শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০২৪, ঢাকা

ভাষাসৈনিকদের নামে সড়ক শুধু ফলকেই

বোরহান উদ্দিন
প্রকাশিত: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৬:৩৬ পিএম

শেয়ার করুন:

ভাষাসৈনিকদের নামে সড়ক শুধু ফলকেই
পথচারী-বাসিন্দারা জানেন না কার নামে সড়ক
ভাষাসৈনিকদের ব্র্যান্ডিং করতে হবে: নগরপরিকল্পনাবিদ
সড়কগুলো পরিচিত করার কাজ চলছে: সিটি করপোরেশন

ভাষা আন্দোলনে অবদান রাখা ভাষাসৈনিকদের নামে অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশন রাজধানী ঢাকায় ১৫টি সড়কের নামকরণ করে। বর্তমান দুই সিটির মধ্যে দক্ষিণে ১৪টি আর উত্তরে একটি সড়ক রয়েছে ভাষাসৈনিকদের নামে। ২০০৭ সালে প্রয়াত মেয়র সাদেক হোসেন খোকার হাত ধরে শুরু হওয়া এই উদ্যোগ এখনও শুধু নামফলকেই সীমাবদ্ধ। সড়কগুলো যেমন ভাষাসৈনিকদের নামে পরিচিতি পায়নি, তেমনি সারা বছর নামফলকগুলোও থাকে শ্রীহীন। এমন কি ২১ ফেব্রুয়ারি মহান শহীদ দিবস উপলক্ষেও সংশ্লিষ্ট কেউ নজর দেন না নামফলকগুলোতে।


বিজ্ঞাপন


ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের দোয়েল চত্বর থেকে শিক্ষা ভবন পর্যন্ত সড়কটি ‘ভাষাশহীদ শফিউর রহমান সড়ক’ নামে নামকরণ করেছে।

এছাড়া বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের উত্তর ফটক থেকে ডিআইটি এক্সটেনশন সড়কে বের হতে নির্মাণাধীন সড়কটির নাম ‘খতিব অধ্যাপক মাওলানা মোহাম্মদ সালাহ্ উদ্দিন সড়ক’ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিটি করপোরেশন।

ভাষাসৈনিকদের নামের সড়কগুলোর বাসিন্দা, ব্যবসায়ী কিংবা নিয়মিত চলাচল করেন এমন একাধিক পথচারীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অনেকেই জানেন না কার নামে কোন সড়ক।

21_Feb--Name--Burhan--Inner-01


বিজ্ঞাপন


ইতিহাসবিদরা বলছেন, ভাষাসৈনিকদের নামে সড়কগুলোর নামকরণ করা হলেও পরবর্তীতে এ নিয়ে খুব বেশি প্রচার-প্রচারণা চালানো হয়নি। নাগরিকরাও সচেতন নয়। যে কারণে সড়কগুলো আগে যে নামে পরিচিত ছিল সে নামেই ডাকা হচ্ছে। ভাষাসৈনিকদের নামে নতুন নামকরণ গুরুত্ব পাচ্ছেন না।

২০০৭ সালের ২ জানুয়ারি সিটি করপোরেশনের ১১তম সভায় ধানমণ্ডিসহ বেশকিছু সড়ক ভাষাসৈনিক, বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ গুণী মানুষের নামে নামকরণ করা হয়। জানা গেছে, ভাষাসৈনিকদের নামে সড়কগুলো উদ্বোধন করা হয় ২০০৬ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে। তখন মেয়র ছিলেন সাদেক হোসেন খোকা।

সিটি করপোরেশনের দক্ষিণের বেশিরভাগ সড়ক ধানমন্ডিতে অবস্থিত। উত্তরের সড়কটি রয়েছে টেকনিক্যাল মোড়ে।

ভাষাসৈনিকদের নামের সড়কগুলোর অবস্থা কি

ধানমন্ডি ১ নম্বর এলাকার সড়কের নামকরণ করা হয়েছিল ভাষাসৈনিক ডা. গোলাম মাওলার নামে। সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে ওভার ব্রিজের নিচে একটি ম্যুরালও আছে। কিন্তু হকার আর রিকশার ভিড়ে ভাষাসৈনিকের নামের ম্যুরাল চোখে পড়াও কষ্টকর।

শফিকুল ইসলাম নামের একজন পথচারী ঢাকা মেইলকে বলেন, ভাষাসৈনিকের নাম রিকশাওয়ালাকে বললে জীবনেও চিনবে না। আমরাও যারা নিয়মিত চলাচল করি তারাও ভালো করে জানি না।

সিটি কলেজ পার হয়ে সামনে এগোলে আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দ্য ঢাকার দেয়াল। ধানমন্ডি তিন নম্বর সড়কের প্রবেশমুখে লেখা রয়েছে ‘ভাষাসৈনিক মোহাম্মদ সুলতান সড়ক’। ২০০৭সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি এটি উদ্বোধন করার তথ্য থাকলেও যার নামে সড়ক তার কোনো তথ্য নেই ফলকে।

