাকা মেইলকে বলছিলেন, ‘কী বলবো কিছু বলার নাই। শুধু আল্লাহর কাছে বিচার দিলাম। ওগোর বিচার আল্লাহ করব। তারা বিনা দোষে আমার ওপর গুলি চালাইল।’
আরও পড়ুন
হাসান জানান, হাতে গুলি লাগার পর রক্ত ঝরছিল। ভেবেছিলেন হয়ত ছোট গুলি এসে লেগেছে। কিন্তু বুঝতে পারেননি বড় গুলি ঢুকে তার হাতের এপাশ-ওপাশ চলে গেছে। নিকটস্থ ফার্মেসিতে গেলে সেখানে থাকা দোকানদার তাকে জানান, তিনি গুলি বের করতে পারবেন। পরে ওই দোকানি ধারালো ছোট চাকু বা অস্ত্র দিয়ে তার হাত কাটা শুরু করেন। কিন্তু এক পর্যায়ে তার হাতে কোনো গুলি পাননি। ততক্ষণে তার হাত কেটে সাড়া। প্রচুর রক্ত ঝরছিল। সেই লোক তার হাতের গর্তে গজ ব্যান্ডেজ গুজে দিয়ে বলেন, আপনি হাসপাতালে চলে যান। এরপর সোজা তিনি রক্তাক্ত হাত নিয়ে হাসপাতালে ছোটেন। তার হাতে অস্ত্রোপচার হয়েছে। তবে কবে নাগাদ তিনি সুস্থ হতে পারবেন তা জানেন না।
ফার্মেসির সেই হাতুড়ে ডাক্তারের কথা জানিয়ে আক্ষেপ করে হাসান বলেন, ‘ওই লোক আমারে শেষ করে দিল। নিজে পারব না বললও না। তিনি হাতটা কাইটা ফালাইছেন বইলা হাতটার বড় ক্ষতি হইয়া গেছে।’
হাসানের বাবা স্থানীয় একটি গ্যারেজ চালান। হাসান নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর আর পড়াশোনা করা হয়নি। বাবার পাশাপাশি সংসারে যোগান দিতে দুধ সরবরাহকারী একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মী হিসেবে যোগদান করেন। বরাবরের মতোই গত বৃহস্পতিবার কাজে বের হয়েছিলেন। কিন্তু ফেরার পথে তিনি আন্দোলনের বলি হন।
শুক্রবার বিকেলে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের ৪২০ নম্বর কক্ষে গিয়ে দেখা গেল, হাসান বেডে শুয়ে আছেন। তাকে দেখার জন্য কয়েকজন আত্মীয়-স্বজন এসেছেন। তার সাথে রয়েছে এক বন্ধু। ডান হাতের কাঁধের নিচে হাতের অংশে কয়েকটা পাইপ লাগানো, সাথে ইনজেকশন। বুঝতে বাকি রইল না এই হাতেই হাসানের গুলি লেগেছে। তবে গুলির চিহ্ন স্পষ্ট। হাতের পেছন দিক দিয়ে গুলি বের হয়ে গেছে। যার ক্ষত এখনো আছে।
হাসানের মতোই দুই পায়ে গুলি লেগে আহত হন স্কুলছাত্র আদাম আমিন। মিরপুরের ন্যাশনাল স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র সে। ১৯ জুলাই শুক্রবার মোহাম্মদপুর থেকে মামার বাড়িতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু মামার বাড়িতে আর ঢোকা হয়নি। তার আগেই তিনি গুলি খেয়েছেন। তার দাবি, তিনি ছাত্র, কিন্তু আন্দোলনকারী ছিলেন না। শুধু রাস্তায় দাঁড়িয়ে লোকজনের ভিড় দেখছিলেন।
আমিন বলে, ‘আমি তো রাস্তায় বের হয়েছিলাম। আমার অপরাধ কী! আমাকে ওই পুলিশ গুলি করল কেন! আমি তো আন্দোলনকারী ছিলাম না।’
আমিনের দুই পায়ে হাঁটুর নিচে গুলি লেগেছে। গুলি ঢুকে পাশ থেকে ও পাশ হয়ে গেছে। যার ক্ষত প্রায় এক ইঞ্চি। এ পাশ থেকে ও পাশে দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু এখন চিকিৎসার ফলে সেটির উন্নতি হচ্ছে। তবে তার এই ক্ষত কবে মুছবে তা সে জানে না।
আমিন বলছিল, ‘আমি তো আর স্বাভাবিকভাবে হাঁটাচলা করতে পারব না। আমরা কই যাব বলেন! আমাদের নিরাপত্তা কই? মাটির উপরে যদি নিরাপত্তা না পাই তাহলে কি কবরে ঢুকুম!’
এমআইকে/জেবি