ঢাকায় দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে রিকশা চালান তারা মিয়া। নামফলকের পাশে দাঁড়িয়ে তার সঙ্গে কথা হয় প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, পুরো ঢাকায় রিকশা চালাই। ধানমন্ডিতেও আসি। কোনোদিন এই লোকের নামে রাস্তা কেউ খুঁজে নাই। সবাই বলে ধানমন্ডি ৩ নম্বর যাব।

একটু সামনে এগিয়ে ধানমন্ডি ৪ নম্বর সড়কের মুখেই ভাষাসৈনিক অলি আহাদের নামের ফলক। জরাজীর্ণ নামফলকের পাশেই চা-সিগারেটের দোকান চালান মানিক। নিজেই জানেন না কার নামে এই সড়কটি।

এই সড়কটি কার নামে জানতে চাইলে ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, কেন ইশরাকের বাপের নামে (সাদেক হোসেন খোকা এটি উদ্বোধন করেছেন)!

পরক্ষণেই তিনি বলেন, ‘হায় হায় এটা তো অলি আহাদের নামে রাস্তা। তয় এই নামে কেউ চিনে না। ৪ নম্বর রাস্তা কইলে সবাই চেনে।’ পাশে দাঁড়ানো একাধিক রিকশাচালকও একই কথা বলেন।

ধানমন্ডি ৫ নম্বর রাস্তাটি ভাষাসৈনিক আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশের নামে নামকরণ করেন সাদেক হোসেন খোকা। বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বাসার দেয়ালের পাশেই এই ফলক।

সেখানে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্য মো. হারুন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘কেউ এই নামে চিনে না রাস্তাটা। ৫ নম্বর বললে সবাই চেনে।’

পরের ৬ নম্বর সড়ক ভাষাসৈনিক আবুল কালাম শামসুদ্দিনের নামে নামকরণ করেছে সিটি করপোরেশন। কাছে গিয়ে দেখা যায় ধুলোময়লা জমে আছে ফলকটির ওপর। গাড়ির ধাক্কায় একদিকে বাঁকা হয়ে গেছে ফলকটি।

ফলকটির পাশেই অনেক ধরে পান-সিগারেট বিক্রি করেন একজন। সড়কটির বিষয়ে কথা তুলতেই তিনি বলেন, ‘বাংলায় তো এমনিতে কথা বলতে পারতেছি না, এই মানুষগুলোর অবদান তো আছে। কিন্তু এই নাম কেউ মুখেও নেয় না। অনেকে জানেও না। সরকার, সিটি করপোরেশন চাইলে এটা প্রচার করতে পারে।’

এসময় পাশের মিষ্টির দোকানের সাইনবোর্ড দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘দেখেন, আমাদের মালিক ভাষা সৈনিকের নামে সাইনবোর্ড করেছে। আশপাশের কেউ করেনি।’

21_Feb--Name--Burhan--Inner-02

এই দোকানের পাশে ব্লু প্রিন্ট ফার্মেসির সাইনবোর্ডে ঠিকানায় ভাষা সৈনিকের বদলে ধানমন্ডি ছয় নম্বরই লেখা রয়েছে। জানতে চাইলে দোকানের একজন কর্মচারী অনেকটা আশ্চর্য হয়ে ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আপনি ছাড়া কেউ কোনোদিন এই রাস্তার নাম কি জানতে চায়নি। সবাই ধানমন্ডি ৬, না হলে থানার পাশের কথা বলে।’

ভাষাসৈনিক ডা. গোলাম মাওলা ছাড়াও ধানমন্ডি ৭ নম্বরে ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন সড়কে তার নামে একটি ম্যুরাল আছে। যা তৈরি হয়েছে এনসিসি ব্যাংকের সৌজন্যে। ধানমন্ডি ৮ নম্বরকে ভাষাসৈনিক গাজীউল হক সড়ক করা হয়েছে। তার একটি ম্যুরালও রয়েছে। তবে ম্যুরালের লেখা প্রায় মুছে গেছে। পড়া যায় না। এটি তৈরি করা হয়েছে ইস্টার্ন ব্যাংকের সৌজন্যে।

ম্যুরালগুলোতে ভাষাসৈনিকদের ছবি, পরিচিতি এবং ভাষা আন্দোলনের সময়ে তাদের ভূমিকার কথা উল্লেখ আছে।

অন্যদিকে ধানমন্ডি ৯ ও ১০ নম্বরে সড়কের নামকরণ করা হয়েছে ভাষাসৈনিক কাজী গোলাম মাহবুবের নামে। ৯ নম্বর সড়কে একটি ম্যুরাল থাকলেও তার সামনে একটি নার্সারির দোকান অনেকটা স্থায়ীভাবে বসানোর কারণে ম্যুরাল খুব একটা দেখা যায় না।

এছাড়া ধানমন্ডি ৯/এ ভাষাসৈনিক তোয়াহা, ধানমন্ডি ১৫ নম্বরে ভাষাসৈনিক বিচারপতি আবদুর রহমান চৌধুরী, ধানমন্ডি ১২ নম্বরে ভাষাসৈনিক অধ্যাপক সুফিয়া আহমেদ, ধানমন্ডি ১৩ নম্বরে ভাষাসৈনিক অধ্যাপক সাফিয়া খাতুন, ধানমন্ডি ৫/এ ভাষাসৈনিক কামরুদ্দীন আহমদ এবং ধানমন্ডি ৪/এ ভাষাসৈনিক শওকত আলীর নামে নামকরণ করার ফলক আছে।

এসব সড়কগুলোর বাড়ির নামফলকে দেখা গেছে নম্বর ধরে সড়কের নাম লেখা। এতে নেই ভাষাসৈনিকদের নাম। দোকানগুলোরও একই অবস্থা। ভাষাসৈনিকদের পাওয়া যাবে শুধু সড়কের মাথার নামফলকে।

অন্যদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অধীনে টেকনিক্যাল মোড় থেকে মিরপুর ১ নম্বর পর্যন্ত সড়কের নামকরণ করা হয়েছে ভাষাসৈনিক প্রিন্সিপাল আবুল কাসেমের নামে। টেকনিক্যাল মোড় থেকে মিরপুর সড়কে যেতে শুরুতে এই ভাষাসৈনিকের নামে একটি ফলক আছে। যদিও সড়কটি পরিচিত দারুস সালাম সড়ক হিসেবে।

কী করছে সিটি করপোরেশন?

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ সিরাজুল ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, লোকজন যাতে ভাষাসৈনিকদের নামে রাস্তা চেনে সেজন্য কাজ করে থাকি। কিন্তু মানুষকে সচেতন হতে হবে। গণমাধ্যমও বড় ভূমিকা রাখতে পারে। তবে সিটি করপোরেশন থেকে সব ধরনের ট্রেড লাইসেন্স, হোল্ডিং ট্যাক্স, ফ্ল্যাট কেনাবেচাতেও সড়কের এই নাম ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।’

বেশিরভাগ সময় অযত্ন-অবহেলায় ময়লা জমে যায় নামফলকগুলোতে— এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা মাঝেমধ্যে এগুলো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, সংস্কারের কাজও করে থাকি।’ অবশ্য স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে এর সত্যতা পাওয়া যায়নি।

কী পরামর্শ দিচ্ছেন ইতিহাসবিদ ও নগরপরিকল্পনাবিদরা

ভাষাসৈনিকদের নামের সড়কের পরিচিতির বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে ইতিহাসবিদ ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘এগুলো আসলে করার জন্য করা হয়েছে। সাদেক হোসেন খোকা তার মতো করে এগুলো উদ্বোধন করেছেন। এদের কেউ কেউ আছেন যাদের নামে এমন নামকরণের সময়ও হয়নি। তাই এসব নিয়ে কথা বলে খুব লাভ নেই। কারণ মানুষের মনে যেটা গেঁথে আছে তা মুছে ফেলা কঠিন।’

ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংরক্ষণে দক্ষিণের মেয়র শেখ ফজলে নুর তাপসের চেষ্টার প্রশংসা করে তিনি বলেন, ‘বর্তমান মেয়র বেশ আন্তরিক। ঢাকা গেট নতুন করে চালু হলো। নর্থব্রুক হলও খোলা হবে। এসবই তো আসল ঐতিহ্য। তবে এসব নিয়ে ধারাবাহিক প্রচারণা চালাতে হবে।’

আর বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মোহাম্মদ খান মনে করেন, নতুন প্রজন্মের কাছে ভাষাসৈনিকদের ইতিহাস ও অবদান তুলে ধরতে ব্র্যান্ডিংয়ে মনোযোগ দিতে হবে।

ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, তাদের নামে সড়কের নামকরণ করা হলেও আসলে ব্র্যান্ডিং করা হয়নি। তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্যও নেই। ফলকগুলোর পাশে বড় করে ভাষাসৈনিকদের সম্পর্কে সব তথ্য রাখা যেতে পারে। স্কুলের মাঠ কিংবা শিক্ষার্থীদের এদের ইতিহাস ও অবদানের বিষয় জানানোর ব্যবস্থা করা উচিত। অর্থাৎ সামগ্রিক পরিকল্পনা নেওয়া গেলে একদিন সবার মুখে মুখে তাদের নাম উচ্চারিত হবে।

বিইউ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর